দেবজিৎ ঘোষ: ছিয়ানব্বইয়ে ইস্টবেঙ্গলে খেলার সময় অঞ্জন মিত্রকে কিছুটা দূর থেকে দেখেছি। আলাপ ছিল। তবে কাছের বা ঘরের ছেলে বলতে যা বোঝায়, সেটা হয়নি। মোহনবাগান কর্তা হয়ে তখন ময়দান কাঁপাচ্ছেন। বাংলার ফুটবলকে তুলে আনতে লড়াই করছেন। সামনে দাঁড়ানোর সুযোগ না হলেও দাপটের কথা কানে আসছে। কাগজে বা অন্যের মুখে নানা কথা শুনছি।
পরের বছরই ছবিটা গেল বদলে। সাতানব্বইয়ে ইস্টবেঙ্গল ছেড়ে চলে এলাম মোহনবাগানে। আর তখনই দেখলাম, দূরের আর কাছের অঞ্জন মিত্রর মধ্যে কত ফারাক। আজ তিনি নেই। তবে অনেক আগেই অসুস্থতার জন্য নিজেকে ময়দান থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন। ইস্টবেঙ্গলের পল্টুদা চলে যাওয়ার পর ময়দানে শূণ্যতা তৈরি হয়েছিল। অঞ্জনদার পর সেটা আরও বাড়ল। আজকের ময়দানে আরও দু’একজন আছেন। ওঁরা চলে গেলে ময়দানে অন্ধকার হয়ে যাবে। কেন একথা বলছি? প্রশ্ন আসবে। আমি একটা কথা বলতে পারি, তিনি ছিলেন প্লেয়ার্স অফিসিয়াল। এটা ময়দানে খুব কমই দেখা যায়। নেই বললেই চলে। আমি মোহনবাগানে অনেকদিন খেলেছি। এই ক্লাব থেকে জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তুলেছি। এসব তিনি না থাকলে হত না। এটা বলতে আমার লজ্জা নেই।
সাতানব্বইয়ে মোহনবাগানে এসে অমল দত্তকে কোচ হিসেবে পেলাম। নতুন স্ট্র্যাটেজিতে দলকে খেলানোর প্রস্তুতি শুরু করে দিলেন। আমরা মাঠেও নেমে পড়লাম। এই সময় জাতীয় দল থেকে ডাক এল। আমি নিশ্চিত অমলদাকে গিয়ে বললে তিনি আমাকে ছাড়বেন না। আবার জাতীয় দলে প্রথমবার সুযোগ পেয়েও যদি না যাই, তা হলে অনেকে অনেক কথা বলবেন। মনের ইচ্ছেকে আড়াল করে অঞ্জনদাকে গিয়ে জানালাম। তিনি সব শুনে বললেন, ‘তৈরি হয়ে যাও। আমি তোমাদের কোচের সঙ্গে কথা বলব। তুমি ক্যাম্পে যাবে।’ আমি জাতীয় দলের ক্যাম্পে গেলাম। খেললামও। এটা সম্ভব হয়েছিল ওই অঞ্জনদার জন্য। তিনি আমার মনের কথা পড়ে নিতে পেরেছিলেন। তাই মানসিক দিক থেকে যেন ভেঙে না পড়ি, তাই সাহস দিয়ে গেলেন।
আজ অনেক ঘটনা মনে পড়ছে। সব লিখতে গেলে দিন ফুরিয়ে যাবে। তার চেয়ে আর একটা গল্প বলি। বোঝা যাবে, তিনি কেমন প্লেয়ার্স কর্তা ছিলেন। মোহনবাগানে আসার পর যে ছবি সবাই দেখেছে সেটা হল, তিনি কখনও দলের থেকে সরে দাঁড়াতেন না। সাফল্যের দিনে যেমন কাছে পেয়েছি, ব্যর্থতার দিনেও তেমন। সে ময়দানে হোক বা ভিন রাজ্যে। সব জায়গায় অঞ্জনদা। সঙ্গে দেবাশিস দত্ত। আমরা ফুটবলাররা সব কথা ওঁদের বলতাম। অঞ্জনদাকে না পেলে দেবাশিস দত্তকে বলতাম। ও সবসময় আমাদের পাশে থাকত। কার কী সমস্যা হচ্ছে, সেটা একবার ওদের কানে পৌঁছে দিতে পারলে আর চিন্তা নেই। সমস্যার সমধান হয়ে যাবে। সেটা শুধু ফুটবল নয়, ব্যক্তিগত কাজ নিয়ে সমস্যা থাকলে ওরা তুড়ি মেরে করে দিত।
খেলা ছাড়ার পর অঞ্জনদার কাছ থেকে দারুণ সার্টফিকেট পাই। মাঠে একদিন দেখা হতে বলেছিলাম, আপনি এখন আর দলের সঙ্গে ট্রাভেল করেন না কেন? আমাদের সঙ্গে তো সবসময় থাকতেন। আপনি পাশে থাকলে ফুটবলাররা চাঙ্গা হয়ে উঠবে। আমার কথা শুনে অঞ্জনদা বলেছিল, ‘তোদের মতো টিম এখন আর নেই। তাই যেতেও ভাল লাগে না।’ মোহনবাগান সচিব শুধু নয়, অঞ্জনদার মতো মানুষের কাছ থেকে এমন সার্টিফিকেট পাওয়া কঠিন। আমার গর্ব, ফুটবলার জীবনে আমি তাঁকে পাশে পেয়েছি।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.