দু’জনকে নিছক ক্রিকেট-সতীর্থ বললে ভুল নয়, মহাভুল হবে। তাঁরা একসঙ্গে দেশের হয়ে খেলেছেন যেমন, তেমনই অভিন্নহৃদয়ও ছিলেন। আসলে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের (Sourav Ganguly) সঙ্গে মারাঠির আত্মিক টান যে আজকের নয়, বহু দিনের। সেই কিশোর বয়স থেকে। আর সেই প্রিয় দাদির জীবনের হাফসেঞ্চুরির দিনে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর হয়ে এক্সক্লুসিভ কলাম লিখলেন শচীন তেণ্ডুলকর।
বন্ধুত্বের বয়স বাড়ে না…
সৌরভের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা ইন্দোরে একটা ক্যাম্পের সময়। অনূর্ধ্ব ১৫ খেলার আগে ইন্দোরে একটা ক্যাম্প ছিল আমাদের। মনে আছে, মাসখানেক আমরা ছিলাম সেখানে। আর এত দিন একসঙ্গে থাকলে যা হয়, তাই হয়েছিল। আমাদের বন্ধুত্ব আরও বেশি গাঢ়, আরও বেশি গভীর হয়েছিল। ইন্দোর থেকে আমাদের বন্ধুত্বের যে সফর শুরু হয়েছিল, তা এখনও দিব্য চলছে। দেখাসাক্ষাৎ ইদানীং একটু কম হয় হয়তো। কিন্তু যোগাযোগটা একই রকম আছে। ইন্দোরের পরেও আমাদের দেখাটেখা প্রায়ই হত। কখনও রাজ্য দলের হয়ে খেলতে গিয়ে। কখনও বা আবার জাতীয় ক্যাম্পের সময়। আর যত আমাদের মেলামেশা বেড়েছে, তত বেশি করে ওকে চিনতে পেরেছি বলতে পারেন।
রান করার বুনো খিদে
সৌরভের চরিত্রের ইতিবাচক দিকগুলো আমাকে ভীষণ আকর্ষণ করত, জানেন। ছিয়ানব্বইয়ে টেস্ট অভিষেক করে সৌরভ। ওর সঙ্গে একই টেস্টে রাহুল দ্রাবিড়ও অভিষেক করল। ছিয়ানব্বইয়ের সেই ইংল্যান্ড সিরিজে সৌরভ-রাহুল আমার দু’জনকে দেখেই মনে হয়েছিল যে, কিছু একটা করে দেখানোর অসম্ভব খিদে নিয়ে খেলতে নেমেছে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আপনাকে টিকে থাকতে গেলে এই খিদেটা থাকা অত্যন্ত জরুরি। যে খিদে পারফর্মারকে নিরন্তর তাড়া করে যাবে। সত্যি বলতে, ওরা এত দূর আসতেই পারত না ওই অসীম খিদে না থাকলে।
বলেছিলাম, সৌরভ ক্যাপ্টেন হোক
নয়ের দশকের শেষাশেষি আমি অধিনায়ক হই। ক্যাপ্টেন হওয়ার পর আমি বলেছিলাম যে, আমার সহ-অধিনায়ক দরকার। তখন সহ-অধিনায়কের অত চল ছিল না। কিন্তু আমি দেশে-বিদেশে সর্বত্র সহ-অধিনায়ক চেয়েছিলাম। আর চেয়েছিলাম, সৌরভকে (Sourav Ganguly)। কারণ–
ছিয়ানব্বইয়ের পরের কয়েক বছরে খেয়াল করে দেখেছিলাম যে, তিন-চার বছরে নিজেকে অনেকটা তৈরি করে ফেলেছে সৌরভ। ওর গভীর ক্রিকেট বোধ, ইংরেজিতে যাকে আমরা ‘গেম অ্যাওয়ারনেস’ বলি, আমাকে মুগ্ধ করত। কখন কী স্ট্র্যাটেজি তৈরি করতে হবে. পরিস্থিতি বুঝে সেটা করতে পারত সৌরভ। আর এই জিনিসটা ছিয়ানব্বইয়ে ওর টেস্ট অভিষেকের আগে থেকেই দেখেছি আমি। দেখা গেল, সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে হয়তো ও ভুল করেছে। কিন্তু সেই ভুল দ্রুত শুধরে সঠিক কাজটা করার ক্ষমতা ছিল সৌরভের। তাই চেয়েছিলাম, আমার সহ-অধিনায়ক সৌরভ হবে। যার সঙ্গে সময় সময় আমি সব কিছু নিয়ে কথা বলতে পারব। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতে পারব।
