কৃশানু মজুমদার: রোহিত শর্মাকে যত দেখছি, ততই মুগ্ধ হচ্ছি। এই রোহিত অবশ্য ব্যাটার নন। ব্যাটসম্যান রোহিত তো আগেই বহুবার জিতে নিয়েছেন হৃদয়।
নতুন করে প্রেমে পড়েছি অধিনায়ক রোহিতের। তিনি দেশের অধিনায়ক। জনগণমনের অধিনায়ক। গোটা দেশের হৃদস্পন্দন এখন তিনিই।
সেই রোহিত বৃহস্পতিবার দারুণ এক ফ্রেমের জন্ম দিলেন। চিরদিনের ফ্রেমে জায়গা করে নিতে পারে এই ছবি। কখনও কখনও একটি ছবি ভাষার থেকেও শক্তিশালী হয়। শব্দেরাও হার মানে ছবির কাছে। একটা ছবি অনেক কথা বলে দিয়ে যায়। পুণের মাঠে বাংলাদেশকে হারানোর পরে রোহিত-বিরাট-রাহুলের মিলনান্তক ছবি সেরকমই একটা ফ্রেম।
তিন তারকার নির্মল হাসির ছবি দেখে মনে পড়ছিল জনপ্রিয় গানের সেই লাইনগুলো, ‘আমাদের গল্পগুলোর লাগাম ছাড়া স্বপ্ন ছিল…।’ ওই ছবিতে রয়েছে বিশ্বজয়ের স্বপ্ন, রয়েছে সমষ্টির গান, রয়েছে একযোগে এগিয়ে চলার বার্তা। ওই ছবি তুলে ধরছে এক সুখী পরিবারের গল্প।
পঞ্চমীর রাতে মুশফিকুরদের উড়িয়ে দেওয়ার পরে হাজার ওয়াটের হাসি নিয়ে রোহিত জড়িয়ে ধরেছেন তাঁর দুই কমরেড- বিরাট কোহলি ও লোকেশ রাহুলকে।
‘হিটম্যান’ তাঁর ইনস্টাগ্রামে সেই ছবি পোস্ট করে লিখলেন, ‘টুগেদার ইন।’
View this post on Instagram
বিরাট-রাহুলকে সঙ্গে নিয়ে ভুবনজয়ের অঙ্গীকার কি করলেন না ভারত অধিনায়ক? হয়তো তাই। সেই উত্তর আপাতত সময়ের গর্ভে। ১৯ নভেম্বরের এক রঙিন-মায়াময় রাতের স্বপ্ন কি এখন থেকেই দেখছে না গোটা দেশ? দেখছে তো নিশ্চয়। প্রতিটি হার্ডল টপকে যাওয়ার মুহূর্তেরা জন্ম দিয়ে যাচ্ছে একেকটা স্বপ্নের। পুণের মাঠে ভারতীয় ক্রিকেটের থ্রি মাস্কেটিয়ার্সের ছবি মনে করিয়ে দিচ্ছে সেই বিখ্যাত লাইন, ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড।’ একতায় উত্থান। একসঙ্গে থেকে সব জিতে নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেল এই ছবি।
চলতি বিশ্বকাপে দারুণ গতিতে দৌড়তে থাকা ভারতের জয়রথ দেখে মনে পড়ে যাচ্ছিল, চার বছর আগের এক বিশ্বকাপের কথা। বিলেতের মাটিতে অনুষ্ঠিত সেই বিশ্বকাপের মাঝামাঝি সময়ে খবর ছড়িয়ে পড়েছিল, কোহলির সংসারে ভাঙন ধরেছে। এক দলের নেতৃত্বে রোহিত। আরেক দলের ক্যাপ্টেন বিরাট। একই শিবিরে দুটো দল।
গোটা ভারতে থিওরি ছড়িয়ে পড়েছিল বিরাট ও রোহিতের ব্যক্তিত্বের সংঘাত রয়েছে। সেই ব্যক্তিত্বের সংঘাতের বস্তাপচা থিওরিকে ভুল প্রমাণ করতে উদ্যত হয়েছিলেন স্বয়ং রোহিতই।
এই থিওরির সত্যিই কি কোনও ভিত্তি ছিল? জনমানসে কিন্তু এমনই এক ধারণা শাখাপ্রশাখা বিস্তার করেছিল। মনে পড়ছে, অস্ট্রেলিয়ায় অনুষ্ঠিত টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ওই ঐতিহাসিক ম্যাচের কথা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ ৮ বলে ২৮ রান দরকার ভারতের। ড্রেসিংরুম উদ্বিগ্ন। রোহিত চিন্তিত। আলুথালু চুল তাঁর। মুম্বইকর কিছুই বুঝে উঠতে পারছেন না। ততদিনে ক্যাপ্টেনের আর্মব্যান্ড বিরাটের কাছ থেকে চলে এসেছে রোহিতের হাতে। অসহায় অধিনায়কের ‘তুরুপের তাস’ কোহলি তখনও লড়ে যাচ্ছেন বাইশ গজে। যতক্ষণ শ্বাস, ততক্ষণ আশ। গোটা দেশের বিরাট-চাপ কোহলির কাঁধে। অসম্ভবকে সম্ভব করলেন বিরাট। তার পরের দৃশ্য কোহলি ঘুসি ছুড়ছেন শূন্যে। কোথা থেকে ছুটে এসে রোহিত কাঁধে তুলে নিলেন কোহলিকে। ওই জড়িয়ে ধরা, কাঁধে তুলে নাচার মধ্যে নেই কোনও অভিনয়, নেই ভণিতা। একেবারে হৃদয়ের টানেই অধিনায়ক রোহিতের পিঠে কোহলি। সেই দৃশ্য দেখে কে বলবে দুজনের মধ্যে ইগো-সমস্যা রয়েছে!
