অরিঞ্জয় বোস: জীবন খাতার প্রতি পাতায় প্রাপ্তিযোগের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ। ক্রিকেট তাঁকে যেমন দু’হাত উপুড় করে দিয়েছে, তিনিও ক্রিকেটকে ফিরিয়ে দিয়েছেন সমধিক। শুধু সেই ক্রিকেট রত্নভাণ্ডারে একটাই পরশমণি অমিল। স্রেফ একটা বিশ্বকাপ।
বিশ্বজয়ের উষ্ণীষ অজেয় রয়ে গিয়েছে তাঁর ক্রিকেট-জয়যাত্রায়। অথচ ২০১১-তে মহেন্দ্র সিং ধোনি যা পেরেছেন, আজকের রোহিত শর্মা যে ভাগ্যোদয়ের দ্বারপ্রান্তে, একদিন তিনি এবং তাঁর হাতে বিনির্মিত টিম ইন্ডিয়াও পেয়েছিল সেই সুযোগ। সে ‘বছর কুড়ি আগে’র এক ধূসর, মনখারাপের ফাইনাল। ঠোঁট আর কাপের মধ্যে যে দূরত্ব, সেই আক্ষেপটুকু নিয়ে তাঁকে ফিরে আসতে হয়েছিল জোহানেসবার্গ থেকে। অথচ ইতিহাস গড়ার সোনালি সুযোগ ছিল তাঁর সামনে। দরকার ছিল এক অপ্রতিরোধ্য অস্ট্রেলিয়াকে বশ্যতায় আনা। হাতছানি ছিল উদ্ধত ক্রিকেট শাসককে ধূলিধূসর রণভূমিতে আছড়ে ফেলে বিজয়গাথা রচনা করার। হয়নি। ২০০৩ একরাশ যন্ত্রণা উপহার দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেটপ্রেমীদের। তাঁকেও। তিনিই তো ছিলেন স্বপ্নের কারিগর। স্বপ্নের সওদাগর।
বিকেলের ম্লান আলোয় কি সেই সব স্মৃতি মনে পড়ে যাচ্ছিল উদাসী মহারাজের? নয়তো এতটা স্মৃতিমেদুর হবেন কেন! চোখের সামনে সেই অস্ট্রেলিয়া খেলছে বলে? নাকি যথার্থ দলপতির মতো আজও ঘৃণা করেন পরাজয়কে? হয়তো তাই। নতুবা কেন বিশ্বকাপ (World Cup 2023) সেমিফাইনালের দ্বৈরথে চোখ রেখে ভেসে যাবেন বছর কুড়ি আগের মনখারাপের বিকেলে? কেনই বা কর্পোরেট বক্সে বসে বলে উঠবেন, “২০০৩-এ আমার হারের বদলা নিক রোহিতরা।” এও তো এক যুদ্ধঘোষণা। উত্তরসূরির কাছে কম্বুকণ্ঠে আহুতি প্রার্থনা, বিশ্বজয়ের। যা বয়ে নিয়ে চলা যন্ত্রণায় তৃপ্তির প্রলেপ দেবে।
‘বিশ সাল বাদ’ সেই মঞ্চ তো প্রস্তুত। ইডেনে দ্বিতীয় সেমিফাইনালে অস্ট্রেলিয়া-দক্ষিণ আফ্রিকা দ্বৈরথে নামার আগেই তো বিজয়ী নির্বাচন সেরে ফেলেছিল নন্দনকাননে আগত দর্শককুল। চাই, অস্ট্রেলিয়াকেই চাই। ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া-নিধনেই বিশ্বকাপ জয়ের সার্থকতা খুঁজতে চাইছে গোটা দেশ। তার দর্পণ হয়ে উঠেছিল আজকের ইডেন। সেই ধাত্রীগৃহে দাঁড়িয়ে ভারতের জয়ের আকাঙ্ক্ষার গভীরতা টের পাচ্ছিলেন তিনিও। তাই তো গল্পচ্ছলে বলেও গেলেন, “ভারত অসাধারণ ক্রিকেট খেলছে। চ্যাম্পিয়নের মতো। আমরা যে অস্ট্রেলিয়ার কাছে হেরেছিলাম, তারা অপ্রতিরোধ্য ছিল। এই অস্ট্রেলিয়া তার অর্ধেকও নয়।”
