Advertisement
Advertisement
Sachin Tendulkar

‘কত পথ পেরলে শচীন হওয়া যায়?’ জানতে চাইছেন লিটল মাস্টারে আপ্লুত শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

'রিচার্ডস-উত্তর পৃথিবীতে শচীনই শ্রেষ্ঠ', বলছেন বর্ষীয়ান সাহিত্যিক।

Shirshendu Mukhopadhyay praises Sachin Tendulkar। Sangbad Pratidin
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:April 23, 2023 5:20 pm
  • Updated:April 23, 2023 5:20 pm  

শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়: খেলা, যে কোনও ধরনের খেলারই আমি ভক্ত। মাঠের মধ্যে আমি মানসিক তৃপ্তি খুঁজে পাই। ঘাম এবং শ্রম এবং জনতার অভিবাদনের মধ্যে খুঁজে পাই চিত্তের মুক্তি। কাজেই এটা খুব স্বাভাবিক যে ক্রিকেটের ঘুণপোকা আমাকে কুটকুট করে কামড়াবে। হরষে, বিষাদে, অশ্রুতে আচ্ছন্ন করবে।

অনেক বড় বড় ক্রিকেটারের খেলা দেখেছি। গ্যারি সোবার্স, রোহন কানহাই, ভিভ রিচার্ডস। এঁরা বিশ্বক্রিকেটের এক-একজন বটবৃক্ষ। এঁদের প্রভাব ও প্রসারের তুলনা হয় না। ‘স্যর’ ডন ব্র্যাডম্যানের খেলার ফুটেজ দেখার সৌভাগ্য হয়েছে। সুনীল গাভাসকর থেকে লালা অমরনাথ, পলি উমরিগড় থেকে টাইগার পতৌদি– দেখেছি এঁদের খেলাও। সেসব দিন কখনও ভুলব না। যেমন ভুলব না আমৃত্যু শচীন তেণ্ডুলকরের খেলা।

Advertisement

[আরও পড়ুন: ‘আমার বাড়িতে তুলিতে হাতেখড়ি’, শচীনকে নিয়ে অভিজ্ঞতার কথা জানালেন শিল্পী সনাতন দিন্দা]

রিচার্ডস-উত্তর পৃথিবীতে শচীনই (Sachin Tendulkar) শ্রেষ্ঠ। কখনও কখনও মনে হয়, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ। বিশেষত টেস্ট ও ওয়ান ডে– ক্রিকেটের এই দু’টি শাখায় নিরন্তর ধারাবাহিকতা বজায় রাখার কথা উঠলে, এত বড় দেশের এত মানুষের চাহিদা ও স্বপ্নপূরণের সম্ভাবনার কথা ভাবলে, দিনের পর দিন পারফর্ম করে যাওয়ার সীমাহীন খিদের কথা ভাবলে– শচীন দ্য বেস্ট।

কেউ কেউ বলতে পারেন, শচীনের খেলায় নান্দনিক সুষমা কম। শচীনের চেয়েও ‘স্টাইলিস্ট’ ব্যাটার এসেছেন ক্রিকেটের ময়দানে। বিষয়টি তর্কযোগ্য। যে-ক্রিকেটার একটিও কভার ড্রাইভ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি পুরোদস্তুর ইনিংস খেলতে পারেন, তা-ও সর্বোচ্চ স্তরের ক্রিকেটে– তঁাকে কেন নান্দনিক বলব না? এমন স্বেচ্ছাকৃত আত্মত্যাগ তো নান্দনিক ক্রিকেটের সন্তান। তা-ও তর্কে নেমে যদি কিছুক্ষণের জন্য ধরে নিই– বেশ, শচীন একটু কম নান্দনিক, তাতেই বা কী এমন এসে-যায়? যদি ক্রিকেটীয় কার্যকারিতার কথা বিবেচনা করি, তাহলে বলতেই হবে– শচীনের মতো কার্যকর খেলা ওঁর প্রজন্মের কেউ খেলতে পারেনি। পরের প্রজন্মকে সেই অগ্নিপরীক্ষার ভিতর দিয়ে অনেকটা পথ এখনও যেতে হবে।

[আরও পড়ুন: ‘শচীন পাজি কতটা ভাল বলব না, তবে উনি আমার অনুপ্রেরণা’, বললেন অজিঙ্ক রাহানে]

আরও একটি জিনিস আমার খুব ভাল লাগে। শচীন দ্রুতগতির পেস বোলিং খেলতে খুব পছন্দ করে। ভারতের উইকেট তো বরাবর স্পিন সহায়ক। এ-দেশ থেকে সত্যিকারের আগুনঝরানো ফাস্টবোলার ক’জন উঠে এসেছেন? তুলনায় পড়শি পাকিস্তান অনেক বেশি ফাস্টবোলারের জন্ম দিয়েছে। কিন্তু শচীনের খেলা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, এ-দেশে ফাস্ট বোলিংয়ের তেমন চল নেই। যখন বিদেশ সফরে ভারত গিয়েছে– অস্ট্রেলিয়া হোক, নিউজিল্যান্ড হোক, সাউথ আফ্রিকা বা ওয়েস্ট ইন্ডিজ– শচীন কাঁপিয়ে দিয়েছে। যত গতিতে বল ওর পানে ধেয়ে এসেছে, তত নিখুঁতভাবে শচীন সেসবের মোকাবিলা করেছে।