আমি ক্যাপ্টেন্সি ছাড়ার পর চেয়েছিলাম, সৌরভকেই নেতৃত্বের ব্যাটনটা দেওয়া হোক। আর সেই ভাবনায় যে কোনও ভুল ছিল না, প্রমাণিত। ভারত অধিনায়ক হিসেবে ওর পরিসংখ্যানই সেটা বলে দেবে।
ক্যাপ্টেন হিসেবে কী কী সব অবিশ্বাস্য কীর্তি গড়েছে সৌরভ! ওর আমলে ভারত যে ক্রিকেট খেলেছে, যে ভাবে টিম নিজেদের পেশ করেছে, দেখার মতো। বলছি না, তার আগে ভারতীয় ক্রিকেট সাফল্য পায়নি। তিরাশির বিশ্বকাপ জয়, বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ জয়– দুর্ধর্ষ কৃতিত্ব। কিন্তু সৌরভের হাত ধরে নতুন এক ভারত জন্ম নেয়। বললাম না, ওর মধ্যে ভাল অধিনায়ক হওয়ার সমস্ত রকম মশলা দেখতে পেয়েছিলাম।
তখন একঝাঁক নতুন ক্রিকেটার আমাদের টিমে। এত জন জুনিয়রকে নিয়ে চলা কিন্তু খুব সহজ নয়। দেখলাম, সৌরভ ওদের প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা করে বসল। পরে হরভজনের কাছ থেকে শুনেছিলাম যে, ২০০১ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে সেই ঐতিহাসিক সিরিজের আগে নাকি ওর সঙ্গে বসেছিল সৌরভ। স্টিভ ওয়ার অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ওই সিরিজে অনিল কুম্বলে খেলেনি। হরভজনকে সৌরভ বলেছিল যে, অনিল নেই বলে তুমি খেলেছ, ভেব না। বরং এমন মানসিকতা তৈরি করো যাতে বিপক্ষকে থেঁতলে দিতে পারো। হরভজন তার পর কী করেছিল, বাকিটা ইতিহাস।
যুবরাজ, শেহবাগ– সবার সঙ্গে কথা বলা থেকে শুরু করে বসে পড়া, সব করেছিল সৌরভ। শেহবাগকে ওপেনে তো দাদিই পাঠিয়েছিল। টিমের প্রতিটা প্লেয়ারকে নিয়ে ভাবত সৌরভ। প্লেয়ারকে বিশ্বাসটা জোগাত যে, আমি আছি তোমার সঙ্গে। নিশ্চিন্তে খেলো তুমি। তার পর প্লেয়ার দুশো শতাংশ দেবে না কেন?
ব্যাটিংয়ের সৌরভ
অনেকেই আগে প্রশ্নটা করেছিলেন যে, ক্যাপ্টেন সৌরভের ছায়ায় ব্যাটার সৌরভ ঢাকা পড়ে গিয়েছিল কি না? আমি মনে করি না। ব্যাটার সৌরভ জানত, কখন কাকে আক্রমণ করবে, কাকে ধরে খেলবে। তাই এত দিন দুটো ফরম্যাটে চুটিয়ে খেলতে পেরেছে, হাজার হাজার রান করতে পেরেছে।
চাপ কাটাতে বাংলা
চাপ প্রত্যেকের উপরেই থাকে। বাউন্ডারি লাইনের বাইরের যে দুনিয়াটা, সেখানে প্রতিটা ক্রিকেটারের উপরেই চাপ অনন্ত। বিপক্ষ ওত পেতে দাঁড়িয়ে আছে। সঙ্গে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রত্যাশা। সৌরভের মুখ দেখে বুঝতে পারতাম, কখন ও চাপে পড়ছে। আর ও চাপে পড়লেই আমি বাংলায় কথা বলতে শুরু করতাম! শুনে হেসে ফেলত সৌরভ। বুঝতে পারতাম, ওর উপর থেকে চাপের মেঘ কাটছে। শুধু দুঃখের হল, আমি চাপে পড়লে দাদি কখনও মারাঠিতে কথা বলেনি!
ফিফটি ব্যাটিং
অনূর্ধ্ব পনেরো থেকে আমাদের সফর শুরু হয়েছিল। যে সফর আমার খুব কাছ থেকে দেখা। আর এই সফরে সৌরভ হেসেছে যেমন, কষ্টও পেয়েছে। বেশিরভাগ সময় আমি দেখেছি, সময় কাটিয়েছি ওর সঙ্গে। আমাদের মধ্যে যোগাযোগ থাকবেও। ইয়ে দোস্তি হাম নেহি তোড়েঙ্গে। শুধু আমাদের বন্ধুত্বে আজও ধুলো জমেনি। নিশ্চিত, কোনও দিন জমবেও না।
ইয়ে দোস্তি হাম নহি তোড়েঙ্গে!
(অনুলেখক: সুনন্দন লেলে)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.