ফাইল ছবি
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: গৌতম গম্ভীর ক্রিকেট ছেড়ে দিয়েছেন বেশ কয়েক বছর হল। বর্তমানে রাজনীতির সঙ্গে ওতঃপ্রোত ভাবে জড়িয়ে থাকেন, ধারাভাষ্য দেন, লেখালেখি করেন মিডিয়ায়। এই তো আইপিএলেও (IPL 2021) প্রতি ম্যাচে গম্ভীরকে স্টার স্পোর্টস কমেন্ট্রিবক্সে দেখা যাচ্ছে। মনে আছে, ইনিই ছিলেন কেকেআরের (KKR) প্রথম আইপিএল জয়ী অধিনায়ক, ন’বছর আগের চিপকে যাঁর অধিনায়কত্বে নাইটরা পেয়েছিল প্রথম আইপিএল ট্রফি?
মনবিন্দর বিসলা আজ কোথায়, কেউ জানে না। গুগল সার্চে এটুকু পাওয়া যায়, তিনি লঙ্কা প্রিমিয়ার লিগে নাম লিখিয়েছেন। কিন্তু ন’বছর আগের ফাইনালে তাঁর ৮৯ রানের ইনিংসটা না থাকলে কেকেআর সে দিন জিতত তো?
ইউসুফ পাঠান অবসর ঘোষণা করে দিয়েছেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় হালফিলে প্রায়ই দেখা যায় সিনিয়র পাঠানকে। সমাজসেবামূলক কাজকর্মে এখন নিজেকে ব্যস্ত রাখেন পাঠান। ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন না বিশেষ। শুধু ২০১২ আইপিএলে ব্যাট নিয়ে তাঁর দাপাদাপির স্মৃতিগুলো পিছু ছাড়ে না আজও। মনোজ তিওয়ারি এখনও ক্রিকেট ছাড়েননি। আসন্ন রনজি ট্রফির প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কিন্তু ক্রিকেটের পাশাপাশি তিনি এখন রাজ্যের ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রীও বটে। অতীতের চেয়ে ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছে প্রচুর, শুধু ক্রিকেট নিয়ে পড়ে থাকলে আর চলে না। আচ্ছা, এই মনোজই ডোয়েন ব্র্যাভোকে শেষ ওভারে চুরমার করে ন’বছর আগে স্বপ্নের স্বাদ কলকাতাকে দিয়েছিলেন না?
ন’টা বছর, আদতে একটা দশকই বলতে গেলে! মাঝের ন’বছরে কত পালটে গিয়েছে পৃথিবী, অতিমারী এসেছে, ঘটে গিয়েছে কত কিছু। আইপিএল পৃথিবীতেও কম কিছু হয়নি। গত ন’বছরে পাঁচবার ট্রফি তুলেছে মুম্বই ইন্ডিয়ান্স, মহেন্দ্র সিং ধোনির চেন্নাই সুপার কিংসের থেকে চির ফেভারিটের তাজ ছিনিয়ে নিয়ে।
কেকেআরও চ্যাম্পিয়ন হয়েছে মাঝে একবার। কিন্তু নাইটদের সেই প্রথম রোমাঞ্চকর আইপিএল ফাইনাল আর কখনও ফিরে আসেনি। গত ন’বছরে আর কখনও হয়নি ধোনি বনাম কেকেআর, কখনও আইপিএল ফাইনালে শহরের জামাইয়ের মুখোমুখি হয়নি শহরের টিম! যা হচ্ছে আবার, এবার, বিজয়া দশমীতে। আজ আবার সেই চিরন্তন ধোনি-ফাইনাল, আজ আবার চেন্নাই বনাম কলকাতা।
আর আবহ দেখুন, আবেগ দেখুন, প্রায় গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠার মতো। মহাষ্টমীর রাতে রাহুল ত্রিপাঠির সপাট ছক্কা যখন আছড়ে পড়ছে শারজা গ্যালারিতে, সল্টলেকের এফডি ব্লকের পুজো প্যান্ডেলের বাইরে যে সমবেত উল্লাস ছিটকে বেরোল, তা ষষ্ঠীরাতের শ্রীভূমির ‘বুর্জ খলিফা’র লেজার শো মনে পড়িয়ে দেবে। গভীর রাতে পাড়ায় পাড়ায় যেভাবে বাজি ফেটেছে, সময় সময় সন্দেহ হবে যে সত্যিই দুর্গাপুজো চলছে তো? নাকি দুর্গাপুজোর আবহে অকাল দীপাবলি এসে গেল! কোনও সন্দেহ নেই, বিজয়া দশমীতে ধোনিকে হারিয়ে তৃতীয়বার ট্রফি এলে কান পাতা দায় হবে বাজির গর্জনে। বিসর্জন-বিষাদ ভুলে নতুন উৎসবের উপকরণ খুঁজে নেবে শহর। কিন্তু উলটোটা হলে? যদি মহেন্দ্র সিং ধোনির হাতে চতুর্থ আইপিএল ট্রফি ওঠে, খুব খারাপও লাগবে কি? কে বলতে পারে, এমএসডি নামক চলমান আবেগকে আগামী বছর আইপিএল খেলতে দেখা যাবে কি না? তখন তো এটাই, এই মুহূর্তটাই চির নস্ট্যালজিক, চির সংরক্ষণের হয়ে থাকবে!
