সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল ডেস্ক: রাজার বাড়ির দেওয়াল ভেঙে পড়ে গিয়েছে। দোষ কার? ধরে আনার বদলে বেঁধে আনা হল রাজমিস্ত্রিকে। কিন্তু সুরকি খারাপ, মিস্ত্রি কী করবেন? সেই যুক্তিতেই একে-একে বাদ গেলেন সুরকিওয়ালা, কুমোর, স্যাকরা, মুক্তোওয়ালারা। শেষ পর্যন্ত দোষী সাব্যস্ত হল সমুদ্রের গহ্বরে লুকিয়ে থাকা মুক্তো। তাকে তো আর শাস্তি দেওয়া যায় না! মাথা চুলকে রাজা ছেড়ে দিলেন সবাইকেই। দেওয়াল ভাঙার কোনও বিচারই হল না।
কার দোষ? শতবর্ষ পূর্বে সুকুমার রায় এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজেছিলেন। আর একশো বছর পরেও তার উত্তর মেলেনি। চারপাশে তাকিয়ে যে সমস্যাই চোখে পড়ুক না কেন, অনুসন্ধিৎসু মন খুঁজে বেড়ায় প্রকৃত অপরাধীকে। আর প্রতিবারই হাতে পড়ে থাকে পেনসিল। সমুদ্রের অতল থেকে মুক্তোর খোঁজ পাওয়ার সাধনা ভুলে, প্রশ্নের পর প্রশ্নের গোলকধাঁধায় হারিয়ে যেতে হয়। তা সে রাজনীতি হোক বা খেলা। ঠিক এই প্রশ্নটাই বোধহয় এখন ঘুরে বেরচ্ছে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স (Mumbai Indians) সমর্থকদের মনে। লিগ টেবিলে পড়ে আছে নয় নম্বরে। আইপিএলের (IPL) প্লে অফ থেকে বিদায় শুধু সময়ের অপেক্ষা। মুম্বই ভক্তরা প্রশ্ন তুলতেই পারেন, চলতি মরশুমে দলের চূড়ান্ত ব্যর্থতার দোষ কার?
একটা সহজ উত্তর অবশ্যই রয়েছে সকলের কাছে। ওই ‘পেনসিল’-এর মতোই সহজলভ্য উত্তর। তাঁর নাম হার্দিক পাণ্ডিয়া (Hardik Pandya)। দলের অধিনায়ক যখন দোষ তো বহন করতেই হবে। তাছাড়া এখন তিনি সহজ টার্গেট। ব্যাটে রান নেই, বোলিংয়ের অবস্থাও তথৈবচ। অবশ্য মাঠের পারফরম্যান্স দিয়ে তাঁকে ততটা বিচার করা হচ্ছে না। অনায়াস রিফ্লেক্সে মনে পড়বে রোহিতকে সরিয়ে তাঁর অধিনায়ক হওয়ার গল্প। যত আলোচনা আর বিতর্ক হয়েছে এই একটি ঘটনা নিয়ে, ততটা ধৈর্য্য নিয়ে যদি সমস্যার আরব সাগরের তলদেশ খোঁজা যেত তাহলে হয়তো মুক্তো মিলেও যেত।
মুক্তো কিন্তু মুম্বইয়ের কাছে ছিল। একাধিক রত্নসম্ভার প্রতিবারই থাকে আম্বানিদের দলে। রোহিত শর্মা, সূর্যকুমার যাদব, জশপ্রীত বুমরাহ থাকতেও তাঁরা ফের নিয়ে এলেন হার্দিক পাণ্ডিয়াকে। শুধু গুজরাট টাইটান্স থেকে মহাসমারোহে তাঁকে ফিরিয়ে এনেই কাজ শেষ হল না। মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের সিংহাসনে অভিষেকও ঘটল তাঁর। কেন সেই সিদ্ধান্ত? মরশুমের শুরুতে টিম ম্যানেজমেন্ট থেকে একটা উত্তর দিয়েছিল বটে, তবে তাতে গলে যাননি সমর্থকরা। দল অধিনায়ক হিসেবে নতুন মুখ খুঁজছে, রোহিতের পর তাঁরা বিশ্বস্ত হাতে দলের ব্যাটন তুলে দিতে চান এই ছিল যুক্তি। তাই চিত্রনাট্যে ‘আবার সে আসিছে ফিরিয়া’।
কিন্তু হার্দিকই কেন? গুজরাট টাইটান্সে তাঁর সাফল্য নিঃসন্দেহে তাঁর হয়ে কথা বলবে। শুধু ক্রিকেটীয় যুক্তিতে এর থেকে বেশি উত্তর আছে বলে মনে হয় না। তবে প্রশ্ন অন্য জায়গায়। বুমরাহ ছিলেন, সূর্যকুমার ছিলেন। হার্দিক দল ছাড়ার পর তাঁরাই ভরসা জুগিয়েছেন। তাঁরা কি আরও যোগ্য ছিলেন না? আইপিএলের মতো কোটি কোটি টাকার ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগেও তাঁদের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন থাকা উচিত নয়। সেই ন্যূনতম সম্মানটুকুও পেলেন না তাঁরা। দল হিসেবে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স গোড়ায় গলদ করে ফেলল এখানেই। বাইরে থেকে ঝাঁ-চকচকে রং করা হল, কিন্তু দেওয়ালের ভিতরটাই রয়ে গেল ভঙ্গুর। এবার সেই দেওয়াল ভেঙে গেলে ‘কার দোষ’, ‘কার দোষ’ বলে চিৎকার করে লাভ আছে কি?
