বিশ্বদীপ দে: ১৯৯২ সালের মার্চ থেকে ২০২১-এর অক্টোবর। সময়ের হিসেবে ২৯ বছর ৮ মাস। সোজা হিসেবে তিরিশ বছর। পৃথিবী আমূল বদলেছে এই তিন দশকে। ইন্টারনেট, মোবাইল, সোশ্যাল মিডিয়া, ৯/১১, করোনা অতিমারী… সময়ের নানা পোঁচ লেগে বদলের পর বদল পেরিয়ে এসেছি আমরা। এত বদলের মধ্যে ধ্রুবক বোধহয় একটাই। বিশ্বকাপে (World Cup) ভারতকে দেখলেই পাকিস্তানের (Pakistan) দাঁতকপাটি। পঞ্চাশ ওভারের বিশ্বকাপে ৭-০। টি২০ বিশ্বকাপে ৫-০। অর্থাৎ টানা একডজন বিশ্বকাপ ম্যাচের সব ক’টায় জয়। বারবার। লাগাতার। কীভাবে সম্ভব হল এই আশ্চর্য রেকর্ড? আসলে ‘শেষ ভাল যার, সব ভাল তার’, বিখ্যাত প্রবাদটাকে এক্ষেত্রে উলটে বলা যায়, ‘শুরু ভাল যার সব ভাল তার’। ১৯৯২ সালের ৪ মার্চ ইমরানের পাকিস্তানকে সেই যে ৪৩ রানে হারিয়ে দিয়েছিল আজহারের টিম ইন্ডিয়া (তখন অবশ্য ভারতীয় দলকে এই নামে ডাকার চল হয়নি), পাকিস্তানের সামনে তৈরি হয়ে গিয়েছিল এক অচলায়তন। যা আজও ভাঙতে পারেনি তারা।
২৪ অক্টোবর মানে সামনের রবিবার আরও একটা বিশ্বকাপ মহারণে মুখোমুখি দুই প্রতিবেশী। আরও একবার ‘মওকা’ বাবর আজমদের সামনে। সেই ম্যাচের আগে আবারও ফিরে দেখা যাক সিডনিতে হওয়া সেই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচটি। ইতিহাসের খাতায় সেটাই বিশ্বকাপের প্রথম এশীয় ‘অ্যাসেজ’। কি এমন হয়েছিল সেই ম্যাচে? আজও বহু ক্রিকেট রসিক একবাক্যে জানিয়ে দেন, ভারত-পাকিস্তানের নানা হাই ভোল্টেজ ম্যাচের মধ্যে বিরানব্বইয়ের সেই ম্যাচের একটা আলাদা তাৎপর্য রয়েই গিয়েছে।
আসলে ১৯৮৬ সালে অস্ট্রেলেশিয়া কাপের ফাইনালে জাভেদ মিঁয়াদাদের অবিস্মরণীয় ছক্কার ট্রমায় পরের কয়েক বছরে ভারত সেভাবে মাথাই তুলতে পারেনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে। মেগা ম্যাচের ব্যাটনটা রয়েই গিয়েছিল ইমরানের হাতে। শারজার সেই ম্যাচে শেষ বলে দরকার ছিল ৪ রান। নার্ভের অসহ্য অত্যাচারে বেচারি চেতন শর্মার হাত ফসকে লেগস্টাম্পের বাইরে নিচু একটা ফুলটস বল পেয়ে যান মিঁয়াদাদ। চোখের পলকে বলটাকে গ্যালারিতে উড়িয়ে ব্যাট তুলে ছুটতে শুরু করেন পাকিস্তানের কিংবদন্তি ব্যাটসম্যান। উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়া পাকিস্তানের ক্রিকেটারদের সামনে মাথানিচু, মুখচুন ভারতীয় ক্রিকেটারদের দেখলে কে বলবে সেই মুহূর্তে একদিনের ক্রিকেটে বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তারাই। আগের বছর এই পাকিস্তানকে হারিয়েই তারা জিতে নিয়েছে বেনসন অ্যান্ড হেজেস কাপ, যাকে বলা হয়েছিল মিনি বিশ্বকাপ। মুহূর্তে যেন সব আত্মবিশ্বাস আকস্মিক ছক্কার ব্লটিং পেপার শুষে নিয়েছে!