কাট টু পুণে। কোহলির উপরে প্রচারের সার্চলাইট। সেঞ্চুরি করলেন, দেশকে জেতালেন, ম্যাচের সেরা হলেন, শচীন তেণ্ডুলকর নামের এক কিংবদন্তির কক্ষপথের আরও কাছে পৌঁছনোর ইঙ্গিতও দিয়ে রাখলেন। নিজের ৪৮-তম ওয়ানডে সেঞ্চুরি করতে তখন আর ১৫ রান দরকার বিরাটের। বাংলাদেশ জয় করতে ওই ১৫ রানই যে ভারতেরও দরকার। তার পরে এক অন্য ‘চেজমাস্টার’কে দেখল পুণে। সেই কোহলি নিজের সেঞ্চুরি পূর্ণ করার জন্য ধাওয়া করছেন ১৫ রান।
সিঙ্গলকে ডাবলসে পরিণত করছেন। বাউন্ডারি মারছেন। গ্যালারি গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে। উত্তেজনা-উন্মাদনা ছড়িয়ে পড়েছে দর্শকদের শিরায়-উপশিরায়। চেয়ারে এলিয়ে বসে থাকা রোহিতের মেরুদণ্ড দিয়েও তখন উত্তেজনার স্রোত বয়ে চলেছে প্রবল গতিতে। উঠে পড়েছেন তিনি। কোহলির প্রতিটি রান তাঁকেও রোমাঞ্চিত করে চলেছে। অধিনায়কের মুখে খেলা করছে মন ভোলানো হাসি। উইকেটের অন্য প্রান্তে দাঁড়ানো লোকেশ রাহুল দর্শকের ভূমিকায় পর্যবসিত হয়েছেন।
এক যুগ আগের এক বিশ্বকাপ ফাইনালে কুলশেখরকে গ্যালারিতে ফেলে মহেন্দ্র সিং ধোনি বিশ্বকাপ হাতে তুলে নিয়েছিলেন। বাংলাদেশি বোলার নাসুম আহমেদকে গ্যালারিতে ছুড়ে দিয়ে পুণেতে বিরাট-সেঞ্চুরি হাঁকালেন কোহলি। ওই ছক্কাও আইকনিক হয়ে থাকল ভারতীয় ক্রিকেটের ইতিহাস বইতে।
সিংহনাদ করছেন কোহলি। ড্রেসিং রুম থেকে তরতরিয়ে দৌড়ে মাঠে নেমে এলেন রোহিত। জড়িয়ে ধরলেন রাহুল আর কোহলিকে। রোহিতের ওই ছবি মুহূর্তে মনে করিয়ে দিল বিখ্যাত সেই কবিতার লাইন, ”আয় আরও হাতে হাত রেখে, আয় আরও বেঁধে বেঁধে থাকি।”
দারুণ এক বন্ধনে আবদ্ধ রোহিতের ড্রেসিং রুম। তার প্রতিফলনও দেখা যাচ্ছে সবুজ মাঠে। প্রতিপক্ষের ব্যাটারকে ফেরানোর পরে জোটবদ্ধ ভারতীয় ক্রিকেটারদের হাসি বলে দিচ্ছে যথার্থ অর্থেই ‘টিম’ হয়ে উঠেছে এই ভারত। রোহিতের সংসারে ‘আমি’ বলে বিচ্ছিন্ন কোনও দ্বীপ নেই। রয়েছে ‘আমরা’। সাজঘরে অনুরণিত হয়, ‘আমরা করব জয়।’
রোহিতের চুলের বাহার নেই। গালভর্তি দাড়ি। মাঝে মাঝে পার্থিব এই জগৎ থেকে হারিয়ে যান তিনি। উপহাস করে কেউ কেউ তাঁকে বলে থাকেন, ‘বড়া পাও’। মুম্বইকরের সারা শরীর জুড়ে নেই ট্যাটু। তাঁর ‘থলথলে’ শরীরে নেই সিক্স প্যাকও। আকাশছোঁয়া সব সেঞ্চুরির পরেও তাঁকে নিয়ে হয় না বীরপুজো।
রোহিত শর্মা আসলে মহাকাব্যের সেই কর্ণ চরিত্র। ঝাড়বাতির আলো তাঁর উপরে এসে পড়ে না। নীরবে নিভৃতেই স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে যান মুম্বইকর। রোহিত-আলোর খোঁজে এখন দেশ। গোটা দেশের অদৃশ্য রিং টোন, ‘জ্বালাও আলো, আপন আলো, শুনাও আলোর জয়বাণীরে।’
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.