বিশ্বদীপ দে: বল পড়ে ব্যাট নড়ে। খেলা এগোয়। কিন্তু কার এত সময় যে দীর্ঘ দীর্ঘ সময় ধরে কাজকম্মো বিসর্জন দিয়ে তা দেখবে বসে বসে! ক্রিকেট (Cricket) সম্পর্কে এমন অভিযোগ বারবার করে থাকেন সমালোচকরা। ছয়ের দশকে যখন লাগাতার ড্রয়ের ধাক্কায় ক্রিকেট ক্রমশই ‘বোরিং’ হয়ে উঠছে, সেই সময়ই সীমিত ওভারের খেলার জন্ম। পরবর্তী সময়ে সেটাই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়ে যায়। শুরুতে ৬০ ওভার। পরে ৫০ ওভার। আর নতুন সহস্রাব্দের কয়েক বছর যেতে না যেতে এসে যায় টি২০ (T20)। ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে টি১০ ফরম্যাটের খেলাও। হয়তো শিগগিরি আন্তর্জাতিক টি১০-ও দেখব আমরা। আর এই পরিবর্তনের পিছনে রয়েছে ক্রিকেট খেলাকে ‘সময়ের বেড়াজাল’ থেকে মুক্ত করার দাবি। কিন্তু একটা সময় এমন টেস্ট ম্যাচও খেলা হয়েছে, যার কোনও নির্দিষ্ট সময়সীমাই নেই। সোজা কথায় যাকে বলা হত ‘টাইমলেস টেস্ট’ (Timeless Test)!
নাম থেকেই পরিষ্কার, ফলাফল না হওয়া পর্যন্ত খেলে যেতে হবে। কোনও নেহাত পরীক্ষামূলক প্রয়োগ নয়। ১৮৭৭ সাল থেকে ১৯৩৯ পর্যন্ত সময়বিহীন টেস্ট খেলা হয়েছে ৯৯টি! দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগে পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়ায় হওয়া সব টেস্টই ছিল টাইমলেস! তবে মাত্র দু’টি ম্যাচই ড্র হয়েছিল। অধিকাংশ ম্যাচই শেষ হয়ে যেত চতুর্থ বা পঞ্চম দিনে। কেননা সেই সময় অস্ট্রেলিয়ার পিচগুলিতে এত দ্রুত ফাটল ধরত যে তার মধ্যেই ম্যাচের নিষ্পত্তি হয়ে যেত। একমাত্র ১৯২৯ সালে মেলবোর্নে হওয়া এক টেস্ট চলেছিল ৮ দিন। ১৯১২ সাল থেকে টাইমলেস টেস্ট শুরু হয় ইংল্যান্ডেও। সুতরাং বোঝাই যায়, এর চাহিদা ছিলই। কিন্তু টাইমলেস টেস্ট বলতে যে ম্যাচটির কথাই ক্রিকেটরসিকদের মাথায় আসে সেটি খেলা হয়েছিল ১৯৩৯ সালে। ইতিহাসে এই ম্যাচের গুরুত্ব দু’টি কারণে। এটাই শেষ টাইমলেস টেস্ট। আর ১২ দিনের পরও সেই ম্যাচ শেষ হয়েছিল অমীমাংসিত ভাবে!
এই মুহূর্তে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট সিরিজের শেষ ম্যাচে ঢুকে পড়েছে করোনা আতঙ্ক। খেলা দু’-তিন দিন পিছিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে বারবার আলোচনায় উঠে আসছে শুরু হতে চলা আইপিএলের ধাক্কা। এই সময়ে দাঁড়িয়ে কল্পনা করাও মুশকিল সেই আদ্যিকালের ঐতিহাসিক ম্যাচটিকে। আজকের পৃথিবীর দ্রুততা থেকে দূরে এক ঢিমে তালের সময়-খাঁচায় তখন বন্দি পৃথিবী। টি২০ নয়, যখন ক্রিকেটের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল লম্বা মেয়াদের ক্রিকেটই। যাই হোক, টাইমলেস যখন, তখন কেন সেই ম্য়াচ শেষ করতে হয়েছিল অমীমাংসিত ভাবে?
