২৭ বছর আগের ১৩ জুলাই এই যুবভারতীতেই খেলেছিলেন নাজিমুল। বিষ্ণুরা তাঁকে নিয়ে গেলেন ফেলে আসা সময়ে।
কৃশানু মজুমদার: ১৯৯৭, ১৩ জুলাই।
২০২৪, ১৩ জুলাই।
দুই ভিন্ন সময়। ভিন্ন প্রেক্ষিত।
বাঙালির চিরআবেগের ডার্বি মিলিয়ে দিয়ে গেল অতীত ও বর্তমানকে। একই বিন্দুতে যেন এসে মিশল দুই সময়।
২৭ বছর আগের এক ডার্বিতে ইস্টবেঙ্গল (East Bengal) ৪-১ গোলে বিধ্বস্ত করেছিল মোহনবাগানকে (Mohun Bagan)। সেটা ছিল ফেডারেশন কাপের সেমিফাইনাল। গুগল সার্চ ইঞ্জিন বলছে ১, ৩১, ৭৮১ জন দর্শক ডার্বি দেখতে উপস্থিত হয়েছিলেন যুবভারতীতে। বাঙালির বড় আবেগের, বড় প্রিয় যুবভারতীতে তিল ধারণের জায়গা ছিল না। গ্যালারির শব্দব্রহ্ম বাড়তি অ্যাড্রিনালিন ঝরাচ্ছিল ফুটবলারদের।
আজ শনিবার ছিল কলকাতা লিগের ডার্বি (CFL Derby)। তার উপরে লিগ ডার্বির শতবর্ষ।
দুই সময়ের দুটো ম্যাচের মধ্যে পার্থক্য বিস্তর। সময়েরও ব্যবধান রয়েছে। ফলাফলও ভিন্ন। কিন্তু স্থান একই। যুবভারতী ক্রীড়াঙ্গন।
বাঙালি নস্ট্যালজিক। কোনও অলস বিকেলে ফেলে আসা দিনের স্মৃতি উঁকি দিয়ে যায় মনে।
ঠিক যেমন দুযুগ আগের এক ডার্বির স্মৃতিতে অবগাহন করছেন ডায়মন্ড ম্যাচের প্রথম গোলদাতা নাজিমুল হক। এদিনের ডার্বির শেষ বাঁশির পরে নাজিমুল হকের সঙ্গে যখন যোগাযোগ করা হল, তিনি তখন সদ্য প্রয়াত দাদার শেষকৃত্য সেরে উঠেছেন। লিগের ডার্বি দেখা হয়নি তাঁর।
সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল-কে নাজিমুল বললেন, ”আজকের দিনটা খুব স্মরণ করছিলাম। নিজের জন্মদিন হয়তো ভুলে যাব কাজের চাপে। কিন্তু ১৩ জুলাই কোনওদিন ভুলতে পারব না। মৃত্যু পর্যন্ত দিনটা মনে রাখব।” ডার্বির স্মৃতি ম্লান হওয়ার নয় কখনওই।
শনিবারের লিগ ডার্বিতে বিরতি পর্যন্ত খেলার ফলাফল ছিল গোলশূন্য।দ্বিতীয়ার্ধে বিষ্ণু ও জেসিনের গোলে এগিয়ে যায় লাল-হলুদ। খেলার শেষ লগ্নে সুহেল ভাট গোল করে ব্যবধান কমান সবুজ-মেরুনের হয়ে। তবুও ম্যাচ জেতা হয়নি মোহনবাগানের।
২৭ বছর আগের সেই মহাম্যাচ ছিল সবঅর্থেই অন্যরকম। অমল দত্তর প্রশিক্ষণে মোহনবাগান দুরন্ত গতিতে ছুটছিল। তাঁর বহুচর্চিত ডায়মন্ড সিস্টেম ঝড় তুলে দিয়েছিল ময়দানে। ফেডারেশন কাপের শেষ চারের লড়াইয়ে মোহনবাগানের মুখোমুখি হয় ইস্টবেঙ্গল। স্মৃতি রোমন্থন করে নাজিমুল বলছিলেন, ”শুধু গোল করা বা ইস্টবেঙ্গল জিতেছিল