সেই ভ্যাবাচ্যাকা হার যেন এক ভূত হয়ে চেপে বসেছিল ভারতের ঘাড়ে। তাই পাকিস্তানকে দেখলেই কোথায় একটা তাল কেটে যেত তাদের। সেই কারণেই বিশ্বকাপের প্রথম ভারত-পাকিস্তান ম্যাচের আগে প্রায় সব ক্রিকেট বিশেষজ্ঞই একমত ছিলেন, আর যাই হোক এই ম্যাচটায় ইমরান-আক্রম-মিঁয়াদাদরাই শেষ হাসি হাসবেন। ম্যাচের ঠিক আগে তাই এটা নিয়ে কারও মাথাব্যথা ছিল না কারা জিতবে। আলোচনা চলছিল পাকিস্তানের জয়ের ব্য়বধান নিয়ে!
এমনিতে প্রতিযোগিতায় দুই দলই তখন বেকায়দায়। মাত্র তিন দিন আগেই ইংল্যান্ডের সঙ্গে ৭৪ রানে অলআউট হয়েও বৃষ্টির জন্য হার এড়াতে পেরেছে পাকিস্তান। ওদিকে ইংল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়ার কাছে জেতা ম্যাচ খুইয়েছে ভারত। এই পরিস্থিতিতে সিডনিতে টসে জিতে ব্যাটিংয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আজহার। সেই সময় যে কোনও চাপের ম্যাচেই টসে জিতে আগে ব্যাটিং করে নিতে চাইতেন অধিনায়করা। রান তাড়া করার টেনশনটা এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু তা বলে প্রথমে ব্যাট করার টেনশন কি কম? ওই যে, মিঁয়াদাদের ছক্কার ধাক্কা! যেন নীরব ঘোষণা, যতই রান করো, তুলে দেবই। টেনশন কী পরিমাণে ছিল, তার সবচেয়ে বড় উদাহরণ কৃষ্ণমাচারী শ্রীকান্ত। মারকুটে শ্রীকান্ত ছিলেন ওয়ানডের আদি যুগে পিঞ্চ হিটার ওপেনার। অদ্ভুত সব শট মেরে চমকে দিতেন। সেই তিনিই কিনা ওই ম্যাচে ঠুকঠুক করে করলেন ৩৯ বলে ৫!
ক্রিজে এসে জমে গিয়েও বিশ্রী আউট হয়েছিলেন আজহার। বরং নবাগত অজয় জাদেজা ৪৬ রানের ইনিংস খেলে ভালই লড়াই দিয়েছিলেন। কিন্তু ম্যাচের সেরা জুটি নিঃসন্দেহে শচীন-কপিল। কপিল যখন নামেন, ততক্ষণে খেলা পৌঁছে গিয়েছে শেষ লগ্নে। যে মুস্তাক আহমেদ বিনোদ কাম্বলি ও সঞ্জয় মঞ্জরেকরকে দ্রুত ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, সেই মুস্তাককেই কভারের উপর দিয়ে বিশাল ছক্কা ও চার মেরে চমকে দেন কপিল। করে যান ২৬ বলে ৩৫। কপিলের মার মার ভঙ্গিতে নিঃসন্দেহে ঘাবড়ে গিয়েছিল পাকিস্তান।
কিন্তু ম্যাচের আসল নায়ক ছিলেন শচীন তেন্ডুলকর (Sachin Tendulkar) নামের এক কিশোর। ৬২ বলে অপরাজিত ৫৪। বাউন্ডারি ৩টি। কিন্তু এটুকু দিয়ে কিছুই বোঝানো যাবে না। এক অষ্টাদশ বর্ষীয় বালকের জাদুস্পর্শেই যেন ভারতের ভিতরে থাকা আগ্রাসী দৈত্য জেগে উঠেছিল। মিঁয়াদাদের অতিকায় ছক্কার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে শচীনের মতো ম্যাজিশিয়ানকেই দরকার ছিল আসলে। লিটল মাস্টার কী ‘জিনিস’, আগেই জানত পাকিস্তান। ১৬ বছর বয়সেই আবদুল কাদিরকে বলে বলে