অধিনায়ক হিসেবে যে এবার হার্দিক ব্যর্থ, তা নিয়ে কোনও সংশয় নেই। অলরাউন্ডার হার্দিকও যেন কোনও দূর গ্রহের ছায়া। বিশ্বকাপের মঞ্চে চোট পেয়েছিলেন। তার পর আর ফর্মে ফেরার লক্ষণ দেখা যায়নি। অথচ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ১৫ জনের দলে ঠিক জায়গা পেয়ে গিয়েছেন। নির্বাচকদের যুক্তি, তাঁর কোনও বিকল্প নেই। যে দেশের লিগে প্রতি বছর নতুন নতুন তারকার জন্ম হয়, সেখানে যদি হার্দিকের বিকল্প না থাকে সেটা অবশ্যই চিন্তার বিষয়। মুম্বই শিবিরেরও কি একই যুক্তি? তাঁদের কাছে উঠতি তারকা তিলক বর্মা ছিলেন। তাঁকে কি তুলে ধরা যেত না মুম্বইয়ের নতুন অলরাউন্ডার হিসেবে? এবারও তিনি বিপদের সময়ে যোগ্যতার পরিচয় দিয়েছেন। অথচ হার্দিক বিতর্কের বর্ণচ্ছটায় যেন ঢাকা পড়ে যাচ্ছে তিলকের অলরাউন্ডার প্রতিভা।
সব মিলিয়ে মরশুম শুরু থেকে শেষের আগে পর্যন্ত, আলোচনার শীর্ষে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স। প্রতিবার থাকে ক্রিকেটীয় কারণে, এবার মাঠের বাইরের বিতর্কের জন্য। বাইশ গজে কোনও ভাবেই মনে হয়নি, দলটা একসুতোয় গাঁথা। ছোট ছোট বিষয় আড়ে-বহরে বেড়েছে। যার ফল দেখা গিয়েছে পারফরম্যান্সে। আর প্রতিটা হারের পর হার্দিক হাসি মুখে উপস্থিত হয়েছেন পুরষ্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে। জোর করে হাসছেন, কিন্তু আর কীই-বা করার আছে? টিম ম্যানেজমেন্ট স্পিকটি নট। প্রশ্ন উঠবে, কোচরা কি করছেন? সমর্থকদের ক্রমাগত ধিক্কার হোক কিংবা সোশাল মিডিয়ায় বিদ্রুপ, মুম্বই ইন্ডিয়ান্স থেকে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি তাঁরা।
নীরবতা যে সম্মতির লক্ষণ সেটা নতুন করে বলার নেই। সেই অস্ত্রে হারের ময়না তদন্তের উত্তরও এড়িয়ে যাওয়া যায়। কারণ সফট টার্গেট তো একজন রইলেনই। দেওয়াল ভাঙার পর ঘুণ ধরছে বাড়ির কাঠামোতেও। রাজা তবু হাতড়ে বেরোচ্ছেন কাকে দোষ দেবেন? সামনে এসে ভুল স্বীকার করবেন না। নতুন দেওয়াল তোলার চেষ্টাও নেই। শুধু দিনের শেষে ক্লান্ত-বিধ্বস্ত একজনকে ধরে-বেঁধে এগিয়ে দিচ্ছেন। হার-জিত থাকেই। একটা দল যে প্রতিবারই ভালো ফল করবে, সেটা বাস্তবযোগ্য ভাবে সম্ভব নয়। কিন্তু কোনও দিন কি এই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে? মুক্তোর সন্ধানে ডুবসাঁতার দেওয়া তো দূরের কথা, হাবুডুবু খেয়েই চলতি আইপিএল শেষ করছে মুম্বই।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.