সৃঞ্জয় বোস, কাজান: প্রাতরাশ করতে করতে রাশিয়ার কয়েকটা দৈনিক ঘেঁটেঘুঁটে একটু দেখছিলাম। ইংরেজি কাগজ বলতে গেলে এখানে একটাই। মস্কো টাইমস। বাকি কাগজে বিশ্বকাপ নিয়ে কী লেখালিখি চলছে জানতে গেলে আপনাকে গুগল ট্রান্সলেটরের হাতে নিজেকে সমর্পণ করতে হবে। সবই তো রুশি ভাষায় লেখা! তা শুক্রবার সকালে সব ঘেঁটেঘুঁটে ফুটবল পাঠককে চমৎকৃত করে দেওয়ার মতো তিন-তিনটে খবর পেলাম।
১)সাম্প্রতিকে রাশিয়ার সিকিওরিটি কাউন্সিলের একটা বৈঠক হয়েছে। যে বৈঠকে স্বয়ং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনও ছিলেন। দেশজ নিরাপত্তা সংক্রান্ত ব্যাপারস্যাপার, আসন্ন রুশ-মার্কিন সামিট নিয়ে কথাবার্তা হয়েছে। যা স্বাভাবিক। কিন্তু বৈঠকে আরও একটা জিনিস হয়েছে। শনিবারের রাশিয়া বনাম ক্রোয়েশিয়া বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনাল নিয়ে আলোচনা! এবং বৈঠকে নাকি রুশ টিমকে গণ-শুভেচ্ছাও জানানো হয়েছে!
২)কাপ-কোয়ার্টার ফাইনালকে ঘিরে যুগান্তকারী একটা ঘোষণা করেছে ব্যাঙ্ক অব রাশিয়া। তারা বলেছে যে, ইগর আকিনফিভরা যদি দেশকে সেমিফাইনালে নিয়ে যেতে পারেন, তা হলে হাফ রুবেলের বিশেষ এক মুদ্রা তারা বাজারে ছাড়বে! টিমের কীর্তিকে সম্মান জানিয়ে।
৩)রুশ শহর ইয়ারোস্লাভে মিতায়া আর সলনিস্কো নামের দুই ‘বিদুষী’ ডলফিন আবিষ্কার হয়েছে। যারা আবার ভবিষ্যৎদ্রষ্টাও বটে! তা ডলফিন বাবাজিরা ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, রাশিয়া শুধু ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে জিতবে না। একেবারে ৩-১ গোলে জিতবে!
ব্রাজিল ম্যাচ কভার করতে যে শহরে এই মুহূর্তে আছি, সেই কাজান থেকে সোচির দূরত্বটা বিশাল। হাজার দু’য়েক কিলোমিটার মতো। গাড়ি ভাড়া—টাড়া করে বা ড্রাইভ করে যেতে গেলে সাতাশ থেকে আঠাশ ঘণ্টা লেগে যাবে। সোচির কথাটা এখানে তুললাম কারণ, শনিবার ওখানেই লুকা মদ্রিচ-ইভান রাকিটিচের ক্রোয়েশিয়ার সঙ্গে চেরিশেভের রাশিয়ার শেষ চারে ওঠার যুদ্ধ। ভেবেছিলাম, কাজানে ব্রাজিল ঢুকে গিয়েছে মানে সমর্থকের আর কোনও রং এখানে ঢুকতে পারবে না। চারদিক হলুদ আর হলুদে ছেয়ে থাকবে। আর ভাবব না-ই বা কেন? এই তো শুনলাম, যে ‘হেক্সা সাইকোপ্যাথ’ এক সাম্বা-ভক্ত দু’একদিন আগে নেট সেনসেশন হয়ে গিয়েছিলেন, খুঁজে পেতে বার হয়েছে মোটেই তিনি ব্রাজিলীয় নন। বরং জলজ্যান্ত এক রাশিয়ান, যিনি সাম্বা-প্রেমে মোহান্ধ! তা হলে?
