সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: নিস্তব্ধ কাজান এরিনা। যেন শ্মশানের নীরবতা। গ্যালারিতে সমর্থকরা ভাষা হারিয়েছেন। মাঠে শবযাত্রীদের মতো ঘুরে বেড়াচ্ছে নীল-সাদা জার্সিধারীরা। শোকস্তব্ধ সবাই। মাঝে একা ঘাসে হাঁটু গেড়ে বসে ফুটবল ঈশ্বর। গ্রেটেস্ট অফ অল টাইমের মাথা তখন ঘাসে ঠেকেছে। এবারও হল না! ৪টে বিশ্বকাপ চলে গেল। ফের অধরা রয়ে গেল সাধের সোনার পরী। এ যন্ত্রণা মৃত্যুশোকের থেকেও ভয়াবহ। পাথর হয়ে গিয়েছেন লিওনেল মেসি। তাঁর রূপকথার ফুটবল জীবনের এমন বেদনাদায়ক ইতি কীভাবে মেনে নেবে বিশ্ব? মহাভারতের কর্ণের মতো ট্র্যাজিক নায়কই রয়ে গেলেন তিনি। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ মাটিতে গেঁথে যাওয়া রথের চাকা তুলতে পারেননি অঙ্গরাজ। তেমনই বিশ্বকাপে দলকে একার কাঁধে উতরে দিতে ব্যর্থ হলেন দলনেতা মেসি। ফ্রান্সের কাছে হার যেন তাঁর অবসর ঘোষণার অলিখিত বার্তা দিয়ে গেল। বিশ্বকাপ আর হাতে উঠবে না মেসির। নট-আউট পর্বে গোলখরার অভিশাপ কাটল না আর্জেন্টাইন মহাতারকার।
কিন্তু ম্যাচ জিততে এদিন মরিয়া ছিল আর্জেন্টিনা। মরিয়া ছিলেন মেসিও। লেডিলাক হিসাবে রাশিয়া এসেছিলেন স্ত্রী আন্তোনেলা। তুকতাক মেনে বদলে যায় হেয়ারস্টাইলও। তারপরেও বিদায়। জার্মানির পর আরও একটা নক্ষত্রপতন। বিশ্বকাপের আকাশে আর নেই আর্জেন্টিনা। তুকতাক নাকি শুধু নেমারই বিশ্বাস করেন। কিন্তু আসল সত্য তা নয়। এ ব্যাপারে সিদ্ধহস্ত মেসিও। নাইজেরিয়া ম্যাচের আগে একজন আর্জেন্টাইন সাংবাদিক তাঁর মা’র পাঠানো রিবন তুলে দিয়েছিলেন মেসির হাতে। সঙ্গে সঙ্গে তা নিয়ে ডান পায়ে বেঁধে ফেলেছিলেন মেসি। পরের দিন নাইজেরিয়া বধের পর যখন মিক্সড জোনে সাংবাদিকটির সঙ্গে দেখা, ডান পায়ের মোজা নামিয়ে রিবনটা দেখিয়েছিলেন। এদিন তো ফ্রান্সের বিরুদ্ধে খেলার আগে নাকি সেলুনে ছুটেছিলেন। সবার আগে বদলে ফেলেন হেয়ারস্টাইল। যদি ভাল কিছু হয়। কিন্তু কোন জাদুবলে বদলে ফেলবেন দলের ‘কুখ্যাত’ ড্রেসিংরুম! আর কোনও উপায় না দেখে বার্সোলোনায় থাকা অ্যান্তোনেলাকে ফোনটা নাকি করেছিলেন মেসি। বলেছিলেন, “চলে এসো ফ্রান্স ম্যাচের আগেই।”
স্ত্রী এল। মেসি চুলও কাটালেন। তবুও বাঁচল না আর্জেন্টিনা। বাঁচল না মেসির অধরা স্বপ্ন। এদিন থেকে ফের বিশ্বকাপহীনদের তালিকায় নাম লেখালেন তিনি। চার বছর পর কাতার বিশ্বকাপে তাঁকে দেখা যাবে কি না, তা নিয়েই শুরু হয়ে গিয়েছে প্রবল বিতর্ক। কিছুদিন আগে মেসি বলেছেন, যতদিন না বিশ্বকাপ জিতবেন, জাতীয় দলের হয়ে খেলা চালিয়ে যাবেন। কিন্তু যা গতিপ্রকৃতি তাতে হলফ করে বলাই যায়, এটাই দেশের জার্সি গায়ে বিশ্বকাপে শেষ ম্যাচ ছিল মেসির। ম্যাচ শেষে স্টেডিয়াম চুপ। এমন চুপকে শ্মশানস্তব্ধতা ছাড়া কিছু বলা চলে কি? বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি ফ্যানদের ভেঙে পড়ার দিন এটি। প্রতিটি মেসির সমর্থক আজ ভিতরে ভিতরে নিশ্চিত নীরব হয়ে আছেন।