বলে ম্যাচটা স্মরণীয় হয়ে রয়েছে এমন নয়। এই ম্যাচ খেলার অভিজ্ঞতাই অন্যরকম। যুবভারতী উত্তেজনায় ফুটছিল। ২৫ মিনিট পর্যন্ত মোহনবাগান দারুণ চাপ তৈরি করে রেখেছিল আমাদের উপর। ইস্টবেঙ্গল ডিফেন্সে তখন ত্রাহি ত্রাহি রব। আমার গোলের পর থেকেই ম্যাচের রং বদলে যায়। বাইচুং ভুটিয়া হ্যাটট্রিক করে। ইস্টবেঙ্গলের জার্সিতে খেলেছিলাম বলেই আজও আমার কথা মানুষ মনে রেখেছে। এর জন্য আমি ইস্টবেঙ্গল কর্তা, কোচ, ম্যানেজমেন্টকে ধন্যবাদ জানাই।” মোহনবাগানের হয়ে একটি গোল করেছিলেন চিমা ওকোরি।
আজকের বিষ্ণু-জেসিন-সায়নরা কি জানেন নাজিমুলকে? এরকমই এক ডার্বিতে যাঁর নাম জায়গা করে নিয়েছিল স্কোরলাইনে, সেই খবর কি রাখেন আজকের তারকারা? ডার্বি ম্যাচ তারকার জন্ম দেয়। ফেডারেশন কাপ সেমিফাইনালের সেই ডার্বি নাজিমুলকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে গিয়েছিল বললেও অত্যুক্তি করা হবে না।
স্মৃতির সরণি ধরে হেঁটে নাজিমুল বলছিলেন, ”আমাদের স্যর পিকে ব্যানার্জির কথা বলব। ম্যাচের আগে স্যর বলছিলেন, ধরো তোমাদের মা-কে কেউ অসম্মান করছে, ছেলে হিসেবে তোমরা কি তা মেনে নেবে?” পিকে স্যরের কথাগুলো অনুরণিত হয়ে ফেরে নাজিমুলের কাছে। মনের ক্যানভাসে ভেসে ওঠে ১৩ জুলাই, ১৯৯৭। সেবারের ফেডারেশন কাপের পরে কেটে গিয়েছে অনেকগুলো বছর। নাজিমুলও বুটজোড়া তুলে রেখেছেন বহুদিন আগে। লাল-হলুদের অনুজ ফুটবলাররা তাঁকে নিয়ে যাচ্ছেন ফেলে আসা সময়ে। সায়ন-বিষ্ণুদের প্রশংসা করছেন তিনি।
এদিনের লিগ ডার্বি না দেখলেও এবারের লিগে ইস্টবেঙ্গলের ম্যাচ দেখেছেন তিনি। প্রাক্তন দলের খেলা দেখে নাজিমুলের উপলব্ধি, ”এই দলটা অনেক দূর এগোবে বলেই আমার বিশ্বাস। নিজেকেই যদি না ভালোবাসি তাহলে ক্লাব, কোচকে কীভাবে ভালোবাসব। এই ছেলেগুলো নিজেদের চেনার চেষ্টা করছে। সতীর্থের প্রতি ভালোবাসা এবং ইচ্ছাশক্তির জন্যই ওদের অন্যরকম লাগছে।” প্রাক্তনের এই সার্টিফিকেট সঞ্জীবনী মন্ত্র। নয়া লাল-হলুদ প্রজন্মকে আলোর পথে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা দেবে নাজিমুলের এই বার্তা। এও এক পুরস্কারই বটে।
শনিবারের পড়ন্ত বিকেল নাজিমুলের বুকে তৃপ্তির অনুভূতি বয়ে আনে। সুখের অশ্রুবিন্দুতে ভিজে ওঠে চোখের পাতা। অতীত-বর্তমান মিলেমিশে এক হয়ে যায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.