মুশকিল হল, কাজানে চোখ ধাঁধানো হলুদ—ঔদ্ধত্য আছে, আছে সদম্ভে। কিন্তু একই সঙ্গে রাশিয়া নিয়ে অসম্ভব আশাবাদও আছে, নীরব সোচ্চারে। কাজানকে এমনিতে রাশিয়ার স্পোর্টিং ক্যাপিটাল বলে। বিশ্বকাপ উপলক্ষ্যে যে স্টেডিয়াম প্রথম তৈরি হয়েছিল, সেটা এটা। কাজানে। গত বছর কনফেডারেশনস কাপ ভেন্যু ছিল কাজান। এই স্টেডিয়াম আবার এখানকার প্রথম সারির ক্লাব টিম এফসি রুবিন কাজানের হোমগ্রাউন্ড। এদিন স্থানীয় রেস্তোরাঁ কর্মী, গাড়ির ‘শোফার’—এর সঙ্গে কথা বলতে বলতে মনে হল, এঁরা সবাই কেমন যেন ঘোরে ডুবে। দু’চোখে শেষ চার স্বপ্নের মায়াকাজল পরে ঘুরছেন। এঁরা বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, স্পেনকে বধ করে দেশ যখন কাপ কোয়ার্টার ফাইনাল খেলতে পারছে। তখন মদ্রিচদের ক্রোট-রণতরী ডুবিয়ে সেমিফাইনাল খেলা অবশ্যই সম্ভব। চলতি বিশ্বযুদ্ধে সবচেয়ে নীচু ব়্যাঙ্কিংয়ের টিম হয়েও পারলে, যা রুশ ফুটবল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ স্মারক হবে।
দুপুর—দুপুর কাজান মিডিয়া সেন্টারে ঢুকে বিশ্বাসটা আরও বদ্ধমূল হল। এবং এ হেন বিশ্বাসের কারণও পেয়ে গেলাম। নাম, দু’টো নাম। ইগর আকিনফিভ এবং আর্তন জিউবা।
প্রথম জন- স্পেনের বিরুদ্ধে টাইব্রেকারে পেনাল্টি সেভ করে আপাতত জাতীয় নায়ক। দ্বিতীয় জন- টিমের স্ট্রাইকার। স্পেনের বিরুদ্ধে নির্ধারিত সময়ে পেনাল্টি থেকে গোল করে এই মুহূর্তে জনতার সোনার সন্তান। আর দু’জনকে নিয়ে এক রুশ সাংবাদিকের থেকে যে গল্প শুনলাম, তা এ দেশে পা দেওয়া পর্যন্ত সেরা স্মৃতি-কোহিনুর। শুনলাম, সের্জিও ব়্যামোসদের বিরুদ্ধে টাইব্রেকারে আকিনফিভ জিতিয়ে দেওয়ার পর রাশিয়ার রাজপথে নাকি জনসমুদ্রে নেমে পড়ে অবিশ্বাস্য পাগলামি শুরু করে দিয়েছিল। কেউ কেউ চিৎকার করছিলেন, ‘ইগর, ইগর, আকিনফিভ, ইয়ে, ইয়ে’ বলে। যা আদতে অবরুদ্ধ উচ্ছ্বাসের অসংলগ্ন বহিঃপ্রকাশ ছাড়া আর কিছু নয়। একজন আবার শুনলাম, রাস্তায় টিভির লাইভ চলার সময় তাতে ঢুকে পড়ে বলে দিয়েছিলেন, “আমার স্ত্রী যদি এই মুহূর্তে আকিনফিভকে বিয়ে করতে চায়, কোনও অসুবিধে নেই! আমি হাসতে—হাসতে দু’জনের বিয়ে দিয়ে দেব!” এখানকার বড় পিৎজা কোম্পানি হল পাপা জন। তারা নাকি আগামী এক বছর আকিনফিভকে পিৎজা খাওয়াবে বলে ঠিক করেছে। বিনামূল্যে!
