কৃশানু মজুমদার ও মণিশংকর চৌধুরী: কাতার বিশ্বকাপে (Qatar World Cup 2022) ইরানের সমর্থনে মাঠ ভরাচ্ছেন সমর্থকরা। ইরান (Iran) গোল করলে তাঁরা গলা ফাটাচ্ছেন। কিন্তু তাঁরা আদৌ ইরানের সমর্থক নন। ইরান সরকার গ্যালারি ভরতি করার জন্য ২০ হাজার টিকিট কিনে নিয়েছে। এবং এই টিকিট গুলো দেওয়া হয়েছে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের নাগরিকদের। বাংলাদেশি এবং পাকিস্তানিরাই রুজবে চেশমি-মেহেদি তারেমিদের জন্য গলা ফাটাচ্ছেন কাতারের গ্যালারিতে। এমনই চাঞ্চল্যকর তথ্য জানাচ্ছেন ভারতে খেলে যাওয়া প্রাক্তন ইরানি ফুটবলার মাহমুদ খাবাজি (Mahmood Khabaji)।
এই মুহূর্তে ব্যক্তিগত কাজে তিনি এসেছেন প্যারিসে। সেখান থেকেই সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে বলছেন, ”এই ফুটবলাররা মোটেও আমাদের দেশের মুখ নয়। এই দলটাকে আমরা কেউই সমর্থন করি না। এরা প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির কাছে মাথা নুইয়েছে। দেশের মানুষের পাশে নেই ফুটবলাররা। এরা কেউ তারকা ফুটবলারও নয়। আমাদের দেশে ঘাফুরি, আলি দায়ির মতো তারকা ফুটবলার ছিল। ঘাফুরিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আলি দায়ি গৃহবন্দি।” ইরানের জাতীয় দল নিয়ে ক্ষোভে ফুঁসছেন খাবাজি। তাঁর মতোই দেশের পরিস্থিতির ছবি সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের কাছে তুলে ধরেছিলেন ঢাকা আবাহনীতে খেলা ইরানের ফুটবলার মিলাদ সোলেইমানি। তিনি বলেছিলেন, ”বিশ্বকাপে জাতীয় সংগীত না গেয়ে ফুটবলাররা নাটক করেছে।”
মঙ্গলবার মধ্যরাতে ইরানের সামনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। খেলার মাঠে ইরান ও আমেরিকার জয়-পরাজয়ের উপরে নির্ভর করছে বিশ্বকাপের পরবর্তী রাউন্ডে কোন দল যাবে। যে হারবে সেই দলের বিদায় হয়ে যাবে টুর্নামেন্ট থেকে। ম্যাচটিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক উত্তাপও ছড়াচ্ছে। দুই দেশের মধ্যে বৈরিতা চরমে। সেটার প্রতিফলন ঘটে আমেরিকার সাংবাদিক বৈঠকেও। ইরানের সাংবাদিকদের প্রশ্ন করার সুযোগই দেওয়া হয়নি। সাংবাদিক বৈঠকের শেষ প্রশ্নটি করতে দেওয়া হয় ইরানের সাংবাদিক শেরভিন তাহেরিকে। প্রতিবাদে ইরানি সাংবাদিক পালটা দিয়েছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফুটবল দলের ডিরেক্টর অফ কমিউনিকেশনকে। শেরভিন বলেন, ”আমেরিকার ডিরেক্টর অফ কমিউনিকেশনের উদ্দেশে একটাই কথা বলতে চাই। আন্তর্জাতিক মিডিয়াকে সম্মান জানানো উচিত। কারণ এটা বিশ্বকাপ। এমএলএস কাপ নয়। ধন্যবাদ।”
এর মধ্যেই দুই দেশের মধ্যে শুরু হয়ে গিয়েছে ঠান্ডা লড়াই। মার্কিন ফুটবল ফেডারেশনের বিরুদ্ধে জাতীয় পতাকা বিকৃতির অভিযোগ এনেছে ইরান। ফিফার কাছে নালিশ জানিয়েছে ইরান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দশ ম্যাচ সাসপেনশন চাইছে তারা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টুইটার, ফেসবুক এবং ইনস্টাগ্রাম পেজে ইরানের পতাকা থেকে ‘আল্লা’ শব্দটি বাদ দিয়ে ছবি পোস্ট করা হয়েছে। আর তারই প্রতিবাদ জানিয়েছে তেহরান। ফিফার