মা বলে তাঁকে ডাকতেন শচীন তেণ্ডুলকর (Sachin Tendulkar)। ২০১৩ সালে শচীনের চল্লিশতম জন্মদিনের আগে তাঁকে নিয়ে মন খুলে কথা বলেছিলেন সুরসম্রাজ্ঞী লতা মঙ্গেশকর (Lata Mangeshkar)। কিংবদন্তি শিল্পী যা বলেছিলেন, তা তুলে দেওয়া হল এই প্রতিবেদনে।
শচীন আমাকে মা বলে ডাকে। আর যখন সেটা ডাকে, খুব ভাল লাগে। আমার সবচেয়ে ভাল লাগে শচীনের নম্র, ভদ্র ব্যবহার। খুব আস্তে কথা বলে শচীন, সব সময় একটা আভিজাত্য ছেয়ে থাকে ওকে। কখনও দেখিনি শচীন গলা চড়িয়ে কারও সঙ্গে কথা বলছে। যা কি না একজন মানুষের বিরাট গুণ। এখানে স্বীকার করি, ক্রিকেট আমি দারুণ কিছু বুঝি না। আমি বুঝি, শচীন খেলছে, নাকি খেলছে না? শচীন আউট হয়ে গেলে আমি টিভি বন্ধ করে দিই। ক্রিকেট নামক খেলাটার শাশ্বত যে বিষয়গুলো আছে, যা কিছু ভাল আছে, আমি শচীন দিয়ে তার বিচার করি।
সত্যি বলতে, টিভিতে শচীনের খেলা দেখার সময় আমি আমার আইপ্যাডে ছবি তুলতে থাকি। এটা করতে আমার দারুণ লাগে। পরে সেই সমস্ত ছবি দেখতে দেখতে শচীনের পুরনো ইনিংসে আবার ফিরে যেতে পারি আমি। বলতে পারেন, এটা তো শিশুসুলভ কাজ। কিন্তু শচীনের ব্যাটিং আমাদের সবাইকে শিশুতে রূপান্তর করে দেয় না কি?
আমাদের দু’জনের পেশাতেই সৎ থাকাটা সর্বপ্রথম জরুরি। যদি প্রভাব সৃষ্টি করতে হয়, যদি ছাপ রেখে যেতে হয়। শচীনকে দেখলে আপনারা বুঝতে পারবেন, কী বলতে চাইছি। ওর ক্রিকেটটা অসম্ভব শুদ্ধ। সাফল্যের কোনও শর্টকাট রাস্তা হয় না, আর তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ শচীন। সব সময় নিজের খেলা নিয়ে অক্লান্ত পরিশ্রম করে গিয়েছে শচীন, আর দেশের জন্য সব সময় নিজের সেরাটা দিয়েছে। আপনি যখন দেশের প্রতিনিধিত্ব করছেন, তখন প্রত্যেক দেশবাসীর প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা থাকে। শচীন সেটা ডিস্টিংশন সমেত গোটা জীবন জুড়ে করে গিয়েছে। মানছি, কখনও কখনও ব্যর্থ হয়েছে শচীন। সে আমরা তো সবাই হই, তাই না? প্রতিদিন সবার ভাল যায় না। কিন্তু শত খুঁজেও আপনি একটা উদারহণ পাবেন না, যে দিন প্রচেষ্টায় একশো শতাংশ দেয়নি শচীন। দেশের উঠতি ক্রিকেটারদের বলতে চাই শচীনকে অনুসরণ করা উচিত। ওর শৃঙ্খলা, ওর ওয়ার্ক এথিক দেখে শেখা উচিত।
শচীন প্রায়শই আমাকে বলে যে, সফর চলাকালীন আমার গান শুনতে ভালবাসে ও। যা ওকে বিভিন্ন ক্ষেত্রে অনুপ্রেরণা জোগায়। ও যখন ট্র্যাভেল করে কিংবা নিজের রুমে একা একা নিজেকে প্রস্তুত করে, আমার গান শোনে। ও এ ভাবে ভাবে দেখে দারুণ লাগে আমার। আমার গান যদি দেশের হয়ে শচীনকে আরও ভাল পারফর্ম করতে সাহায্য করে, সেটা আমার কাছে গর্বের ব্যাপার। আমাদের সবার উচিত নিজেদের মতো করে শচীনকে আরও শক্তি জোগানো। কারণ ও যা করছে, আমাদের সবার জন্য করছে।
এক এক সময় মনে হয়, খেলার জন্যই শচীনের জন্মগ্রহণ হয়েছিল। চব্বিশ বছর ধরে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে খেলা চালিয়ে গিয়েছে ও। শচীন ওয়ান ডে ক্রিকেট ছেড়ে দিল যখন, মনঃপুত হয়নি আমার। যেহেতু ওর খেলাটার প্রতি খিদে কখনও কমেনি, তাই ওর উচিত ছিল যত দিন উপভোগ করছে, তত দিন টেস্ট খেলা চালিয়ে যাওয়া। আমি এটাও মনে করি, ক্রিকেট ছাড়ার পর (মতামত সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত) শচীনের কোনও না কোনও খেলা খেলে যাওয়া উচিত। পূর্ণ দায়বদ্ধতা-সহ নিজের জীবনে খেলা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করেনি শচীন। তাই ও যা করতে ভালবাসে, সেটা ছেড়ে দেওয়া ঠিক নয়।
পারফর্মার হিসেবে ভেবে ভাল লাগে যে, শচীনকে আমি আমার গান দিয়ে আনন্দ উপহার দিয়েছি। নীতা আম্বানির বাড়িতে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানের কথা মনে পড়ছে। যেখানে আমি আর শচীন দু’জনেই আমন্ত্রিত ছিলাম। শচীনের শততম সেঞ্চুরি সেলিব্রেট করছিলাম আমরা। আর সেখানে শচীন নিয়ে আমাকে কয়েকটা কথা বলতে বলা হয়। আমি আমার বক্তব্য শেষ করার পর শচীন আমাকে অনুরোধ করে যে, ‘তু যাঁহা যাঁহা চলেগা, মেরা সায়া সাথ হোগা’ গানটার কয়েকটা লাইন গাইতে। ‘মেরা সায়া’ সিনেমার গান। শচীন বলেছিল, গানটা ওর জীবনের অন্যতম প্রিয় গান। আমি গেয়েছিলাম কয়েকটা লাইন সেই গানের। ভালও লেগেছিল গানটা গেয়ে।
আমি শচীনকে শুধু কয়েকটা কথা বলতে চাই। কখনও জীবনে ভারসাম্য হারিও না, কখনও মূল্যবোধ থেকে সরে যেও না। আর সব সময় মনে রেখো, তুমি কী করে শচীন তেণ্ডুলকর হয়েছিলে, আর তুমি যা ভালবাসো, সেটা করা কখনও থামিয়ে দিও না। আমি মনে করি, দেশকে শচীনের অনেক কিছু এখনও দেওয়ার আছে। শচীনের জীবন তো শুরু হয়েছে সবেমাত্র! শুভ জন্মদিন শচীন। আমি আমার এই সন্তানের জন্য চিরকাল গর্ববোধ করব।(পুরো কথোপকথন অপরিবর্তিত)
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.