আসলে বিগত দশ-দশটা বছর সাফল্য-মরুভূমিতে কাটানোর পর আচমকা মরুদ্যানের সন্ধান পেলে, এ সব স্বাভাবিক। খুব স্বাভাবিক। আন্তর্জাতিক ফুটবলের উচ্চ মঞ্চে এর আগে রাশিয়ার স্মরণীয় সাফল্য ছিল, আজ থেকে দশ বছর আগে। ২০০৮ সালে। যে বার ইউরো কাপ সেমিফাইনালে উঠেছিল গাস হিডিঙ্কের রাশিয়া। কোচ হিসেবে গাস আজও প্রাতঃস্মরণীয়। কিন্তু ইউরো পরবর্তী সময়ে হিডিঙ্ক রুশ ফুটবলের দায়িত্ব ছেড়ে দেন, দেশজ ফুটবলের ‘স্পুটনিক’-ও তার পর ধীরে ধীরে অবলুপ্তির পথ নেয়। যা আজ, আবার রাতারাতি জেগে উঠেছে এই দু’য়ের হাতে-পায়ে। আকিনফিভের হাত, জিউবার পা।
অথচ এঁরা দু’জনই রুশ ফুটবলের ‘ব্যাডবয়’। বড় ম্যাচে আকিনফিভের কুৎসিত পারফরম্যান্স দেশে তাঁর বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ জনমত তৈরি করে দিয়েছিল। জিউবার সঙ্গে আবার কোচদের ঝগড়া-ঝামেলা নিত্য লেগে থাকত। ওই রুশ সাংবাদিকের কাছেই শুনলাম, গত তেরো বছর ধরে আকিনফিভ রাশিয়ার গোলপোস্টে দাঁড়াচ্ছেন। কিন্তু তাঁর বড় ম্যাচে ডোবানোর ‘বদরোগ’ দেখে এবার বিশ্বকাপের আগে ফুটবল-জনতার মধ্যে বলাবলি শুরু হয়েছিল সত্যিই আকিনফিভকে কিপার হিসেবে আর রাখা উচিত হবে কি না? ব্রাজিল বিশ্বকাপের প্রথম ম্যাচে এক দক্ষিণ কোরীয় ফুটবলারের লং রেঞ্জ শট বুঝতে না পেরে গোল খান। আলজিরিয়ার বিরুদ্ধে গ্রুপের শেষ ম্যাচে এবার ক্রস ধরতে ব্যর্থ-আন্দাজ, এবং ব্রাজিল বিশ্বকাপ থেকে রুশ বিদায়।
আকিনফিভের বিরুদ্ধে আওয়াজ ওঠা তখন থেকে শুরু। কিন্তু তাঁর চেয়ে ভাল কিপার দেশে আর ছিল না, আকিনফিভও তাই থেকে যান। তবে তাঁর ব্যাপারে দু’টো জিনিস আবিষ্কার করেছিলেন রুশ ফুটবলপ্রেমীরা। এক, একটা ম্যাচ খারাপ খেলে ‘পাপ’ করলে, পরেরটাতেই ‘প্রায়শ্চিত্ত’ করতে নেমে পড়েন। উদাহরণ- এবারের বিশ্বকাপে উরুগুয়ের বিরুদ্ধে তিন গোল খাওয়ার পর, ঠিক পরের ম্যাচেই তাঁর স্পেনের বিরুদ্ধে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠা। আর দ্বিতীয়ত, আকিনফিভের বিশুদ্ধ দেশপ্রেম। ফুটবল-জীবনে বিদেশের প্রচুর ক্লাব থেকে অফার পেয়েছেন আকিনফিভ। কিন্তু জীবনে যাননি। বারবার বরং বলেছেন, ‘আমার দেশের চার্চের পরিবেশ, বার্চ গাছ, আর কোন দেশে পাব?”