একটি ভিডিও দেখেছিলাম। যেখানে অবসর নেওয়ার অনেক পরে একটি অনুষ্ঠানে শচীন বলছিল– ওর প্রথমবারের অভিজ্ঞতা ফাস্ট বোলিং খেলার। প্রথম ইনিংসে সুবিধা করতে পারেনি। ১৪০, ১৪৫ কিলোমিটার গতিতে বল ধেয়ে আসছে শরীর লক্ষ্য করে বিদেশের মাটিতে। প্রথম ইনিংসে অল্প রানে আউট হয়ে যায়। আর, ভেঙে পড়ে হতাশায়। চোখে জল চল এসেছিল বেচারার। ভাবতে শুরু করে, এত উচ্চ স্তরের ক্রিকেট খেলার কোনও যোগ্যতা কি তার আছে? তাহলে কি বড় ক্রিকেটার হওয়ার সব স্বপ্ন শেষ হয়ে যাবে অকালে? দ্বিতীয় ইনিংসে খেলতে নামার আগে শচীন একটি ছোট্ট পরীক্ষা করে নিজের মনের সঙ্গে। নিজেকে বোঝায়– কত রান করলাম, এটা দেখলে হবে না। স্কোরবোর্ড আত্মবিশ্বাস কমিয়ে দিতে পারে। তার চেয়ে দেখতে হবে, কত মিনিট ধরে খেলতে পারছি। এই নিয়মটা কিন্তু কাজে দেয়। অনেকটা সময় কাটাতে পারে সে ক্রিজে। রান হয়তো উল্লেখযোগ্য কিছু করেনি। তবে যে ধন্দ ছিল নিজের সঙ্গে– যেমন, পারব তো এমন উচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলতে– আমার কি সেই প্রতিভা ও সামর্থ্য আছে– এই দ্বন্দ্বমূলক প্রশ্নগুলির নিরসন ঘটে যায় চিরতরে। আর কখনও শচীনকে ভাবতে হয়নি– সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার যোগ্য নয়। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে বোঝা যাবে– কীভাবে শচীন নিজেকে তৈরি করেছে।

শচীন খুব ভদ্র। অমায়িক। মাঠে ওকে কখনও অ-ক্রিকেটীয় আচরণ করতে দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আউট হয়ে প্রকাশ্যে অসন্তোষ দেখিয়েছে হয়তো এক-আধবার। ওঁর ক্রিকেট কেরিয়ার যতখানি দীর্ঘ, তার নিরিখে এই টুকটাক আচরণ কোনও ধর্তব্যে আসে না। অথচ, শচীনের মধ্যে কী যে আগ্রাসন ছিল, বলার নয়। সেটা প্রতিফলিত হত ওর শটে। ওর পাওয়ারে। ওর শিল্পে। আর বডি ল্যাঙ্গুয়েজে। ভদ্র আচরণের মানদণ্ড থেকে সামান্য না-সরেও কী করে শাসন করতে হয় বিপক্ষের মনমেজাজ– তা শচীনকে দেখে শেখার। মাঠে নির্মমভাবে খুন করত প্রতিপক্ষের বোলিং। কাউকে পরোয়া করত না। অথচ মাঠের বাইরেও সে কতই না ঘরোয়া। দিলখুশ ও হাস্যমুখর। ঠাট্টা-ইয়ার্কি করে সতীর্থদের সঙ্গে। অথচ বাহুল্য নেই। মধ্যবিত্ত মূল্যবোধের শিকড় শচীন তার চরিত্র ও ব্যবহারে রক্ষা করে এসেছে। এ-ও কী কম কথা!

‘স্যর’ ডন ব্র্যাডম্যান টেস্ট ক্রিকেটে যে-গড় রেখে গিয়েছেন তা চিরকাল অক্ষত থাকবে বলেই বিশ্বাস করি। এহেন ‘স্যর’ ব্র্যাডম্যানও কিন্তু বলেছেন শচীনের খেলা দেখে– এই ছেলেটি অনেকটা আমার মতো খেলে। এর চেয়ে বড় স্বীকৃতি আর কী আছে? নন্দনতত্ত্বের মেঘের আড়ালে থাকা ক্রিকেটের ঈশ্বর যোগ্য মানুষের মুখ দিয়েই সবচেয়ে উপযুক্ত কথাটি বলিয়ে নিয়েছেন শচীনের জন্য।

(সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে অনুলিখিত)

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement