ট্রফি হাতে সুনীল ছেত্রী ও কুয়াদ্রাত। ইস্টবেঙ্গলের বর্তমান কোচের হাতে তখন বেঙ্গালুরুর রিমোট কন্ট্রোল ছিল।
খুব কাছ থেকে দেখেছেন এখনকার সময়ের সেরা মহাতারকাকে। দলকে চ্যাম্পিয়নও করেছেন কিংবদন্তির সঙ্গে যুগলবন্দিতে। তারপর বয়ে গিয়েছে বহু জল। বিদায়বেলায় ভারতীয় ফুটবলের মহীরূহ সুনীল ছেত্রী। বৃহস্পতিবার যুবভারতী স্টেডিয়ামে কেরিয়ারের শেষ ম্যাচ খেলতে নামছেন তিনি। প্রাক্তন শিষ্যের প্রস্থান লগ্নে মন কেমনের চাদর জড়িয়ে রয়েছেন সুদূর স্পেনে বসে থাকা কার্লেস কুয়াদ্রাত-ও (Carles Cuadrat)। সেই বেঙ্গালুরু-পর্বের সময় থেকেই হাতের তালুর মতো চেনেন ভারতীয় ফুটবলের পোস্টার বয়কে। তারপর ভারতের মাটিতে প্রতিপক্ষ দলের হয়েও সামলাতে হয়েছে ক্যাপ্টেন সুনীলকে। শিষ্যের বিদায়বেলায় ইস্টবেঙ্গলের ‘প্রফেসর’ কার্লেস কুয়াদ্রাত একবুক শুভেচ্ছা জানাচ্ছেন ভারত অধিনায়ককে। শুনলেন কৃশানু মজুমদার।
যুবভারতীতে শেষবারের মতো ভারতের জার্সিতে খেলতে নামছেন সুনীল ছেত্রী। বেঙ্গালুরুতে আপনার কোচিংয়েই খেলেছেন সুনীল। অনেক মুহূর্ত নিশ্চয় আপনার মনে পড়ছে। খুব কাছ থেকে দেখেছেন সুনীলকে। সেই কারণেই কৌতূহলী হয়ে প্রশ্ন রাখছি, কীভাবে আপনি ব্যাখ্যা করবেন দেশের সেরা ফুটবলারকে?
কুয়াদ্রাত: সর্বোচ্চ মাপের একজন পেশাদার। নিজেকে নিংড়ে নেওয়ার সেরা দৃষ্টান্ত সুনীল ছেত্রী (Sunil Chhetri)। সব ভারতীয় ফুটবলারের সামনে লড়াকু মনেভাবের প্রতিভূ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছে। ফুটবলার হিসেবে সুনীল ছেত্রী অনন্য।
বেঙ্গালুরুতে আপনি ছিলেন দ্রোণাচার্য। সুনীল ছেত্রী ছিলেন আপনার শিষ্য। আইএসএল চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন আপনারা। কোচ হিসেবে সুনীলকে সামলানো কি কঠিন? নাকি সহজ? আপনার অভিজ্ঞতা যদি শেয়ার করেন।
কুয়াদ্রাত: অত্যন্ত দায়িত্ববান অধিনায়ক। নিজের চেয়ে দলের প্রয়োজনকে সবসময়ে এগিয়ে রাখে। সবসময়ে দৌড়চ্ছে, ছুটছে, জিমে ঘাম ঝরাচ্ছে। টিম মিটিংয়ে উপস্থিত থাকছে। সত্যিই সতীর্থদের সামনে নিজেকে আদর্শ হিসেবে তুলে ধরেছে। রোল মডেল করার মতোই একজন ব্যক্তিত্ব।
প্রতিপক্ষ কোচ হিসেবেও সুনীল ছেত্রীর বিরুদ্ধে নেমেছেন আপনি। সুনীল ছেত্রীকে শান্ত রাখা কতটা কঠিন? আইএসএলে আপনার দল ইস্টবেঙ্গলের বিরুদ্ধে ডাইভ দিয়ে সুনীল পেনাল্টি আদায় করে নিয়েছিলেন বলে আজও অভিযোগ করেন অনেক লাল-হলুদ সমর্থক। আপনি কী বলবেন?
কুয়াদ্রাত: চতুর, বুদ্ধিমান ফুটবলাররা টিমের জন্য কত কী-ই না করে। পাল্লা দেওয়ার মেজাজের অধিকারী। লড়াকু মানসিকতার ফুটবলার। তবে ম্যাচের সময় মাঠে কোনও আচরণ ঠিক না ভুল, সেটা যাচাই করা রেফারির কাজ। ওটা আমার কাজ নয়।
গত কয়েকবছরে পেনাল্টি শট নেওয়ার ক্ষেত্রে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন সুনীল ছেত্রী। এক স্টেপে পেনাল্টি মারেন। আপনারও নিশ্চয় নজর এড়ায়নি।
কুয়াদ্রাত: কখনও কখনও প্লেয়াররা পেনাল্টি মারার সময় নিজের ভাবনা বদলায়। সেটা বুঝি। অনুশীলনে এত ভিডিও বিশ্লেষণ, এতরকম ভাবে প্লেয়ারকে কাটাছেঁড়া করা হচ্ছে। ভিডিও অ্যানালিসিস করে খেলোয়াড়দের বোঝানো হচ্ছে। আপনাকেও ফুটবলার হিসাবে নিজস্ব মূল্যায়ন করতে হবে, নিজেকে বিশ্লেষণ করতে হবে। একেবারে নিখুঁত হওয়ার চেষ্টায় আপনাকেও সঠিক রাস্তা খুঁজে নিতে হবে। সুনীলও নিজেকে বদলে ফেলেছে। নিত্যনতুন উপায় বের করেছে।
আপনি কি মনে করেন দেশের জার্সিতেই সুনীল ছেত্রীর সেরাটা পাওয়া যায়? নাকি যে কোনও জার্সি পিঠে চাপিয়েই আলো ছড়াতে পারেন?
