বিশ্বদীপ দে: গোটা ইডেন (Eden Gardens) তখন ফুঁসছে। এ কী করে সম্ভব! একে ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ। তায় এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের গুরুত্বপূর্ণ লড়াই। তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ প্রথম ইনিংসে নবাগত শোয়েব আখতারের বলে তিনি ফিরে গিয়েছেন প্রথম বলেই। ক্রিকেটীয় পরিভাষায় যাকে বলে ‘গোল্ডেন ডাক’। দ্বিতীয় ইনিংসে বড় টার্গেট। এই সময়টাই তো তাঁর ব্যাটে চাই বড় ইনিংস। সেই সঙ্গে শোয়েবের সঙ্গে ব্যক্তিগত ডুয়েলে জয়। কিন্তু আচমকাই রান আউট হয়ে যেতে হয়েছে শচীন তেন্ডুলকরকে (Sachin Tendulkar)। তাও শোয়েবের কনুইয়ের সঙ্গে ধাক্কা লেগে! স্টেডিয়াম জুড়ে তখন চিৎকার। খেলা চালানোই দায়। এই সময়ই তিনি বেরিয়ে এলেন প্যাভিলিয়ন থেকে। স্রেফ হাত দেখালেন। হেঁটে গেলেন গ্যালারি ভরতি মানুষের সামনে দিয়ে। আর ধীরে ধীরে শান্ত হতে শুরু করল চারপাশ।
হ্য়াঁ, উত্তেজনা পরেও হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত ম্যাচ শেষ করতে হয়েছিল ফাঁকা স্টেডিয়ামে। কিন্তু সেদিন সেই উত্তেজক মুহূর্তেও উত্তপ্ত জনতাকে শান্ত হতে বাধ্য করেছিল ‘ক্রিকেট ঈশ্বরে’র উপস্থিতি। শচীন তেন্ডুলকরের আরজিকে অগ্রাহ্য করার ক্ষমতা হয়নি কারও।
এমনই ছিল তাঁর ক্যারিশমা। রবিবার তিনি পেরিয়ে গেলেন ৪৮। ছুঁলেন ৪৯। দেখতে দেখতে প্রায় বছর পঞ্চাশের মধ্যবয়স্ক হয়ে গেলেন লিটল মাস্টারও। এদেশের উত্তপ্ত গ্যালারিকে চুপ করাতে ক্রিকেট মাঠে তাঁর চেয়ে দীর্ঘ ছায়ার সন্ধান আজও অধরা। আজকের বিরাট (Virat Kohli), রোহিতদের (Rohit Sharma) আমলেও ভারতের ক্রিকেট ঈশ্বরের নাম শচীন তেন্ডুলকরই।
আর এখানেই আশ্চর্য লাগে। গ্রেট ক্রিকেটার তো কম দেখেনি ভারত। সেই লালা অমরনাথ, বিজয় হাজারেদের সময় থেকে ধরলে বহু নামই উঠে আসবে। পরে ১৯৭১ সালে এলেন সুনীল গাভাসকর। আবির্ভাবেই ক্যারিবিয়ানদের বিরুদ্ধে তাদেরই মাটিতে ৭৭৪ রান। গড় দেড়শোর উপরে! সেই শুরু। ১৯৭৮ সালে অভিষেক হয় কপিলের। এই দু’জন যে কেবল নিজেদের ব্যক্তিগত কীর্তিতেই মহীয়ান হয়ে উঠলেন তা তো নয়। তাঁদের নেতৃত্বে ভারতও ধীরে ধীরে বিশ্বক্রিকেটের এক অন্যতম শক্তি হয়ে উঠল।
এরপরই অভিষেক শচীনের। পরবর্তী সময়ে সৌরভ-রাহুল-লক্ষ্মণ-শেহওয়াগ-ধোনি। তারও পরে রোহিত-বিরাট। বোলিংয়ে অনিল কুম্বলেরা। ক্রিকেট আইকনের তালিকা যথেষ্ট দীর্ঘ। কিন্তু শেষ পর্যন্ত ভারতীয় ক্রিকেটে ঈশ্বরপ্রতিম বলতে সবচেয়ে আগে যে নামটা মনে পড়বে তিনি শচীনই।
