কৃশানু মজুমদার: শেষবার সেঞ্চুরি এসেছিল ইডেন গার্ডেন্সে। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে দিন-রাতের সেই টেস্টে শতরান হাঁকিয়েছিলেন বিরাট কোহলি (Virat Kohli)। তার পরে দীর্ঘ সময় কেটে গিয়েছে, কোহলির ব্যাট ‘বোবা’ থেকে গিয়েছে। আইপিএলেও কোহলি-ম্যাজিক চলছে না। নিন্দুকরা নখ-দাঁত বের করছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় ঝড় উঠছে, এবার দল থেকেই বাদ দেওয়া হোক কোহলিকে। বিরাটের ব্যাটে রান নেই দেখে ভারতের প্রাক্তন কোচ রবি শাস্ত্রী (Ravi Shastri) বলেছেন, বিরাট ‘ওভারকুকড’। প্রিয় ছাত্রকে পরামর্শ দিয়ে শাস্ত্রী বলেছেন, ”আমার মনে হয় যদি নিজের আন্তর্জাতিক কেরিয়ারকে দীর্ঘায়িত করতে চাও, আরও অন্তত ৬-৭ বছর খেলা চালিয়ে যেতে চাও, তাহলে আইপিএল থেকে সরে এসো।” চলতি আইপিএলে (IPL) বিরাট সাকুল্যে করেছেন ১২৮ রান।
কোহলির অফ ফর্ম দেখে গোটা দেশে ‘গেল গেল’ রব উঠেছে। একসময়ে ওয়াঘার ওপারে বলা হত, ”শচীন দে দে, সিয়াচেন লে লে।” বিরাট কোহলির জনপ্রিয়তাও পাক-মুলুকে নেহাত কম নয়। তাঁর ব্যাটিং দেখতে পছন্দ করে ইমরান খানের দেশও। পাকিস্তানের প্রাক্তন অধিনায়ক আসিফ ইকবাল (Asif Iqbal) সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে বললেন, ”ইদানীং তিনটি ফরম্যাট চলে এসেছে ক্রিকেটে। টেস্ট, ওয়ানডে এবং টি টোয়েন্টি। ফলে আমার মনে হয় তিনটি ফরম্যাট একসঙ্গে খেলতে খেলতে প্লেয়াররা নিজেরাও কিছুটা হলে বিভ্রান্ত। খারাপ সময় থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমি সাময়িক বিশ্রামের কথাই বলব।”
তিনটি ফরম্যাটে একসঙ্গে খেলা চালিয়ে যেতে হলে দারুণ ফিট থাকতে হয়। আবার তিনটি ফরম্যাটে খেলার ধরনও ভিন্ন। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে চালু রয়েছে টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটের বিভিন্ন ক্রিকেট লিগ। সেগুলোয় খেললে রয়েছে মোটা অঙ্কের অর্থ। যা উপেক্ষা করার নয়। অর্থের জন্য খেলতে নামলে অনেকসময় ক্রিকেট হয়ে যায় গৌণ। আসিফ ইকবাল বলছেন, ”আজকাল ক্রিকেটে অনেক অর্থ এসেছে। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে বিভিন্ন টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট হচ্ছে। শুধু অর্থ রোজগারের জন্য অনেকেই বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে খেলে বেড়াচ্ছে। আমি বলব শুধুমাত্র খেলার জন্য খেললে হবে না। প্যাশন দিয়ে খেলতে হবে। বিরাট কোহলির মধ্যে রয়েছে ক্রিকেটের প্রতি প্যাশন। ও এখনও তরুণ। এখনও ফর্মে ফিরতেই পারে। আগেও ও কয়েকদিনের জন্য ফর্ম হারিয়েছিল। আবার ফর্ম ফিরেও পেয়েছে। এবারও তাই হবে বলেই আমার বিশ্বাস। শুধু একটাই পরামর্শ বিরাট, নিজের উপরে আস্থা হারিও না। রানের খিদে তোমার রয়েছে। তুমি মাথা ঠান্ডা রেখে, পারিপার্শ্বিক চাপ দূরে সরিয়ে রেখে নিজের লক্ষ্যে অবিচল থাকো।”
কেনিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক আসিফ করিম (Asif Karim) অতীতে মাঠে দাঁড়িয়েই দেখেছেন বিরাটের অগ্রজ শচীন তেণ্ডুলকরের ব্যাটিং রূপকথা। ১৯৯৯ বিশ্বকাপে বাবার অন্ত্যেষ্টি সেরে এসে শচীন সেঞ্চুরি করেছিলেন আসিফ করিমের কেনিয়ার বিরুদ্ধেই। শচীনের অনুজ কোহলির খারাপ সময় দেখে আসিফ করিম বলছেন, ”সব স্পোর্টসম্যানদের জীবনেই খারাপ সময় থাকে। বিরাটের কেরিয়ারেও ব্যাড প্যাচ চলছে। আমি নিশ্চিত ও আরও শক্তিশালী হয়েই ফিরে আসবে। কোহলির রেকর্ড ওর হয়ে কথা বলছে। গত দশ বছর ধরে দারুণ ধারাবাহিকতা দেখিয়ে এসেছে কোহলি। ওর রেকর্ড, ওর ধারাবাহিকতা প্রমাণ করছে বিরাট কত বড় একজন ক্রিকেটার।”
শুধু কোহলি একা নন, তাঁর আগেও অনেক ব্যাটসম্যানের কেরিয়ারেই এমন খারাপ সময় এসেছে। যেমন ২০০০-০১ মরসুমে অস্ট্রেলিয়ার প্রাক্তন অধিনায়ক রিকি পন্টিংয়ের ব্যাট স্তব্ধ ছিল। ১৩টি ইনিংসে পন্টিং করেছিলেন মাত্র ২৫৯ রান। হাফ সেঞ্চুরি পেলেও পন্টিংয়ের ব্যাট থেকে সেঞ্চুরি আসেনি এই সময়ে। ২০০৬ সালে খারাপ সময় গিয়েছে ক্রিকেট ঈশ্বর শচীনেরও। সেই সময়ে ১৩টি ইনিংসে ৩৩৫ রান করেছিলেন মাস্টার ব্লাস্টার। কোহলির নিজেরও ২০১৪ সালে খারাপ সময় গিয়েছিল। ১০টি ইনিংস থেকে সংগ্রহ ছিল ১৩৪ রান করেছিলেন তিনি। এরকম উদাহরণ আরও আছে। তাতে তালিকা আরও বাড়বে।
ঘটনা হল কোহলির এখনকার খারাপ সময় যেন কিছুতেই কাটতে চাইছে না। প্রতিটি দিন কোহলির কাছ থেকে বড় ইনিংস দেখার লোভে টিভির পরদায় চোখ রাখেন ভক্তরা। কিন্তু তাঁদের নিরাশ করেন প্রাক্তন ভারত অধিনায়ক। বাংলাদেশের প্রাক্তন অধিনায়ক হাবিবুল বাশার বলছেন, ”আমার ব্যক্তিগত মতামত, ক্যাপ্টেন্সি ছেড়ে দেওয়াটা হয়তো কোনওভাবে বিরাটের খেলাকে প্রভাবিত করেছে। টেকনিক্যালি হয়তো ঠিকই আছে কোহলি কিন্তু ওর সমস্যাটা এখন মানসিক। আসলে কোহলি রানে ফেরার জন্য বড্ড বেশি চেষ্টা করে ফেলছে। যখন খারাপ সময় যায়, তখন সবাই একটু বেশি চেষ্টা করে। আর তার ফলে ব্যাকফায়ার ঘটতে পারে। বিরাট কোহলি আপাতত কয়েকদিন ক্রিকেট থেকে সরে দাঁড়াক। খুব বেশিদিনের জন্য নয় অবশ্য। তার পরে ফিরে আসুক।”
