সুমন্ত চট্টোপাধ্যায়: ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’। দেশবিভাগ পরবর্তী সময়ে ভাষা আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে যে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল ‘ওপার বাংলা’য়, তার প্রত্যক্ষ প্রভাব ছিল ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে। আর সেই সংগ্রামে পাকিস্তান (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান), অধুনা বাংলাদেশের (সেসময়ের পূর্ব পাকিস্তান) সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েছিল ভারতও। বিশেষ করে, কলকাতা।
সময়ের দিনলিপি থেমে থাকেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর কেটে গিয়েছে ৫২ বছর। এই বাহান্ন বছরে বদলেছে অনেককিছু। পাকিস্তান (Pakistan), বাংলাদেশের (Bangladesh) পারস্পরিক রাজনৈতিক আবর্তের প্রভাব পড়েছে দু’দেশের ক্রিকেট-যুদ্ধেও। ২২ গজে যখনই মুখোমুখি হয়েছে দু’দল, উত্তেজনার চোরাস্রোত ডিঙিয়ে ‘বিনা যুদ্ধে সূচাগ্র মেদিনী’ না দেওয়ার উগ্র মেজাজ প্রতিফলিত হয়েছে ক্রিকেটারদের শরীরীভাষায়। ’৯৯-এ বিশ্বকাপের আসরে আবির্ভাবে পাকিস্তানকে হারানোটাও ছিল বাংলাদেশের কাছে এক স্বাধীনতা সমতুল্য, এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত।
কিন্তু সেই সোনালি অতীত, দু’দেশের ক্রিকেটযোদ্ধাদের মধ্যে আজ কতটা প্রাসঙ্গিক? কতটা জেতার উদগ্র বাসনা তৈরি করতে সক্ষম? প্রশ্ন উঠতেই পারে। সোমবার ইডেনের ছবিটা তেমনই যে অশনিসংকেত দিচ্ছে। বিশ্বকাপে পাকিস্তান-বাংলাদেশ (Pakistan vs Bangladesh) ম্যাচ মানেই অন্য আবহ। ‘যুদ্ধং দেহী’ মেজাজ তো থাকেই। পাশাপাশি দু’দলের মধ্যে মর্যাদার লড়াইয়ে জেতার বাড়তি তাগিদ কাজ করে। নিছক দু’পয়েন্টের অঙ্ক ভুলে ম্যাচটা জেতার জন্য ঝাঁপান পাকিস্তান-বাংলাদেশ দু’দেশের প্লেয়াররা।
এটাই দস্তুর।
তবে সোমবারের ইডেন যেন বার্তা দিয়ে গেল, সেকাল আর একালের মধ্যে আকাশপাতাল তফাত। এমনিতেই চলতি বিশ্বকাপে দু’দলের পারফরম্যান্সই তথৈবচ। টানা চার হারে বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের মুখে দাঁড়িয়ে পাক দল। বাংলাদেশের অবস্থা আরও খারাপ। টানা পাঁচ হারে বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে খেলার স্বপ্ন নির্বাপিত। ধারাবাহিক খারাপ পারফরম্যান্সটাই কোথাও যেন বিমর্ষতার চাদর বিছিয়ে দিয়েছে ক্রিকেটারদের উপর। সঙ্গে যোগ হয়েছে অন্তর্কলহ। এসব দেখে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন সমর্থকরাও। তবু পাক দলের প্র্যাকটিস দেখতে জনাকয়েক অত্যুৎসাহী ভিড় জমিয়েছিলেন গ্যালারিতে। তাদের আবদার মিটিয়ে সেলফিও তুললেন শাহিন, বাবররা। কিন্তু বাংলাদেশের প্র্যাকটিসের সময় খাঁ খাঁ করল নন্দনকাননের গ্যালারি। দৃষ্টিকটুভাবে।