ছক্কা মেরেছিল যে কিশোর, তরুণ বয়সে তাঁকে আরও আগে নামাতেই পারতেন আজহার। হয়তো তাতে ভারতের স্কোর আরও বাড়ত। তবে যেটুকু দায়িত্ব পেয়েছিলেন তাতেই কামাল করেছিলেন শচীন। শেষ ২০ ওভারে ভারতকে এগিয়ে নিয়ে যেতে তাঁর ব্যাটই হয়ে উঠেছিল অতিকায় এক ছাতা। ভারত পৌঁছেছিল ৭ উইকেটে ২১৬ রানে। সেই আমলে আড়াইশো রানকে ধরা হত চ্যালেঞ্জিং। ২১৬ সেই নিরিখে খুব খারাপ রান না হলেও পাকিস্তানের শক্তিশালী ব্যাটিংয়ের কাছে কি তা আদৌ অধরা থাকার মতো? এই প্রশ্ন জাগছিল দর্শকদের মনে।
পাকিস্তানের ইনিংসে সবচেয়ে বেশি অপ্রতিরোধ্য লেগেছিল আমির সোহেলকে। ১৭ রানে ২ উইকেট পড়ে যাওয়ার পরে অভিজ্ঞ মিঁয়াদাদের সঙ্গে জুটি বেঁধে তিনিই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন পাকিস্তানকে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সেই আমিরকেও ফিরিয়ে দিয়েছিলেন শচীনই। ব্যাট হাতে তাঁর দাপট নাকি বল হাতে আমির-নিধন, কোনটা পাকিস্তানের কফিনে আসল পেরেকটা পুঁতেছিল তা নিয়ে তর্ক চলতেই পারে। ‘ম্যান অফ দ্য ম্যাচ’ বাছতে তাই পরিশ্রম করতে হয়নি আয়োজকদের।
এবং মিঁয়াদাদ। যাঁর ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ ছক্কায় ভারতের ট্রমার শুরুয়াৎ তাঁর ১১০ বলে ৪০ রানের ঢিমে তালের ইনিংসেই লেখা রইল পাকিস্তানের পরাজয়ের ইতিকথা। শ্রীনাথের ইয়র্কার তাঁর ব্যাট-প্যাডের গোড়ায় বিস্ফারিত হওয়ার আগেই আসলে তিনি ‘আউট’ হয়ে গিয়েছিলেন। টানা তাঁকে সামনের পায়ে খেলিয়ে যাচ্ছিলেন ভারতীয় বোলাররা। কিছুতেই ফিল্ডিংয়ের ফাঁকফোকর খুঁজে পাচ্ছিলেন না তিনি। শেষে মেজাজ হারিয়ে কিরণ মোরেকে ব্য়াঙ্গ করে ব্যাং লাফও লাফিয়েছিলেন। সেই ছবিটাই যেন ম্যাচের প্রতীকী ছবি। বেসামাল পাকিস্তানের সামনে স্থিতধী ভারত। যারা এতদিন পরে ফিরে পেয়েছে চির প্রতিদ্বন্দ্বীর সঙ্গে লড়াইয়ের অমোঘ কম্পাস। অন্তত বিশ্বকাপের নিরিখে যা আর দিক ভুল করবে না পরবর্তী তিন দশকে।
সাধে কি আর ম্যাচশেষে কপিল দেব বলেছিলেন, ”পাকিস্তানের সঙ্গে লিগ ম্যাচের জয়টাই ওই বিশ্বকাপে আমার শ্রেষ্ঠ স্মৃতি। সেবারের খুব বেশি পজিটিভ স্মৃতি নেই। কিন্তু মানতেই হবে সেই দলকে আমরা হারিয়ে দিয়েছিলাম যারা ট্রফিটা জিতেছিল।” এই তৃপ্তি, এই প্রাপ্তির দর্পই ভারতকে বাড়তি মনোবল জুগিয়ে এসেছে বিশ্বকাপের পর বিশ্বকাপ। আর পাকিস্তানের মনোবলকে করে দিয়েছে দুর্বল। এক ‘মওকা’ থেকে আরেক ‘মওকা’- জয়ের পরশপাথর খুঁজে বেড়ানোই সার হয়েছে তাদের। সিডনির জয়কেই ক্রমশ প্রসারিত করে চলেছে ভারতীয় ক্রিকেট।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.