ফর্ম খারাপ বলে চ্যালেঞ্জ নিতে কিন্তু মোটেও ভয় পাচ্ছেন না কোহলি। দেশের প্রাক্তন অধিনায়ক মহম্মদ আজহারউদ্দিন রান না পাওয়ায় একসময়ে নিজেকে ব্যাটিং অর্ডারে পিছিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কোহলি সেখানে রানে ফিরতে ওপেনও করেছেন আইপিএলে। কিন্তু সেক্ষেত্রেও ভাগ্য সহায় ছিল না কোহলির। রাজস্থান রয়্যালসের বিরুদ্ধে ওপেন করতে নেমেও রানের মুখ দেখেননি কোহলি।
বাংলার প্রাক্তন অফ স্পিনার সৌরাশিস লাহিড়ী (Saurasish Lahiri) এখন বাংলার রঞ্জি দলের সহকারী প্রশিক্ষক। তিনি বলছেন, ”কোহলি কোনওদিনই চ্যালেঞ্জ নিতে পিছপা হয়নি। এক্ষেত্রেও হচ্ছে না। আর নিজেকে ব্যাটিং অর্ডারে উপরের দিকে নিয়ে আসা প্রমাণ করছে মানসিক দিক থেকে কোহলি কিন্তু এখনও ইতিবাচক। সব খেলোয়াড়ের কেরিয়ারেই খারাপ সময় থাকে। বিরাট কোহলিও সেই সময়ের মধ্যে দিয়েই যাচ্ছে। তবে এরকম পরিস্থিতিতে রানে ফেরার জন্য হাঁকপাঁক করে সবাই। বিরাট কোহলিও হয়তো ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু এসব সময়ে সাধারণত আগে খেলা দারুণ সব ইনিংসগুলোর কথাই ভাবা উচিত। আর নিজের চেনা ছন্দে যখন নেই, তখন যতটা সম্ভব বেসিকের উপর নির্ভর করে খেলতে হয়।”
ভারতের প্রাক্তন ক্রিকেটার যুবরাজ সিং আবার কোহলিকে পরামর্শ দিয়ে বলেছেন, আগের মতোই কোহলি আবার খোলা মেজাজে খেলা শুরু করুক। আগে ঠিক যেরকম ছিল কোহলি, ঠিক সেই রকম হয়ে যাক, তাহলেই ভাল খেলতে পারবে। অর্থাৎ যুবি ভারতের প্রাক্তন অধিনায়ককে মানসিকতা বদলানোর কথা বলেছেন।
সৌরাশিস ক্রিকেটভক্তদের প্রত্যাশার কথা তুলে ধরছেন। কোহলিকে নিয়ে সব সময়েই প্রত্যাশার পারদ চড়ে। সবাই ধরেই নেয়, কোহলি ব্যাট করতে নামলেই সেঞ্চুরি পাবেন। বাংলার প্রাক্তন অফস্পিনার বলছেন, ”কোহলি সেঞ্চুরি পাচ্ছে না ঠিক কথা। নিজের চেনা ছন্দেও নেই। কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পঞ্চাশ-ষাট করছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই রান করাটাও কিন্তু কঠিন ব্যাপার। তবে এখন ও রানে নেই, ফর্ম খুঁজে বেড়াচ্ছে, অনেকেই ওকে পরামর্শ দিচ্ছে, আমার ব্যক্তিগত মতামত বিরাট কোহলি নিজেই জানে এই অবস্থা কাটিয়ে উঠতে হলে ওকে কী করতে হবে। রানের পর রান তো কোহলি এতদিন নিজেই করে এসেছে। রান না পেলেও ওর ক্লাস যে চলে গিয়েছে, তা তো নয়।” সৌরাশিসের কথামতো ফর্ম ইজ টেম্পোরারি বাট ক্লাস ইজ পার্মানেন্ট। ফর্ম সাময়িক কিন্তু জাত চিরন্তন। সেই কারণেই ক্রিকেটপ্রেমী আশাবাদী খারাপ সময়ের শেষে একদিন সূর্য উঠবেই। বিপক্ষ বোলারদের বিষ শুষে সেঞ্চুরি করবেন কোহলি, এই স্বপ্নেই বুঁদ গোটা দেশ। থুড়ি, গোটা ক্রিকেট বিশ্ব।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.