অতএব, আজ সব দিক থেকেই রোম্যান্সের ফাইনাল, স্বপ্নের ফাইনাল। জয়-পরাজয় নির্বিশেষে যা কিনা অপূর্ব এক ভাল লাগা ভালবাসার প্রেক্ষাপট নীরবে তৈরি করছে! ক্রিকেটীয় দিক থেকে নাইটদের নিয়ে দুশ্চিন্তার কয়েকটা জায়গা আছে। ফাইনালটা গত কয়েকটা ম্যাচের মতো শারজার মন্থর পিচে নয়, এ বার দুবাইয়ে। যা নিয়ে মহানবমীর দুপুরে শেষ সিএসকে ফাইনালের ম্যাচ জেতানো মনোজ ফোনে চিন্তিতভাবে বলছিলেন, “শারজা হলে বলতাম, কেকেআর। কিন্তু দুবাইয়ে বলটা ভাল আসে ব্যাটে।”
দুশ্চিন্তা নম্বর দুই, নাইটদের মিডল অর্ডার। তা সে যতই কেকেআর মেন্টর ডেভিড হাসি ব্যাপারটাকে ফুৎকারে উড়িয়ে যান। ঘটনা হল, রাহুলের ছয়ে নাইটরা মহানাটকীয়ভাবে দ্বিতীয় কোয়ালিফায়ারে দিল্লি বধ করেছে বটে, কিন্তু নাটকের আবির্ভাবের তো কথাই ছিল না। ১৩৬ রানের পুঁচকে টার্গেট তাড়া করতে গিয়ে কেকেআর একটা সময় ৯০/০ ছিল। সেখান থেকে কিনা পরপর উইকেট হারিয়ে তিন উইকেটে কষ্টের জয়, মহাষ্টমীর রাতে বাঙালির হার্টফেলের বন্দোবস্ত করে! চার জন, চার জন শূন্য রানে আউট হয়েছেন দিল্লি ম্যাচে! দীনেশ কার্তিক। ইয়ন মর্গ্যান। সাকিব-আল-হাসান। সুনীল নারিন। অশ্বিন ম্যাচের শেষ ওভারে পরপর উইকেট তুলছেন যখন, মনে হচ্ছিল হেরেই না যায় কেকেআর! ডেভিড হাসি তাই মাঝরাতের প্রেস কনফারেন্সে যতই বলে যান, “আমি এতটুকু চিন্তায় ছিলাম না কারণ জানতাম, এরা সবাই জাত প্লেয়ার।”
পুরোটাকেই ছেলেভোলানো ব্যাখ্যা লাগে। কেকেআর অধিনায়ক ইয়ন মর্গ্যান আর কার্তিকের পাশেও নিঃসঙ্কোচে দাঁড়ালেন হাসি। সেটাও বাস্তবকে ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা। কারণ, এই মুহূর্তে একটা অবোধ শিশুও জানে যে, কেকেআর ব্যাটিং বলতে মেরেকেটে সাড়ে তিন জন। শুভমান গিল। ভেঙ্কটেশ আইয়ার। রাহুল ত্রিপাঠি আর কিছুটা নীতিশ রানা। সুনীল নারিন এবং সাকিবকে বেনিফিট অব ডাউট দেওয়া যায় কারণ তাঁরা না খেললে এলিমিনেটরের বৈতরণী পার করে না কেকেআর। কিন্তু মর্গ্যান-কার্তিক? কোন মহান কীর্তিগুণে পরিত্রাণ পাবেন এঁরা?
সবচেয়ে ভয়ের, চল্লিশের কাঁচাপাকা চুলের লোকটা। ব্যাট এখন চলে কালেভদ্রে, কিন্তু মগজ এখনও হীরক খনি। শোনা গেল, নাইট শিবির ন’বছর আগের ফাইনালে সিএসকে-বধ থেকে অনুপ্রেরণা নিচ্ছে। কিন্তু তাতে কাজ হবে তো? কারণ এটুকু নিশ্চিত লেখা যায়, কোনও এক মহেন্দ্র সিং ধোনি মহাষ্টমীর রাতে দিল্লি অধিনায়ক থাকলে শেষ ওভারটা কিছুতেই অশ্বিন পেতেন না। ওটা বরাদ্দ থাকত রাবাডা বা নর্জির জন্য। খুব সংক্ষেপে, বাকিদের কাছে যে ভুল করে মার্জনা হয়, ধোনির কাছে তা আজও হয় না।
ভাল খবর একটাই। হাসি বলে গিয়েছেন যে, আন্দ্রে রাসেল ফাইনালে নামতে পারেন। নামলে খুবই ভাল। কারণ, দশমীর রাতে শেষ দিকে আবার নাইট মিডল অর্ডারে চাপ পড়লে ‘জয় বাবা রাসেলনাথ’ জপ করা ছাড়া বাঙালির আর কোনও উপায় থাকবে তো?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.