কাছে মেল পাঠানো হয়েছে ইরানের তরফে। এদিকে মার্কিন ফুটবল ফেডারেশনের দাবি, পতাকা থেকে সাময়িক সময়ের জন্য ইসলামী প্রজাতন্ত্রের প্রতীক সরিয়ে দিয়ে তারা মাহসা আমিনির মৃত্যু এবং ‘মৌলিক অধিকারের জন্য সংগ্রামরত ইরানি নারীদের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। সাংবাদিক বৈঠকে উপস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দুই প্রতিনিধি জিমারম্যান ও রিয়াম বলেছেন, ”আমরা মহিলাদের মৌলিক অধিকারের পক্ষে।”
বিদেশি সাংবাদিকদের করা প্রায় এক ডজনের মতো প্রশ্নের উত্তর দেন দুই মার্কিন ফুটবলার। সাংবাদিক বৈঠকের শেষ প্রশ্নটি করতে দেওয়া হয় ইরানি সাংবাদিক শেরভিন তাহেরিকে। তিনি ১৯৯৮ সালের বিশ্বকাপে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইরান ম্যাচের প্রসঙ্গ উত্থাপন করে প্রশ্নটি করেছিলেন। ২৪ বছর আগের বিশ্বকাপে মুখোমুখি হয়েছিল ইরান ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গ্রুপ-এফ এর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ইরান ম্যাচকে ‘মাদার অফ অল গেমস’ বলে বর্ণনা করেছিলেন সেই সময়ের মার্কিন ফুটবল ফেডারেশনের সভাপতি। সেই ম্যাচে ইরান ২-১ গোলে হারিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে। এবার কী হবে? খাবাজি বলছেন, ”দু’ দলের কাছেই এটা মরণবাঁচন ম্যাচ। তবে ইরানের যা অবস্থা তাতে খুব বেশি হলে ওরা ড্র করতে পারে। এর বেশি কিছু নয়।”
রাজনৈতিক পরিস্থিতি তুলে ধরে খাবাজি আরও বলছেন, ”১৯৯৮ ও ২০২২ সালের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য। ইরানে মার্কিন বিরোধী হাওয়া চিরকালই ছিল। কিন্তু এবার সেই হাওয়াকে ছাপিয়ে মাহাসার মৃত্যু বড় আকার ধারণ করেছে। আমেরিকা বিদ্বেষের চেয়েও বড় হয়ে গিয়েছে খামেনেই প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। ইউরোপ, আমেরিকা হিজাব বিদ্রোহ এবং মহিলাদের অধিকারের পক্ষে সরব হয়েছে। আগের মতো বৈরিতা এখন আর অতটা নেই। অনেক ইরানি নাগরিক ইউরোপ ও আমেরিকায় গিয়ে থাকছেন। তাঁরাও এই ফুটবল দলকে সমর্থন করেন না।”
উল্লেখ্য, প্রাক্তন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ ইরান, ইরাক ও উত্তর কোরিয়াকে বলেছিলেন, ‘শয়তানদের অক্ষ’। ইরানের পরমানু বোমা তৈরির প্রক্রিয়ায় নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েছিল ওয়াশিংটন। তবে এখনকার বিদ্রোহ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছে। ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে মার্কিনপন্থী শাহ রাজত্বের পতন ঘটেছিল। তার পরে ক্ষমতায় আসে আমেরিকা বিরোধী রোহুল্লা খোমেইনির সরকার। খাবাজি বলছেন, ”ফুটবলকে ইরান সরকার রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। কিন্তু এবার তাঁরা জনসমর্থন পাচ্ছেন না। এই দলকে নিজেদের বলে মানছেই না কেউ।”
পরিস্থিতি খুবই জটিল ইরানে। বিশ্বমঞ্চে দেশ খেলছে অথচ দেশের মানুষই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে জাতীয় দলের থেকে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.