সেই গল্প পরে। আগে শুরু থেকে শুরু করা যাক। দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ডের মধ্যে খেলা হয়েছিল ১৯৩৮-৩৯ সালের সেই সিরিজ। খেলা হয়েছিল দক্ষিণ আফ্রিকায়। আগে থেকেই ঠিক ছিল, যদি কোনও দল চতুর্থ ম্যাচের পরে ১ টেস্টের ব্যবধানে এগিয়ে থাকে কিংবা দুই দলেরই সুযোগ থাকে সিরিজে জেতার তাহলে পঞ্চম তথা শেষ টেস্টটি হবে টাইমলেস। সেই শর্ত মেনে, যেহেতু ইংল্যান্ড ১-০ এগিয়ে ছিল তাই পূর্ব পরিকল্পনা মতো ঠিক হয়ে গিয়েছিল, নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত চলবে ওই টেস্ট।
১৯৩৯ সালের ৩ মার্চ ডারবানে যেদিন খেলা শুরু হল, দিনটা ছিল রোদ ঝলমলে। সেই ম্যাচে দু’দলের মধ্যে সবচেয়ে বড় তারকার নাম ওয়ালি হ্যামন্ড। যাঁর কভার ড্রাইভ আজও মিথ হয়ে রয়েছে। তিনিই ছিলেন ইংল্যান্ডের অধিনায়ক। প্রথম ইনিংসে ২৪ রানে আউট হয়ে গেলেও দ্বিতীয় ইনিংসে করেন ১৪০। সেটাই তার ২১তম শতরান। যা করে তিনি সেই সময় বিশ্বে সবথেকে বেশি শতরান করার তৎকালীন রেকর্ডে স্পর্শ করেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকে। এছাড়াও ইংল্যান্ড দলে ছিলেন আরেক গ্রেট স্যার লেন হাটন। টেস্টে এক ইনিংসে প্রথম ৩৫০ রানের বেশি স্কোর করে যিনি বিশ্বরেকর্ড গড়েছিলেন।
যাই হোক, দক্ষিণ আফ্রিকা টসে জিতে ব্যাটিং নেয়। তারা প্রথম ইনিংসে তোলে ৫৩০ রান। জবাবে ইংল্যান্ড অলআউট হয়ে যায় ৩১৬ রানে। ২১৪ রানে এগিয়ে থেকে দ্বিতীয় ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকা তোলে ৪৮১।
৬৯৬ রানের লক্ষ্যে দ্বিতীয় ইনিংসে খেলা শুরু করে ইংল্যান্ড। ম্য়াচের চতুর্থ ইনিংসে অত রানের লক্ষ্যমাত্রা যতই অসম্ভব বলে মনে হোক, সেই ম্যাচের পিচ ছিল বোলারদের সাক্ষাৎ বধ্যভূমি। ম্যাচ ততদিনে সাত দিনে পেরিয়ে গিয়েছে। ৭৮ রানের মাথায় প্রথম উইকেট হারায় ইংল্যান্ড। তিন নম্বরে নামানো হয় ২২ বছরের বিল এডরিখকে। কার্যত ‘ফাটকা’ খেলেছিলেন হ্যামন্ড। তরুণ খেলোয়াড়কে নামানোর সময় আবদার করেছিলেন ডাবল সেঞ্চুরির। এডরিখ কথা রেখেছিলেন। করেছিলেন ২১৯ রান। ওপেনার পল গিব সাড়ে সাত ঘণ্টা উইকেটে শিকড় নামিয়ে করেছিলেন ১২০ রান। অধিনায়ক হ্যামন্ড যে ১৪০ করেছিলেন সেকথা তো আগেই বলেছি। কিন্তু এডরিখের ইনিংসটাই কার্যত জয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছিল ইংল্যান্ডকে।
শেষ পর্যন্ত ইংল্যান্ড যখন পৌঁছে গিয়েছে ৫ উইকেটে ৬৫৪ রানে, তখনই নামল বৃষ্টি। জয় থেকে ব্রিটিশরা তখন মাত্র ৪২ রান দূরে। অতগুলি উইকেট হাতে থাকায় এটা মোটামুটি বলাই যায়, খেলা পুরো হলে ইংল্যান্ড জিততই। কিন্তু প্রকৃতি ‘ভিলেন’ হয়ে ভেস্তে দিল সব। চায়ের বিরতির পরে সেদিন আর খেলা হল না। এদিকে দু’দিনের বিরতি ধরে ম্যাচ ততদিনে বারো দিনে পৌঁছেছে। ব্যাট-বলের লড়াই হয়েছিল মোট ১০ দিন বা ৪৬ ঘণ্টা। যা ইতিহাসের দীর্ঘতম প্রথম শ্রেণির ম্যাচ।
কিন্তু খেলাটা এগারো নম্বর দিনে আর গড়ায়নি? আসলে পরের দিনই ছিল ইংল্যান্ড দলের ট্রেনের রিজার্ভেশন। কেপটাউন থেকে ডারবান যেতে ট্রেনপথে লাগে ১০০০ মাইল! ১৭ মার্চ জাহাজ ছাড়ার কথা। একদিনও দেরি করলে সেই জাহাজ ফসকে যাবে। এদিকে ততদিনে পৃথিবীর মাথার উপরে ঘনাতে শুরু করেছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ছায়া। তার উপর আগামী কয়েকদিনও ভারী বৃষ্টির পূর্বাভাসও ছিল। সব মিলিয়ে ইংল্যান্ড দল আর ঝুঁকি নেওয়ার জায়গায় ছিল না। যে কোনও সময় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে আর বাড়ি ফেরা হবে না! এই আতঙ্কে ইতিহাসের দীর্ঘতম ক্রিকেট ম্যাচকে অমীমাংসিত রেখে দিয়েই মাঠ ছাড়ে ইংল্যান্ড।
একটা ম্যাচ। টানা দশ দিন ধরে চলছে খেলা! ভাবা যায়! বল পড়ছে, ব্যাট ঘুরছে… যেন এক অনন্ত প্রক্রিয়া। পরবর্তী সময়ে পৃথিবীর জীবনঘূর্ণি যত গতি পেয়েছে তত বিস্ময়ের উদ্রেক করেছে টাইমলেস টেস্ট। ক্রিকেটরসিকরা গালে হাত দিয়ে বসে ভেবেছে, কী করে অতদিন ধরে খেলার মেজাজ ধরে রাখতে পারলেন ক্রিকেটাররা! বলা হয়, এটাই একমাত্র ম্যাচ, যেখানে ম্য়াচের মধ্যে খেলোয়াড়দের দু’বার চুল কাটতে হয়েছিল। খেলোয়াড়রা মানসিক ভাবে কতটা ধ্বস্ত হয়েছিল তা বোঝাতে একটা উদাহরণই যথেষ্ট। এরিক ডালটন নামে দক্ষিণ আফ্রিকার এক খেলোয়াড় জানিয়েছেন, ম্যাচ চলাকালীন তাঁর স্ত্রীর ঘুম ভেঙে যেত মাঝরাতে। শুনতে পেতেন ঘুমের ঘোরেও এলবিডবলিউর আবেদন করে চলেছেন এরিক।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.