ছবি: পিটিআই
সরোজ দরবার: শাহরুখ খান কে? কিং, বাদশা, সুপারস্টার! নাইটদের মালিক, মার্কেটিং জিনিয়াস! ধুর্, এরকম কোনও শব্দের বন্ধনীতে শাহরুখকে আটকে ফেলা যায় নাকি! শাহরুখ খান আসলে সেই বিশ্বাস, যা মরতে মরতেও মরে না। শাহরুখ খান সেই আশাবাদ, যা প্রতি সূর্যাস্তে লিখে রাখতে জানে ভোরের কবিতা। শাহরুখ খান সেই দিনবদলের গান, যা সময়ের ঘুণপোকাকে নস্যাৎ করে দিয়ে বাঁচিয়ে রাখে নতুন দিনের স্বপ্ন। শাহরুখ খান আরও অনেক কিছুই। হতে পারেন তিনি হারিয়ে যাওয়া সেই প্রেমপত্র, মনে মনে যাকে পড়ে যায় মানুষ আজীবন। পুরনো বইয়ের ভাঁজে তুলে রাখা শুকনো সেই ফুলের পাপড়ি হয়তো শাহরুখ খান, হঠাৎ যা খুঁজে পেলে বুকের ভিতর শত ঝর্ণার জল থই থই! তবে ক্রিকেট তো আদতে মহাযুদ্ধ! রণ-রক্ত-সফলতা ছাড়া সেখানে আর কীসেরই বা গুরুত্ব। তাহলে বলতে হয়, শাহরুখ খান-ই আসলে যুদ্ধের দিনে প্রেম। ক্রিকেটের তাত্ত্বিক নথিপত্র হয়তো সে খোঁজে তেমন আগ্রহী নয়। কিন্তু এ-দেশের ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ইতিহাস জানে, আসলে বাকি সকলেরই মতো সেও ‘ডেসপারেটলি সিকিং শাহরুখ’।
না খুঁজে উপায়ই বা কী! বিনোদন আর খেলার কড়া ককটেলের যে পানপাত্রে একদা চুমুক দিয়েছিল ভারতবাসী, প্রায় সতেরো বছর পরে তা আর শুধু বিলাস নয়, অভ্যাসই বটে। ভারতীয় ক্রিকেটে (Indian Cricket Team) আইপিএলের অবদান নিয়ে নিশ্চিতই আলাদা একখানা অধ্যায় লেখা হবে। তাতে ক্ষতি আর সমৃদ্ধি দুই দিকই থাকবে। আলোচনা হবে নিক্তি মেপে। তবে সেই গবেষণা, তথ্যসূত্র, পাদটীকার সম্ভার একদিকে সরিয়ে রেখে একটা কথা নির্দ্বিধাতেই বলা যায় যে, ভারতবর্ষের ক্রিকেট আর আইপিএল-কে অস্বীকার করতে পারে না। সুতোয়-নাতায় দুয়ের সম্পর্ক এমনই জড়িয়ে যে, আজ কে প্রথম কাছে এসেছে তার হিসেব করতে যাওয়া বোকামি। সম্পর্কের সেই অন্তরমহলে ঢুঁ দিলে কত কিস্সা-ই না উঠে আসে! কতজন এলেন, গেলেন। অস্তাচল থেকে কত ক্রিকেটার উঠে এলেন। কেউ হলেন নতুন নক্ষত্র। ক্রিকেট আর রাজনীতির এক্কাদোক্কা হল বেশ একচোট। মালিকানায় রদবদল হল। ফ্র্যাঞ্চাইজির হাতবদল হল। সেই সব অযুত কিস্সার ভিতর প্রায় লোককথা হয়ে থেকে গেলেন শাহরুখ খান। তাঁর কথা ফেরে মুখে মুখে। নাইট দলের মালিকের সিংহাসন পেরিয়ে তিনি কী করে যেন হয়ে গেলেন ফ্র্যঞ্চাইজি ক্রিকেটের মালিকদের মডেল। রাগ-গোঁসা-আশা-হতাশা-আবেগ-প্রশান্তির বিস্ফোরণে ময়দানী সংস্কৃতিতে শাহরুখ এমন এক সংস্করণ, যা অতিক্রম করা যায় না। বরং অভিজাত আসবাবের দিকে চেয়ে থাকার মতোই যাঁর দিকে ফিরে ফিরে তাকাতে হয়।