নিরুত্তাপ ইডেনের মতোই আশ্চর্যরকম নির্জীব দেখাল পাক অধিনায়ক বাবরকে। প্র্যাকটিসেও ফকর জামান, হাসান আলি, রিজওয়ানরা যখন স্বতঃস্ফূর্ত, তখন নিরুত্তাপ তিনি। আসলে হারের ঘূর্ণিপাকে ঘরে-বাইরে প্রবল চাপে রয়েছেন বাবর। বিশ্বকাপ জয় করে দেশে ফিরতে চাওয়া পাক অধিনায়কের নেতৃত্বের তাজ বাঁচানোই এখন সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ। বাবরের চেনা পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন প্রতিপক্ষ অধিনায়ক শাকিবও। এদিন কাঁধের চোটযন্ত্রণা শাকিবকে ঘিরে আরও উদ্বেগ বাড়ালো। ব্যথা কমাতে বেশ কয়েকবার ফিজিও-কে ডেকে নিলেন মাঠে। তার ফাঁকেই ডুবে থাকলেন ব্যাটিং-প্র্যাকটিসে। সাংবাদিক সম্মেলনে শাকিবের কথায় স্পষ্ট যে, বিশ্বকাপে যাবতীয় আশা বিসর্জন দিয়েছেন। বলে গেলেন, “শেষ তিন ম্যাচে জয় ছাড়া আমরা আর কিছু ভাবছি না। প্রথম আটে শেষ করতে না পারলে আমরা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতেও খেলার সুযোগ পাব না। সেটা অর্জন করাই এখন আমাদের লক্ষ্য। নিজেদের ভুলত্রুটি নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি। তবে কথায় নয়, মাঠে নেমে জেতায় বিশ্বাস করি। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেই লক্ষ্যে নামব।”
নেদারল্যান্ডসের কাছে হারের পর বিস্ফোরণ ঘটেছিল শাকিবের। ড্যামেজ কন্ট্রোলে নামতে হয়েছিল বিসিবি-কে। শাকিবের কথায় স্পষ্ট, কাপ-অভিযানে শেষের শুরুটা ভালোভাবে সারতে পারলেই এখন রক্ষে টাইগারদের।
পাক কোচ গ্র্যান্ট ব্র্যাডবার্ন আবার যা বললেন, সেটা ‘শাক দিয়ে মাছ ঢাকা’র শামিল। শুনিয়ে গেলেন, “চারটে হার দিয়ে আমাদের দলকে বিচার করা ঠিক হবে না। বাকি ম্যাচগুলো জিতলে এখনও সেমিফাইনালে যাওয়ার সম্ভাবনা আমাদের রয়েছে।” তারপরেই অদ্ভুত যুক্তি সাজালেন, “দলের কেউ এর আগে এখানে (ভারতে) খেলেনি। পাকিস্তানের প্লেয়াররা আইপিএলে খেলে না। ফলে বিদেশে অচেনা পরিবেশে আমাদের খেলতে হচ্ছে। প্রতিটি ভেন্যু অচেনা, অজানা। সেটাই সমস্যার।”
বিশ্বকাপের আগে আইসিসির ক্রমতালিকায় একনম্বরে থাকা পাকিস্তান এখন তিনে। বিশ্বকাপ জয়ের ফেভারিট তকমা ঝেড়ে ফেলে কোচ ব্র্যাডবার্নের সাফাই, “আমরা কখনোই ফেভারিট ছিলাম না। আইসিসি র্যাঙ্কিং দিয়ে সব বিচার চলে না। আমরা ভারতে এর আগে খেলিনি। তবে বাস্তবটা মেনে নেওয়া ভালো। বিশ্বকাপে (ODI World Cup 2023) আমরা এখনও প্রত্যাশা অনুযায়ী খেলতে পারিনি।”
জয়ের ছন্দে ফিরতে গেলে ব্যাটিং-বোলিংকে বাড়তি দায়িত্ব নিতে হবে মনে করিয়ে দিয়েছেন বাবরদের হেড কোচ। কিন্তু দলের মধ্যে থাকা বিতর্কের চোরাস্রোত সামলে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে টিম পাকিস্তান? উত্তরটা মঙ্গলবারের ইডেনই দিতে পারবে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.