অনুশীলনে রাহানে। ছবি: সায়ন্তন ঘোষ
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: অজিঙ্ক রাহানেকে যাঁরা জানেন-চেনেন, ছত্রিশ বছর বয়সে ভারতীয় ব্যাটারের ‘পুনর্জন্মে’ বিন্দুমাত্র আশ্চর্য নন। এঁরা বলেন যে, ক্রিকেটের প্রতি নিষ্ঠা জীবিত থাকলে, খেলার প্রতি ভালোবাসা অক্ষত থাকলে, বয়স যে আজও ফ্যাক্টর নয়, তার সর্বশেষ উদাহরণ সম্ভবত রাহানে।
একদিক থেকে ভাবলে, ভুল নয়। যে বয়সে পৌঁছে ক্রিকেটার ব্যাঙ্ক ব্যালান্স চেক করে, ধারাভাষ্যে কোথায় কী সুযোগ আছে খোঁজ নেয়, বিবিধ ব্যবসায়িক ইনভেস্টমেন্টে মন দেয়, সেই ছত্রিশে রাহানে কি না আর দিন চার পর আইপিএল ক্যাপ্টেন্সি করতে নামছেন! আর সেটাও কোন টিম? না, কেকেআর! চেন্নাই সুপার কিংস আর মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের পর সফলতম ফ্র্যাঞ্চাইজি! তিন-তিনখানা আইপিএল ট্রফি রয়েছে যাদের।
টি-টোয়েন্টি নিয়ে একটা সম্যক ধারণা হল, এটা তারুণ্যের ফরম্যাট। অত্যধিক ফাস্ট পেসড। এ সম্পূর্ণ তিলক বর্মা-ঈশান-কিষাণ-অভিষেক শর্মাদের গনগনে শৌর্যের মঞ্চ। ক্রিকেট সায়াহ্নে পৌঁছে যাওয়া এক সময়ের ক্রিকেট-বীরদের এলাকা আইপিএল নয়। মহেন্দ্র সিং ধোনি, রোহিত শর্মা, বিরাট কোহলিরা ব্যতিক্রম মাত্র। কখনওই নিয়ম নন তাঁরা। যে তালিকায় এবার থেকে যোগ হল রাহানের নাম। ভেঙ্কটেশ আইয়ারের বদলে তাঁকে কেকেআরের অধিনায়ক নির্বাচন করা ছেড়েই দেওয়া গেল। গত সৈয়দ মুস্তাক আলি টি-টোয়েন্টিতে রাহানের রান দেখুন—৮ ইনিংসে ৪৬৯ রান! স্ট্রাইক রেট প্রায় ১৬৫! জাতীয় টি-টোয়েন্টির সর্বাধিক রান সংগ্রাহকের মালিকানা প্রাপ্তি। বিস্ময় নয়?
আশ্চর্য নয়?
আবারও লিখছি, রাহানে ঘনিষ্ঠদের কাছে এতটুকু আশ্চর্য নয়! বিন্দুমাত্র বিস্ময় নয়! এঁরা বলেন যে, রাহানে ২.০-র নেপথ্যে এক এবং একটা বিষয়ই কাজ করেছে— ঘরোয়া ক্রিকেটের সাধনা!
কী রকম সে সাধনা?
এটা প্রথমেই লিখে রাখা যাক, জাতীয় দল থেকে রাহানে আলোকবর্ষ দূরে। টেস্ট খেলেছেন শেষ বার ২০২৩ সালে। সাদা বলের ক্রিকেটে শেষ বার জাতীয় জার্সিতে অবতরণ তারও বহু আগে। দেখতে গেলে দেশের হয়ে আশিটা টেস্ট খেলা রাহানের সামনে সে রকম আকর্ষণীয় তাড়না ছিল না। যা মধ্য তিরিশের মুম্বইকরের রান-ক্ষুধার জ্বালানি হয়ে কাজ করবে। কিন্তু তার পরেও ক্রিকেট নামক সাধনা থেকে এতটুকু সরে আসেননি তিনি। যে যুগে জাতীয় ক্রিকেটারদের ভারতীয় বোর্ড চোখ না রাঙালে পারতপক্ষে ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেন না, খেললেও তিনটের মধ্যে একটা খেলেন, সেই একই যুগের অধিবাসী হয়ে রাহানে নিয়মিত রনজি খেলেছেন। জাতীয় টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। অধিনায়কত্ব করেছেন। বিজয় হাজারে ট্রফি শুধু খেলেননি, মুম্বইয়ের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বঞ্চিত করা হয়ে যাবে বলে। আর হ্যাঁ, খেলা থাকুক না থাকুক, সকালে উঠে ঘণ্টা কয়েকের ফিটনেস ট্রেনিং, নেট বোলার ডেকে নিয়ে নিয়মিত ব্যাটিং অনুশীলন চালিয়ে যাওয়া, তাঁর দৈনন্দিন কাজকর্মের মধ্যে পড়ে। ছত্রিশেও। আজও। এবং সেটা, ভারতীয় দলে প্রত্যাবর্তনের সামান্যতম সম্ভাবনা নেই জেনেও।
