সানিয়া মির্জা: পাহাড়প্রমাণ চাপকে অ্যাটলাসের মতো নিজের কাঁধে বইতে বইতে কী করে দিনের পর দিন পারফর্ম করে যেতে হয়, শচীন তেণ্ডুলকরের (Sachin Tendulkar) জীবন যেন তারই পাঠ্যপুস্তক। আমরা অ্যাথলিটরা, বিশেষত নারীরা তাঁর থেকে এটা খুব ভাল করেই শিখে নিতে পারি। একটা মানুষ বছরের পর বছর লোকচক্ষুর সামনে পারফর্ম করে চলেছন। তিনি জানেন তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপের খুঁটিনাটি নিয়ে চুলচেরা বিচার-বিশ্লেষণ চলবে।
মাঠ আর মাঠের বাইরে প্রায় প্রতিটা মুহূর্তে তাঁর জীবন যে আতশকাচের তলায়, তা তাঁর থেকে ভাল আর কে জানেন! কিন্তু এই চাপের মস্ত বোঝাটিকে তিনি হেলায় বাউন্ডারির (Boundary) ওপারে ফেলে দিতে পারেন। বেগতিক হাওয়ার ভিতরও কী করে সিটবেল্ট বেঁধে রেখে উড়ান জারি রাখতে হয়, তিনি জানেন। জানেন চাপের ভিতর থেকে অনির্বাণ অগ্নিশিখার মতোই জ্বলে উঠতে। আর এই কাজ তো তিনি দু-এক দিন করেননি, করেছেন দীর্ঘ কয়েক দশকের কেরিয়ার জুড়ে।
তাঁর জীবনের দিকে তাকিয়ে দেখলে একটা জিনিসই উপলব্ধি করতে পারি, খেলাটার প্রতি তিনি কতখানি সৎ এবং নিষ্ঠ। প্রায় উপাসনার মতোই তিনি যেন খেলাকে তাঁর আত্মার সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন। মাঠে যখন তুমি নামছ, তখন পৃথিবী মুছে যায়। একান্তে মুখোমুখি শুধু তুমি আর তোমার আরাধ্য – খেলা। এর বাইরে কিছু নেই। তোমাকে জিততে হবে। দেশের জন্য, দেশের তেরঙ্গার জন্য, সমর্থকদের জন্য আর সবার উপরে নিজের জন্য। শাশ্বত এই শিক্ষা (Lesson) আমরা শচীনের থেকে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে পেয়ে এসেছি। আমার মতো যাঁরাই ছোটবেলা থেকে ক্রিকেট (Cricket) দেখছি, খেলাটাকে ভালবেসে ফেলেছি তাঁরা যে শচীনে বুঁদ হয়ে থাকব, এতে তাই আশ্চর্যের কিছু নেই। তাঁর দিকে বিস্ময়ে শুধু তাকিয়ে থেকেছি আর কত কিছু যে শেখার চেষ্টা করেছি, তা লিখে শেষ করা যাবে না।
তাঁর সমসাময়িকদের থেকে শচীন আলাদা হয়ে যান বোধহয় একটা জায়গাতেই। আমাদের প্রত্যাশার সমস্ত ভার আমরা তাঁর উপর চাপিয়ে দিয়েছি, আর তিনি তা অবলীলায় বহন করেছেন গোটা কেরিয়ার জুড়েই। আমরা চেয়েছি, শচীন ব্যাট হাতে নামছেন মানে সেঞ্চুরি করবেনই। এর থেকে কম হলে আমাদের মন ওঠে না! আমরা তাঁর নাম উচ্চারণ করে উল্লাসে মেতেছি। তিনি নামছেন মানে স্টেডিয়াম জুড়ে উঠছে ‘শচীন শচীন’ ধ্বনি। শচীনের কোনও ভুল জাতি মেনে নেবে না। শচীন নিজে তা জানেন। আর তা জেনে, সেই প্রায় অসম্ভব চাপ মাথায় নিয়েই তিনি বারেবারে জ্বলে উঠেছেন এই ক্রিকেটবিশ্বের সর্বত্র।
এই চাপের ভার যে কতখানি নিজে স্পোর্টসম্যান হওয়ার সুবাদে তা ভালই জানি। আর তাই অনুমান করতে পারি, চাপের পাহাড় ঠিক কতখানি ভাঙলে আসে শচীনের মতো সৃষ্টির জোয়ার। উন্মুখ জনজোয়ারের ভিতরও যে শান্ত ঋষিপ্রতিম হয়ে ওঠা যায়, ভিড়ের ভিতর একা ও একান্ত হয়ে ওঠা যায় নিজের খেলার সঙ্গে, তা শচীনকে না-দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। ঠিক এই বিন্দুতে এসেই তিনি অনন্ত নক্ষত্রবীথি মাঝে হয়ে ওঠেন ধ্রুবতারা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.