আকিনফিভ তবু কোথাও না কোথাও দেশজ সমর্থন তবু পেয়েছেন। কিন্তু জিউবা? তিনি তো চিরকালই লোকজনের চক্ষুশূল ছিলেন। জুবার ইউক্রেনীয় বাবা পুলিশ অফিসার ছিলেন। মা কাজ করতেন মুদির দোকানে। আর তিনি জিউবা- যে ক্লাবেই খেলতে যেতেন তুলকালাম বাঁধিয়ে ছাড়তেন!কোচের সঙ্গে লাগত। সমর্থকদের সঙ্গে লাগত। শোনা গেল, ছোটবেলায় যে ক্লাবে খেলতেন, সেই স্পার্টাক মস্কো ছেড়ে হঠাৎই জেনিট সেন্ট পিটার্সবার্গ চলে যান জিউবা। মাইনে নিয়ে অশান্তি করে। জেনিট সেন্ট পিটার্সবার্গে অর্থ পেয়েছিলেন তিনি, কিন্তু হারিয়েছিলেন পুরনো ক্লাবের সমর্থকদের সম্মান। গত বছর রাশিয়া কোচ স্ট্যানিস্লাভ চেরিশেভের সঙ্গে টিমের ট্রেনিং চলার সময় লাগে। পরিণতি- টিম থেকে বাদ। জেনিটেও তার পর থেকে দুঃসময় ঘনিয়ে আসতে থাকে। জেনিট কোচ রর্বাতো মানচিনির পছন্দ ছিল না জিউবাকে। প্রথমে রিজার্ভ বেঞ্চ, তার পর সোজা রিজার্ভ স্কোয়াডেই চলে যান রুশ স্ট্রাইকার। শেষ পর্যন্ত ক্লাব ছেড়ে লোনে যান আর্সেনাল টুলা নামের এক মধ্যবিত্ত ক্লাবে। যাদের উচ্চাশা নেই, নেই প্রত্যাশা। এবং ওখান থেকেই তাঁর প্রত্যাবর্তন শুরু। দশ ম্যাচে ছ’গোল করে। শুনলাম, বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগে জিউবা স্বদেশীয় সাংবাদিকদের বলেছেন, “আমার কিছু করার ছিল না। দেশে বিশ্বকাপ, জীবনে তো একবারই হবে, তাই না? আমি চেয়েছিলাম, টিমে ফিরতে।” ফিরেছেন জিউবা। ফেরার মতো ফিরেছেন। স্পেনের বিরুদ্ধে গোল করে নিজস্ব স্টাইলে সেলিব্রেশন উপহার দিয়েছেন কোচ চেরিশেভকে। যাঁকে তারপর দেখা গিয়েছে, আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়তে। ‘বিপথে’ যাওয়া সন্তানের সুমতি ফিরলে পিতার যা হয়! আর গোলকিপার আকিনফিভ? স্পেন ম্যাচ জেতানোর পর তাঁকে রুশ জনতা বলছে, ‘‘ওকেই প্রেসিডেন্ট করে দেওয়া হোক। আকিনফিভ প্রেসিডেন্ট!” শুনলে মনে হবে, ঠিকই আছে। এ দেশ আর করবেই বা কী? রাশিয়া এত দিন জানত, আকিনফিভ-জিউবা তাদের চিরকালীন দুঃখের ঠিকানা। রাশিয়া তো স্পেন ম্যাচের পর জানে, আকিনফিভ-জিউবা তার কাপ-স্বপ্নের ঠিকানা।
Ilya Kutepov says @TeamRussia are not settling for a quarter-final finish 💪
How far do YOU think #RUS can go at Russia 2018?#RUSCRO // #WorldCup pic.twitter.com/8PHTWhRpNu
— FIFA World Cup 🏆 (@FIFAWorldCup) 7 July 2018
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.