ইডেনেও তো। দু’খানা প্রস্তুতি ম্যাচে রান পাননি। দশ-এগারোর গণ্ডিতে আটকে যেতে হয়েছে। মঙ্গলবার দেখছিলাম, নেটে কী অসম্ভব প্রাণপাত করে যাচ্ছেন নাইট অধিনায়ক। বোলারের সমস্ত ডেলিভারি যে মাঝ ব্যাটে খেলছেন, তা নয়। সুনীল নারিনের ডেলিভারিতে একবার বোল্ড হয়ে গেলেন। বর্ষীয়ান মইন আলির স্পিনও এক-আধবার বিপাকে ফেলল নাইট অধিনায়কে। কিন্তু তার পরেও হাল না ছেড়ে ফের পাশের নেটে চলে গেলেন নকিং করতে। নিগূঢ় অধ্যাবসায় আর অনন্ত রান ক্ষুধা না থাকলে, এ জিনিস কখনও সম্ভব?
রাহানের ঘনিষ্ঠদের কেউ কেউ এ দিন বলেছিলেন যে, কেকেআর এমনি এমনি তাঁকে নিলাম থেকে পায়নি। অধিনায়কও করেনি। বরং আইপিএল দুনিয়ায় ‘স্মার্ট বাই’ বলতে যা বোঝায়, রাহানের ক্ষেত্রে তাই হয়েছে। রাহানে ওপেনিং বা তিন নম্বরে নেমে কী করতে পারেন, তা চেন্নাই সুপার কিংস জার্সিতে দেখে নিয়েছে লোকে। এঁরা বলেছিলেন যে, রাহানে ২.০-র নেপথ্যে দু’জন। সরি, দুই প্রখ্যাত ভারত অধিনায়ক। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং মহেন্দ্র সিং ধোনি। ভারতীয় বোর্ড প্রেসিডেন্ট থাকার সময় শোনা যায়, রাহানেকে নাকি একবার সৌরভ বলেছিলেন যে, আর যা-ই হয়ে যাক, কখনও ঘরোয়া ক্রিকেটের হাত না ছাড়তে। কখনও উপেক্ষা না করতে। কারণ, ভারতীয় ক্রিকেট সিস্টেমে প্লেয়ারকে বাঁচিয়ে রাখে ঘরোয়া ক্রিকেটের প্রতিদ্বন্দ্বিতা। রাহানে যাতে নাকি সঙ্গে সঙ্গে সহমত পোষণ করেন। দ্বিতীয় জন, ধোনি। সিএসকে-তে থাকাকালীন এক মুম্বই ইন্ডিয়ান্স ম্যাচ বদলে দিয়েছিল রাহানের আইপিএল গতিপথ। সেই ম্যাচের আগে নাকি রাহানেকে আলাদা করে ধোনি বলে দেন, ‘দেখো, খেলাটা ওয়াংখেড়েতে। তোমার ঘরের মাঠ। তাই তুমি এখানে কী করে রান করবে, আমি জানতে চাইব না। তুমি তোমার মতো করে করো। টিমকে একটা ভালো স্টার্ট দাও।’ এবং রাহানে নেমে সে দিন মুম্বই ইন্ডিয়ান্স বোলিংয়ের উপর কী ভাবে চড়াও হয়েছিলেন, স্কোরবোর্ড খুললেই দেখে নেওয়া যাবে। এঁরা এ-ও বললেন যে, অধিনায়ক রাহানের থেকে যথেষ্ট চমক প্রত্যাশা করতে পারেন এবার নাইট সমর্থকরা। বলা হল, মুম্বইকর অত্যন্ত ধুরন্ধর অধিনায়ক। বাইরে থেকে দেখে শুধু বোঝা যায় না।
ভালো তো। ব্যাটার রাহানে, অধিনায়ক রাহানে যত ভালো করবেন, তত কেকেআরের ভালো। ট্রফি ধরে রাখার শর্ত রয়েছে যে! এবং রাহানে যত ভালো করবেন, তত দেশজ ক্রিকেটের জন্যও ভালো।
অজিঙ্ক রাহানে জিতলে যে শুধু কেকেআর জিতবে না। একই সঙ্গে জিতবে ভারতবর্ষের ঘরোয়া ক্রিকেট!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.