কুয়াদ্রাত: যে কোনও জার্সিতে সবটা দেয় সুনীল। বড় মাপের চ্যাম্পিয়ন, স্টারদের সেই বৈশিষ্ট্যই থাকে। অবসর নেওয়ার পরও হয়তো প্রেস মিডিয়া, জনতার দৃষ্টির আড়ালে বন্ধুত্বপূর্ণ পিং-পং ম্যাচেও আপনাকে জেতানোর জন্য যা যা করতে হয়, সুনীল সবটাই করবে। জয়ীরা এমনই হয়। চ্যাম্পিয়নরা এরকমই।
সুনীল ছেত্রী যদি স্পেন বা ইউরোপের কোনও দেশে জন্মাতেন, তাহলে তাঁর পারফরম্যান্স তো আরও ভালো হত। আরও ক্ষুরধার হতো সুনীলের খেলা।
কুয়াদ্রাত:প্রশ্নটা ঠিকঠাক হল না। পরিস্থিতি, প্রেক্ষাপট আপনাকে একটা না একটা স্তরে নিয়ে যায়। কী হতে পারত, তা নিয়ে সঠিক ধারণা পাওয়া কখনওই সম্ভব নয়। আসল ঘটনা হল, সুনীল আমেরিকা, পর্তুগালে খেলার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সে সব জায়গায় সব কিছু ওর জন্য ঠিকঠাক হয়নি।
বুটজোড়া তুলে রাখছেন সুনীল। আরেক জন সুনীল ছেত্রী কি পাওয়া সম্ভব?
কুয়াদ্রাত: আরেকটা সুনীল ছেত্রী আর হবে না। প্রত্যাশা করাও ঠিক নয়। ভারতীয় ফুটবল কোনও প্লেয়ারের ওপর সেই চাপ দেয়ওনি। শুধু একেবারে তৃণমূল স্তরে প্লেয়ারদের বেড়ে ওঠার সুযোগসুবিধা দিন। সময় দক্ষ ফুটবলার দেবে, কিন্তু ‘আরেকটা সুনীল চাই’-এটা লক্ষ্য হওয়া উচিত নয়। মনে পড়ছে, আর্জেন্তিনায় খুব প্রতিশ্রুতিমান, তরুণ ফুটবলারদের দেখলেই তাঁদের ‘নতুন মারাদোনা’ বলে ডাকাডাকি শুরু হয়ে যেত। আচমকাই বছর কুড়ি বাদে মেসির উদয় হল, তখন ওকে ‘নয়া মারাদোনা’ বলতে লাগল অনেকে। কিন্তু সেটা ভুলে যান। মেসি মেসিই। একজনই হবে। তাই ভারতের আরেকটা সুনীল ছেত্রী খোঁজার প্রয়োজন নেই। শুধু ফুটবলার তৈরির জন্য পরিশ্রম করতে হবে। যেমনটা এখন আইএসএলে হচ্ছে।
একসময়ে আপনি সুনীল ছেত্রীর কোচ ছিলেন। শেষ ম্যাচে নামার আগে সুনীলের জন্য আপনার কি বার্তা? আপনার পরামর্শই বা কী?
কুয়াদ্রাত:ওকে জ্ঞান দেওয়ার আমি কেউ নই। জানি দেশের জন্য একশো শতাংশ দেবে সুনীল। সবচেয়ে সুন্দর ভাবে ওকে বিদায় সংবর্ধনা দেওয়া হোক, এটাই চাইব, যাতে পরের বিশ্বকাপ ফুটবলের কোয়ালিফায়িং পর্যায়ে উতরে যাওয়ার পথ সুগম হয়।
দেশের জার্সিতে, ক্লাবের হয়ে অসংখ্য গোল রয়েছে সুনীল ছেত্রীর। কোন গোল আপনার কাছে স্মরণীয়?
কুয়াদ্রাত: বেঙ্গালুরু এফসির সময়ে, জোহর দারুলের বিরুদ্ধে কান্তিরাভার সেমিফাইনালে সুনীলের করা গোল ভীষণ দামী ছিল। কারণ এএফসি কাপের ফাইনালে ওঠার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছিল সুনীলের ওই গোল। বিএফসির ইতিহাসে সবচেয়ে সুখের মুহূর্তগুলির অন্যতম। এশিয়ান ফুটবলে জোহর দারুলের শক্তি সকলেই জানত। ওদের সামনে দিয়ে ফাইনালে যাওয়াটা বিরাট সাফল্যই বটে।
আপনি কিছু বলতে চান সুনীল ছেত্রীকে নিয়ে?
কুয়াদ্রাত: শেষ ইস্টবেঙ্গল-বিএফসি ম্যাচের কথা বলি। দুটো টিম প্লে অফে পৌঁছনোর দৌড়ে। হারা টিমকে ছিটকে যেতে হবে। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ ২-১ গোলে জিতল ইস্টবেঙ্গল। ম্যাচটা ঘিরে প্রবল টেনশন ছিল। করিডরে সুনীলের সঙ্গে দেখা। দুজনে দুজনকে জড়িয়ে ধরলাম। সুনীল দুটো কথা বলল। আপনার বাড়ির খবর কী? সবাই ভালো আছে তো?
কোচ আপনাকে ভালবাসি। এই হল সুনীল ছেত্রী। সবসময় আবেগে ভাসে। মাঠের ভিতরে ও বাইরে দারুণ ব্যবহার। সত্যিকারের লড়াকু প্লেয়ারই বটে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.