বিশ্বকাপ ফাইনাল আর কয়েক ঘণ্টা দূরে। ফুটবল বিশ্ব কাঁপছে উত্তেজনায়। ফ্রান্স-আর্জেন্টিনা মহারণের ঠিক আগে কী ভাবছেন লিওনেল মেসি? এক খোলা চিঠিতে ধরা থাকল মহাতারকার প্রতি এক অনুরাগীর ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর আবেগময় প্রার্থনা। লিখলেন বিশ্বদীপ দে।
হৃদিভাজনেষু
মেসি,
ঠিক এই মুহূর্তে কী ভাবছেন আপনি? জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনটির দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে? সোশ্যাল মিডিয়ায় জানিয়ে দিয়েছেন, ‘এস্তয় লিস্তো, ভামোস আর্জেন্টিনা।’ অর্থাৎ ‘আমি তৈরি। এগিয়ে চলো আর্জেন্টিনা।’ হ্যাঁ, আমরা জানি আপনি তৈরি। মনে মনে এমবাপেদের উড়িয়ে বিশ্বজয়ের নীল নকশা ছকেও ফেলেছেন। কিন্তু… এমন মহারণের আগে নানা ভাবনাচিন্তার ফুলকি মাথার ভিতরে ভেসে বেড়াবেই। মনে পড়ে যাবে নানা অপমান কিংবা সোনালি মুহূর্তের কথা। ভিতরে ভিতরে যা তাতিয়ে তুলবে আপনাকে। নাকি, এ নেহাতই আমাদের মতো ‘হরিপদ কেরানি’দের চিন্তা। আপনার মতো চ্যাম্পিয়নরা এমন চূড়ান্ত লড়াইয়ের আগে মাথাটাকে ডিপ ফ্রিজ বানিয়ে রেখে কেবল অপেক্ষা করেন মাঠে নামার?
কোনটা সত্য়ি তা আমাদের জানা নেই। যদি ধরা যায়, আপনি অনুশীলনের ফাঁকে মনে মনে নানা পুরনো কথা ভেবে চলেছেন, তাহলে হয়তো একেবারে সাম্প্রতিক একটি তারিখ আপনার মাথায় ভেসে উঠছে। দিনটা এবছরেরই ২২ নভেম্বর। দুর্বল সৌদির কাছে সেদিন হারতে হয়েছিল আপনার দলকে। আজকাল সোশ্যাল মিডিয়ায় মানুষের ধৈর্য খুব কম। চটজলদি তৈরি হয়ে গেল মিমের পর মিম। আপনারা গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নিতে চলেছেন, এমন ভবিষ্যদ্বাণীও করে ফেললেন অনেকে। কাঠগড়ায়, বলাই বাহুল্য আপনি। সেদিন নিশ্চয়ই মনে মনে আরও দৃঢ় হয়েছিল আপনার প্রতিজ্ঞা? এটা আপনার কেরিয়ারের পঞ্চম বিশ্বকাপ। অভিজ্ঞতার পরিপক্কতায় এখন আপনি এমন এক বিন্দুতে, যখন আত্মবিশ্বাসের পারদ তুমুল উচ্চতায় পৌঁছে গিয়েছে। যেখানে দাঁড়িয়ে সমস্ত সমালোচনাকে সরিয়ে কেবল ‘মাছের চোখে’র দিকেই তাকিয়ে থাকাই দস্তুর।
আচ্ছা, আপনার কি মনে পড়ছে ২০০৬ সালের সেই ম্যাচটার কথা? বার্লিনে সেদিন ‘চিরশত্রু’ জার্মানির বিরুদ্ধে টাইব্রেকারে হেরে গিয়েছিল আর্জেন্টিনা। আপনি সেদিন খেলেননি। সদ্য উনিশ পেরনো এক কিশোরকে না খেলিয়ে দীর্ঘদেহী জুলিও ক্রুজের উপরই ভরসা রেখেছিলেন কোচ। কে বলতে পারে আপনি খেললে ১৯৫৮ সালের বিশ্বকাপের পেলের মতো আপনিও সেই বয়সেই মহাতারকা হিসেবে উদ্ভূত হতেন না?