ক্রিকেট জনতাও সেই সারসত্য অনুভব করতে পারছে। আর পারছে বলেই উদ্বেলিত হচ্ছে জিঘাংসার আগুনে। পরাজয়ের গ্লানিকে বিজয়ের উল্লাসে ভাসিয়ে দিতেই তারা অভ্যস্ত। মোতেরা-সহ গোটা দেশ সেই আনন্দমোহনায় ভেসে যেতে ব্যাকুল। সম্ভব। আকুল প্রার্থনা আর মিলিত প্রয়াস থাকলে অসম্ভব সম্ভব হয়। আর এই টিম ইন্ডিয়া তো ছুটছে অবিশ্বাস্য অশ্বমেধের গতিতে। কিন্তু ফাইনালে অস্ট্রেলিয়া বরাবর ভয়ংকর প্রতিপক্ষ, তাঁর চেয়ে সেটা ভালো আর কে জানে। বিষ্যুদবারের ইডেনে কি তাই চেনা প্রতিপক্ষকে মেপে নিতে স্বর্গোদ্যানে পদার্পণ ঘটেছিল মহারাজের? তাই হয়তো কর্পোরেট বক্সে স্থিতধী চিত্তে মেপে নিলেন অজিকুলকে। দেখলেন তাবরেজ শামসি, কেশব মহারাজেদের বিরুদ্ধে ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে গ্লেন ম্যাক্সওয়েলদের ডেকে আনা বিপদ। দেখলেন তিনি। মুচকি হাসলেনও। আর বলে গেলেন, “স্পিনের বিরুদ্ধে এই অস্ট্রেলিয়ার অনেক দুর্বলতা আছে। আজকের ম্যাচেই তো দেখা গেল। ব্যাকফুটে খেলতে গিয়ে আউট হচ্ছে ওয়ার্নার-ম্যাক্সওয়েলরা। ব্যাপারটা নিশ্চয় রাহুল (দ্রাবিড়) দেখছে।”
দ্রাবিড়ীয় পর্যবেক্ষণ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে এমন মনুষ্য ভূ-ভারতে নেই। কিন্তু বাংলার ক্রিকেটকুলের ধ্রুবতারা যে মন্ত্রগুপ্তি বাতলে দিলেন, তা যে ব্রহ্মাস্ত্র। শুধু তিনি নন। ২০০৩-এ বদলা চান আরও অনেকে। সেই দুঃস্বপ্নের ফাইনালের অনেক কুশীলব। যেমন মহম্মদ কাইফ। সেই অস্ট্রেলিয়া আর আজকের অস্ট্রেলিয়ার মধ্যে কতই না রঙমিলান্তি। সেবার অপরাজেয় হয়ে কাপ-ফাইনালে উঠেছিল রিকি পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়া। এবার রোহিতের ভারত। পাকেচক্রে এদিন ইডেনে উপস্থিত ছিলেন পন্টিং। মাঠে দেখাও হয়েছে মহারাজের সঙ্গে। হয়তো ফাইনালেও থাকবেন। অজি ক্রিকেটের দর্পচূর্ণের এর চেয়ে ভালো মঞ্চ কি আর পাবেন বিরাট কোহলিরা? পাবেন না। তিনিও তা বুঝতে পারছেন। তাই এই সুযোগ।
ক্রিকেট দ্বিতীয় সুযোগ দিয়েছে। এবার যে পারতেই হবে। লক্ষ্মীবারের ইডেন গ্যালারিতে ছয়লাপ পোস্টারে সেই আকুতি স্পষ্ট। তার মাঝেই এক খুদের গায়ের জার্সি উড়িয়ে উল্লাস দেখা যাচ্ছিল জায়ান্ট স্ক্রিনে। তিনি দেখলেন কর্পোরেট বক্সের খোলা বারান্দায় বসে। আর মৃদু হাসলেন। আজ তো তাঁর হাস্যজ্জ্বল থাকার দিন। ইতিহাসের চাকা যে বদলে দেওয়ার মুখে তাঁর হাতে গড়া টিম ইন্ডিয়ার উত্তরসাধকরা। তিনি? সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly)। আজ তো আনন্দের দিন। কালচক্রে সময় যে আসন্ন। এবার যে তাঁর বদলার উষ্ণীষ মাথায় তোলার পালা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.