কলকাতায় যেরকম ইস্টবেঙ্গল-মোহনবাগান খেলা হলে আলাদা-আলাদা গ্যালারি। বিশ্বকাপে সেরকম নয়। আর্জেন্টিনা-ফ্রান্স সবাই মিলেমিশে একাকার। একদিন রাশিয়ায় যে গানটা ক্রমান্বয়ে শোনা যাচ্ছে সেই মেসি… মারাদোনা… নিয়ে প্রথম থেকে স্টেডিয়াম মাতিয়ে রাখলেন আর্জেন্টাইনরা। ফরাসিরা তখন যেন কোণঠাসা। শুরুতে গ্রিজম্যানের পেনাল্টিতে গোল খাওয়ার পরেও স্টেডিয়াম জুড়ে শুধুই নীল-সাদা জার্সির উত্তোলন। এদিন আবার মাঠে একা আসেননি মারাদোনা। নাইজেরিয়া ম্যাচে মাত্রাতিরিক্ত উত্তেজনা প্রকাশের পর ফিফার তরফে সতর্কবাণী আসতে অনেকটাই তিনি চুপ। মাঠের দু’পাশের দু’টো বিশাল জায়ান্ট স্ক্রিনে যা দেখা গেল, তাতে মারাদোনা এসেছেন নতুন বান্ধবীকে নিয়ে। যাঁকে নিয়ে কিছুদিন আগে কলকাতাতেও এসেছিলেন তিনি। বান্ধবীর গায়ে নীল-সাদা আর্জেন্টাইন জার্সি। মারাদোনা নিজেও পরে আছেন নীল রঙের টি-শার্ট। যে কয়েকবার দেখা গেল, চুপচাপ বসে আছেন নিজের সিটে। কিন্তু প্যারিস সাঁ জাঁ-তে নেইমারের সতীর্থ আদ্যন্ত ক্রিশ্চিয়ানো রোনাল্ডোর ভক্ত এমবাপে যে এভাবে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ থেকেই বিদায় করিয়ে দেবেন, সত্যিই কল্পনার অতীত।
I’m not trying to defend anyone here and don’t question my madridismo. What I’m trying to say is Lionel Messi played well and there is nothing he could do when his team concedes 4 goals in a knock out game. He’s living LEGEND and there is nothing you can do about it #FRAARG pic.twitter.com/4k67UFBrod
— KroosT8 (@KroosT8) June 30, 2018
প্যারিসে জন্মালেও এমবাপের বাবা ক্যামেরুনের। যিনি আবার একজন ফুটবল কোচ শুধু নন, ছেলের এজেন্টও। মা আবার আলজেরিয়ার প্রাক্তন হ্যান্ডবল খেলোয়াড়। জাতীয় দলের হয়ে মাত্র ১৮টা ম্যাচ খেলেই এমবাপে এই মুহূর্তে ফ্রান্সে এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন যে, অনেকে এখনই অঁরির সঙ্গে তুলনা শুরু করে দিয়েছেন। ডি’মারিয়ার গোলে ম্যাচে ফেরার পরেও এদিন কেমন যেন নিষ্প্রভই থেকে গেলেন মেসি। নাইজেরিয়া ম্যাচের সেই ড্রিবলটাই নেই। কাবায়েরোকে বসিয়ে আরমানিকে গোলে খেলানোর জন্য সাম্পাওলির বিরুদ্ধে কম সওয়াল করেননি তিনি। বলতে গেলে তাঁর এবং মাসচারেনোর চাপেই গোলে দাঁড়িয়েছেন কলম্বিয়ার বাজপাখি। কিন্তু এমবাপের বাঁ পায়ের শটে যেভাবে গোলটা খেলেন, সেখানেই সব শেষ। এমনকী, সাম্পাওলির সঙ্গে আলোচনা করে ফলস নাইনে খেলার সিদ্ধান্তটাও তো তাঁর।
এই ম্যাচের পর সাম্পাওলির দীর্ঘ চুক্তি আর থাকবে কি না কেউ জানে না। নয়া কোচ হিসাবে ভেসে উঠছে প্রাক্তন বিশ্বকাপার বুরুচাগার নাম। এদিনই আবার ম্যাচ হেরে দেশের জার্সি তুলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন জাভিয়ের মাসচেরানো। আন্তর্জাতিক ফুটবল থেকে অবসর ঘোষণা করলেন প্রাক্তন অধিনায়ক। কিন্তু কী করবেন আর্জেন্টিনার নতুন ফুটবল ঈশ্বর? আর পরবেন নীল-সাদা জার্সি? নাকি বিশ্ব ফুটবলের সেই ট্র্যাজিক হিরো হয়েই থেকে গেলেন ইউসেবিওদের দলে? যাঁর নামের পাশে থাকবে, দুরন্ত ফুটবলার, কিন্তু বিশ্বকাপ পাননি কখনও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.