অথচ গোড়ার দিকে তিনি এতটাই শান্ত,সমাহিত ছিলেন না। আবেগের পানসিতে তখন ঢেউ লাগত একটু বেশিই। সিনেদুনিয়ার মানুষরা বলবেন, শাহরুখ খান তো এমনই। প্রফেশনাল এবং প্যাশনেট। নিজের ভিতর আবেগের আগ্নেয়গিরি পুষে না রাখলে কোটি মানুষকে হাসি-কান্নার এক তারে বাঁধতে পারেন নাকি! সেই ছাপ ছিল তাঁর ময়দানি আবির্ভাবেও। হারকে বোধহয় সেকালে সহজ ভাবে নিতে পারতেন না। যিনি দু-হাত মেললে ভারতবর্ষ এসে ধরা দেয় স্বেচ্ছায়, তিনি পরাজয়কে তাঁর অভিধানে ঠাঁই দেবেনই কী করে! কিন্তু ক্রিকেট তো ক্রিকেটই। তাতে আবেগ থাকে বটে, তবে সেটুকুই তো সব নয়। এমনকী যুক্তি-অঙ্কও সেখানে ততটা আমল পায় না। ক্রিকেট আকস্মিকের খেলা। মুহূর্তে সে পৃথিবী বদলে দিতে পারে। স্ট্র্যাটেজি যে ক্রিকেটের চিত্রনাট্য শাসন করবে, এমনটা নাও হতে পারে। অনেক সময় হয়ও না। গোড়ার দিকে খোদ বলিবাদশার তা বুঝতে বোধহয় কিঞ্চিৎ দেরিই হয়েছিল। এক দশক আগের খবরের আনাচে-কানাচে সেই সব কথা কমবেশি ঘোরাফেরাও করত। এমনকী সমুদ্রপারে বসে যিনি মুম্বই শাসন করেন, তিনি ঘরের মাঠেই নিষিদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন।
এসব সত্ত্বেও কেন তিনি বাজিগর? তাঁর সিনেকেরিয়ারের দিকে তাকালে দেখা যাবে সে চিহ্ন রাখা আছে শাহরুখের ব্যক্তিচরিত্রেই। বলিউডের ইতিহাস জানে, শাহরুখ ঝুঁকি নিতে জানেন, অবিশ্বাস্য ঝুঁকি। কেরিয়ারের শুরু দিকেই এমন সব চরিত্র বেছে নিয়েছেন, যা আদতে অ্যান্টি হিরোর। কেরিয়ার অন্যদিকে গড়িয়ে যেতেই পারত। কিন্তু আশ্চর্য এই যে, সেই এক একটা সিদ্ধান্তই শাহরুখ-সাম্রাজ্যের সোপান গড়ে দিয়েছে। আইপিএল খানিক গড়াতে বোধহয় শাহরুখ নিজে গিয়ে তাই দাঁড়ালেন আয়নার সামনে। ফিরে দেখলেন নিজেকে। এবং ঝুঁকি নিলেন। আবেগের সরল কষা ছেড়ে এবার মন দিলেন যুক্তির সিঁড়িভাঙায়। কেকেআর-এ এলেন গৌতম গম্ভীর। একটা পরিবারের যেন সেই দানা বাঁধা শুরু হল। শুরুটা করলেন গম্ভীরই। বড় নামের মোহ থেকে বেরিয়ে, যৌথতার মন্ত্র চারিয়ে গেল দলের অন্দরে। সকলে বুঝে নিতে শুরু করলেন তাঁর ভূমিকা। একটা জিনিস স্পষ্ট হয়ে গেল যে, কেউ অপরিহার্য নন। কেউ পরিত্যাজ্যও নন। আইপিএল যদি এক সিজনের উপন্যাসই হয়, তাহলেও প্রতি চরিত্রের গুরুত্ব আছে। নইলে আখ্যান এলোমেলো হয়ে যায়। কাজটি শুরু করেছিলেন গম্ভীরই। তাহলে এসবের মধ্যে শাহরুখ কোথায়? খেয়াল করলে দেখা যাবে, যে ঝামেলায় জড়িয়ে তিনি নির্বাসিত হয়েছিলেন, তার মুখ্য কারণ ছিল নিজের পরিবারকে আগলানো। এই পর্ব থেকে শাহরুখ যেন নিজেকেও খানিক