নিছক কথা নয়, গুরুবচন। শিষ্য শচীন তেণ্ডুলকরকে (Sachin Tendulkar) নিয়ে স্মৃতি রোমন্থন করতে গিয়ে যা বলেছিলেন প্রয়াত গুরু রমাকান্ত আচরেকর (Ramakant Achrekar)। ২০১৩ সালে নেওয়া সেই কথোপকথন হুবহু তুলে দেওয়া হল।
মার্চ, ২০১৩। রমাকান্ত আচরেকরের বসার ঘর। টিভি থেকে তাঁর দূরত্ব কতটুকু হবে? মেরেকেটে তিন ফুট। স্বল্পপরিসর ঘরে (বসার ঘরের আয়তন বড়জোর একশো স্কোয়্যার ফুট) বিছানার এককোণে বসে তিনি। লাল শার্ট আর শর্টস পরে। এক মনে টিভিতে ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট সিরিজের শেষ ম্যাচ দেখছেন। লোকে ইচ্ছেমতো ঘরে ঢুকছে, বেরোচ্ছে। কিন্তু রমাকান্ত আচরেকরের চোখ টিভি থেকে একচুল সরছে না। প্রতিটা মুহূর্ত, প্রতিটা বিষয় মস্তিষ্কে নিখুঁতভাবে ঢুকে পড়ছে যেন।
রমাকান্ত আচরেকরের বাড়িটা শিবাজি পার্ক থেকে ঢিলছোড়া দূরত্বে। বাড়িতে ঢুকলে মনেই হবে না, এটা শচীন তেণ্ডুলকরের ক্রিকেট-গুরুর বাড়ি। কোথাও কিছু নেই তো শুধু একটা ছবি ছাড়া। যেখানে কিছু বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গুরুর পিছনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন শচীন। ছবিটাও টিভি থেকে বেশ কিছুটা দূরে, উপরের দিকে রাখা। একটা মিনিয়েচার ব্যাট-সহ।
রমাকান্ত স্যরের বয়স তখন আশি বছর চার মাস। কথাবার্তা খুব কম বলেন। কিন্তু শচীনের প্রসঙ্গ উঠলে চেষ্টা করেন অনেক কিছু বলতে। ‘‘একই তো আছে শচীন, এতটুকু বদলায়নি। এখনও ও আমার বাড়ি আসে, আমার আশীর্বাদ নিয়ে যায়। আমি খুব বেশি কথা বলতে পারি না ওর সঙ্গে। কিন্তু শচীন ক্রিকেট নিয়ে টানা কথা বলতে থাকে আমার সঙ্গে,’’ বলতে থাকেন আচরেকর স্যর।
সেই সময় সবেমাত্র ম্যালেরিয়া থেকে সেরে উঠেছিলেন আচরেকর স্যর। বলছিলেন যে, অস্ট্রেলিয়া সিরিজের আগে শচীন এসেছিলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। “ক্রিকেট নিয়ে কথা বলার মাঝে আমার শরীর-স্বাস্থ্য নিয়ে প্রচুর খোঁজখবর করত শচীন। এমনকী, বাইরে সফরে গেলেও আমার মেয়ে কল্পনাকে ফোন করে আমার ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করে ও। আর মুম্বইয়ে থাকলে তো শচীন আর অঞ্জলি প্রায়ই আসে দেখা করতে,” বলে দেন আচরেকর। বলার সময় ঠোঁটে চকিত হাসি খেলে যায় যাঁর। আসলে টিভিতে তখন শচীন স্প্রিন্ট টেনে একটা বল বাউন্ডারি লাইন থেকে উইকেটকিপারের কাছে পাঠাচ্ছেন।
শচীন আর রমাকান্ত আচরেকরের একলব্য-দ্রোণাচার্যের কাহিনি ভারতীয় ক্রিকেটে লোকগাথা। সে বিভিন্ন মাঠে আচরেকর স্যরের নিজের স্কুটারে শচীনকে বসিয়ে ম্যাচ খেলতে নিয়ে যাওয়াই হোক কিংবা অপরাজিত থাকলে ছাত্রকে এক টাকা উপহার দেওয়া– সবাই সব জানে এতদিনে। প্রথম দিকে শচীন প্রায় গোটা দিনই পড়ে থাকতেন আচরেকর স্যরের বাড়িতে। যে কারণে তাঁর দুই কন্যা বিশাখা এবং কল্পনার সঙ্গে সখ্যও গড়ে উঠেছিল। জনশ্রুতি হল, শচীনের টেস্ট অভিষেকের পরেও আচরেকর কন্যাদের সঙ্গে টেবল টেনিস খেলতেন শচীন এবং তাঁরা নাকি শচীনকে একবার হারিয়েও দিয়েছিলেন।
কল্পনা– যিনি কিনা থাকতেন দ্রোণাচার্য পিতার পাশে দাঁড়িয়ে বলছিলেন, “শচীনের ক্রিকেটের প্রতি অধ্যবসায় দেখার মতো। এমনকী, ওয়ান ডে ক্রিকেট থেকে অবসর নেওয়ার পরেও বাবার সঙ্গে কথা বলেছে ফোনে।” আর আশি বছর বয়সেও আচরেকরের জীবনে ক্রিকেটই এক এবং একমাত্র আরাধ্য ছিল। “লোকজনের সঙ্গে মিশতে খুব পছন্দ করেন বাবা। বাড়িতে বসে থাকতে একদমই পছন্দ করেন না। আমরা মাঝে মাঝেই বাবাকে নিয়ে আলিবাগ চলে যাই ড্রাইভ করে,’’ বলতে থাকেন কল্পনা।
কথাবার্তা চলার মাঝে টিভিতে হঠাৎই বিজ্ঞাপন দেখাতে শুরু করল এবং আচরেকর স্যর এবার ঘুরে বসলেন। শচীনের জন্মদিন নিয়ে কথা হচ্ছিল তখন। আচরেকর বলে উঠলেন, “আমি শুধু ওকে বলি, ব্যাটের সঙ্গ কখনও ছাড়বি না। আমি শুধু চাই, যতদিন সম্ভব খেলে
যাক শচীন।”
সংক্ষিপ্ত কথাবার্তা শেষে স্যরের একটা ছবি তুলতে গেলে উনি বাধা দিলেন প্রথমে। কারণ– উনি নিজের বিখ্যাত খয়েরি টুপিটা খুঁজছিলেন। ওঁর কন্যা নীল টুপিটা এনে দিলেন খুঁজে, কিন্তু ঠিক যেন মনঃপুত হল না। নাতিকে বললেন, ব্রাউন টুপিটা নিয়ে আসতে। শেষে সেই টুপি পরে দরাজ হাসি হেসে ছবি তুললেন। আর সব মিটিয়ে আমরা যখন ওঁর বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে আসছি, উনি ফের ডাকলেন পিছন থেকে। এবার বললেন, ‘‘শচীনের উচিত আরও কয়েকটা সেঞ্চুরি করা।” আসলে সমস্ত ভারতবাসীর মতো রমাকান্ত আচরেকরও চাইছিলেন, তাঁর প্রিয় শিষ্য ব্যাট দিয়ে জাদু সৃষ্টি করে যান। চিরকাল।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.