কিংবা ২০১০? সেবারের আর্জেন্টিনাকে নিয়ে উন্মাদনার শেষ ছিল না। একে তো শারীরিক সক্ষমতার চূড়ায় থাকা আপনি। অন্যদিকে কোচের ভূমিকায় দিয়েগো মারাদোনা। এই জুটিই কাপ জিতবে, এমন দাবি করতে শুরু করেছিলেন বিশেষজ্ঞরা। কিন্তু অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসে ভুগতে থাকা দিয়েগো এস্তেবান ক্যাম্বিয়াসো ও জাভিয়ের জেনেত্তিদের না খেলানোতে সব সম্ভাবনার অকালসমাধি হয়েছিল। কী হত যদি সেবারের বিশ্বকাপে ওঁরা থাকতেন? এই ৩৫-এ পৌঁছেও ‘সব পেয়েছে ঠিকই কিন্তু বিশ্বকাপ?’ এই কটাক্ষ হয়তো শুনতে হত না।
কিন্তু এই সব ‘যদি’র মধ্যে কি আদৌ আপনি কখনও থেকেছেন? ২০১৪ বিশ্বকাপের ফাইনালে গঞ্জালো হিগুয়েইন যদি অল্পের জন্য ফসকে যাওয়া গোলটা করে ফেলতে পারতেন তাহলেই যে বিশ্বসেরার শিরোপা নিশ্চিত ছিল, এমন সব ‘ইফ’, ‘বাট’কে গুরুত্ব দিতে আপনি হয়তো নারাজই। কেননা এই সব আপসোস বা হতাশাকে দূরে সরিয়ে না রাখতে পারলে কাতারের মাঠে নেমে ওই খেলা সম্ভব ছিল?
আপনি যে স্বভাবের, তাতে সব সময়ই সামনের দিকে তাকাতে চেয়েছেন। ভেবেছেন এবার হল না। পরের বার। কিন্তু যদি রবিবারের ম্যাচে শেষ হাসি হাসেন এমবাপেরা? আর নেইমার, রোনাল্ডোদের মতো শেষ পর্যন্ত চোখের জলেই মাঠ ছাড়তে হয় আপনাকে? তখনও কি আপনি ‘যদি’র কথা ভেবে বিচলিত হবেন না? কেরিয়ারের সায়াহ্নে পৌঁছে বিষণ্ণতাকে উড়িয়ে দেওয়া তখন কি সম্ভব হবেন?
বিশ্বাস করুন এসব নেহাতই নেগেটিভ চিন্তা। আপনার অনুরাগী হিসেবে এমন কথা আমরা কেউই ভাবতে চাই না। তবু, কথাগুলি যে মনের ভিতরে ভাসতে শুরু করেছে। আসলে একজন ফুটবলারের যত ধরনের স্বপ্ন থাকে, সবই ছুঁয়ে ফেলেছেন আপনি। সাত-সাত বার ব্যালন ডি’অর জেতা-সহ। কিন্তু ব্যক্তিগত ক্রীড়ানৈপুণ্যের সমান্তরালে আরও একটা চাহিদা যে থেকেই যায়। দেশকে বিশ্বসেরা করার। সেটা পারলেই স্বদেশীয় দিয়েগো নামের সেই ফুটবলারের ‘অলৌকিকত্বে’র ভাগীদারও হয়ে যাবেন আপনি। কিন্তু যদি না পারেন? বিশ্বাস করুন, তবুও আপনি জাদুকরই থেকে যাবেন।
ফ্রান্সকে হারিয়ে আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ের স্বপ্ন দেখছে সারা বিশ্বের আর্জেন্টিনার ফ্যানরা। কিন্তু সেই চূড়ান্ত লড়াইয়ের আগে এই কথাটুকু আপনি জেনে রাখুন। একটা ম্যাচের ফলাফল যতই অসীম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠুক না কেন, যতদিন ফুটবল খেলাটা বেঁচে থাকবে, আপনি থাকবেন। আপনি এমন একজন মানুষ, তাঁকে ঘৃণাই করা হোক কিংবা ভালোবাসায় ভরিয়ে দেওয়া হোক- উপেক্ষা করা যাবে না। উপেক্ষা করা যায় না। ডন ব্র্যাডম্যান জীবনের শেষ টেস্ট ইনিংসে একটা বাউন্ডারির জন্য একশো গড়ে পৌঁছতে পারেননি। কিন্তু আমরা জানি, তাঁর কৃতিত্বের গড় আসলে একশোই। তেমনই আপনার দেশ বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হতে পারুক বা না পারুক, আপনি থেকে যাবেন। এই নীল গ্রহের বুকে রোদ-বাতাসের মতোই চিরন্তন হয়ে।
ইতি
আপনার এক সামান্য অনুরাগী
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.