অবসর নিয়েছিলেন ২০১৩ সালের নভেম্বরে। সময়ের হিসেবে পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় সাড়ে আট বছর। তবু আজও কোনও ক্রিকেট মাঠে তাঁকে দেখা গেলে জনতা উল্লসিত হয়ে স্লোগান দিতে থাকে ‘শচীন শচীন’ বলে। আসলে কেবল পরিসংখ্যানই শচীনকে মহান করে তুলেছিল তা নয়। তাঁর উপস্থিতির মধ্যে ছিল একটা অন্যরকম ম্যাজিক। একটা বিজ্ঞাপন ছিল, যেখানে দেখা যেত শচীন মাঠে নামলেই চারপাশ কার্যত ‘ফ্রিজ’ হয়ে যাচ্ছে। সময় যেন থমকে যাচ্ছে। সব ব্যস্ততা, ডেডলাইনের চক্করকে অবহেলায় পাশে সরিয়ে রেখে মানুষের চোখ তখন টিভির পর্দায়। আবার শচীন দ্রুত ফিরলেই সেই টিভি বন্ধ হতেও সময় নিত না।
এখানেই শচীন অনন্য। ক্রিকেট খেলাটার উপরে তাঁর প্রভাব যেন ‘লার্জার দ্যান লাইফ’। জীবনের চেয়েও বড়। তা হয়ে উঠছে এমন এক আশ্রয়, যা বাইশ গজের চৌহদ্দিকেও ছাপিয়ে যায়। আর তাই শচীন রান পেলে তা মনে মনে নিজের রান হিসেবে ধরে নিত তাঁর অগণিত ভক্তকুল। তাঁর ব্যর্থতাকে ধরে নিত নিজের ব্যর্থতা হিসেবে। কমবেশি বাকি আইকনদের ক্ষেত্রেও তেমন হয় ঠিকই। কিন্তু শচীনের ক্ষেত্রে তাঁর সাফল্য যেভাবে কোটি কোটি মানুষের ‘ফিক্সড ডিপোজিট’ হয়ে উঠত, তেমনটা আর কারও ক্ষেত্রে নয়।
এই মুহূর্তে সব ধরনের ক্রিকেট মিলিয়ে বিরাট কোহলির শতরান সত্তরটি। গত প্রায় আড়াই বছর তিন অঙ্কের রান পাননি তিনি। শেষ দুই আইপিএল ম্যাচে করেছেন শূন্য। কিন্তু অফ ফর্মের এই ঘূর্ণিকে কাটিয়ে উঠতে পারলে এখনও তাঁর সামনে অনেক সময় রয়েছে। শচীনের একশো সেঞ্চুরির রেকর্ডকে ভেঙে নয়া কীর্তি গড়তেই পারেন ভারতীয় ক্রিকেটের ‘অ্যাংরি ম্যান’। কিন্তু তাঁর আগ্রাসন, স্লেজিংয়ের বদলা স্লেজিংয়ের মস্তানির টিআরপি যতই ‘হাই’ হোক, খেলাটার উপরে নিজের প্রভাব বিস্তারে শচীনকে টপকে যাওয়া বোধহয় তাঁর হবে না। খেলা ছাড়ার প্রায় এক দশক পেরিয়েও শচীনের যে জাদু, তাকে টিকিয়ে রাখতে গেলে কেবল রানের পাহাড় গড়াই যথেষ্ট নয়। দরকার এক ‘এক্স ফ্যাক্টরের’। যা আর পাওয়া যায়নি। তাই শচীন রয়ে গিয়েছেন অবিকল্প। অতুলনীয়। অবসরের পরেও তাঁর ইনিংস শেষ হয়নি। তিনি আজও অপরাজিত। নতুন করে গার্ড নিচ্ছেন লেগস্টাম্পে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.