বদলে নিলেন। বুঝে গেলেন, নাইট সংসারকে আগলানোর দায়িত্ব তাঁরই। তিনি সেই নাইট, যিনি মাঠে নেমে যুদ্ধ করেন না। কিন্তু যাঁর ছায়া না থাকলে যুদ্ধ জমে না। অতএব অভিভাবকের যা কাজ, সেই কাজটিই এবার করে চললেন তিনি। বিশ্লেষকরা বলবেন, ব্র্যান্ড শাহরুখ তো চিরকালই ব্র্যান্ড কেকেআর-এর ভরসাস্থল। তা অস্বীকারের কোনও জায়গাই নেই। তবে, সেই ব্র্যান্ডতুতো সম্পর্কের ভিতর নিজের ভূমিকা যেন খানিক বদলেই নিয়েছিলেন বাদশা, বাজিমাতের সেই সূচনা।
আইপিএলে (IPL 2024) জয়ের স্বাদ তো আগেও পেয়েছে কেকেআর। হারের জ্বালা তার থেকেও বেশি। তাহলে নাইটদের নিয়ে আজ নতুন করে এত কথা থাকারই বা কী আছে! কথা এই জন্যই যে, এই নাইট সংসারে একজন শাহরুখ খান (Shah Rukh Khan) আছেন। যিনি আসলে নাইটদের অদৃশ্য কবীর খান। গত দশ বছর তো বেশ চড়াই-উতরাইয়ের মধ্যে দিয়েই হাঁটছেন নাইটরা। সংসারে অদল-বদলও এসেছে। কিন্তু যৌথতার ওই বিশ্বাসটি ভেঙে যায়নি। বিশ্বাস আগলে রাখার নামই তো শাহরুখ। এই তো বছর কয়েক আগে তাঁর সিনেসাম্রাজ্যেও পতনের চিহ্নগুলো ফুটে উঠেছিল। বিশ্লেষকরা তো, শাহরুখ সাম্রাজ্যের পতনের ১২টি কারণ প্রায় লিখেই ফেলেছিলেন। কিন্তু শাহরুখ খান জানতেন, প্রত্যেক পিছিয়ে যাওয়ার ভিতর আসলে একটা এগিয়ে যাওয়ার গল্পও থাকে। অতএব অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ এই যে, শাহরুখ খান ব্যাক করবেন। এবং যখন করবেন তখন ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে হিসাব বুঝে নেওয়া হবে। তা বক্স অফিসের হিসাব ধরলে বাস্তবিক তাই-ই হল। করোনা পরবর্তী হিন্দি সিনেমার শুকিয়ে যাওয়া মরা স্রোতে প্রাণ আনলেন। এই গোটা পর্বে তিনি শুধু লালন করে চলেছিলেন নিজের আগুন। অথচ যে শীর্ষে অবস্থান বাদশার, সেখানে আর নতুন করে প্রমাণের কী আছে! আছে বইকি! দেশের কাছে, তাঁর সন্তানের কাছে। তার থেকেও বড় কথা তাঁর নিজের কাছেই প্রমাণ করার ছিল যে, তিনি শাহরুখ খান। তিনি এগোতে জানেন, ফিরতেও জানেন। শাহরুখ তা করেছেন। আর সেই আত্মশক্তির জোরটুকু চারিয়ে দিয়েছিলেন নাইটদের সংসারেও।
মেন্টর হয়ে ফিরে এসে গম্ভীর আবার ভেলকি দেখাতে শুরু করলেন। প্রায় ধ্বংসস্তূপ থেকে পুনর্জন্ম হল ব্যাটার সুনীল নারিনের। পিঠে টাকার বোঝা নিয়ে যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাওয়া স্টার্ক ফিরে এলেন সাইক্লোন হয়ে। নাইটরাও এগিয়ে চললেন তরতরিয়ে। একবগ্গা গম্ভীরও (Gautam Gambhir) এখন বলছেন,শাহরুখের মতো মালিক আর দ্বিতীয়টি নেই। কেন? না,তিনি তো কোনও কিছুতে নাক গলান না। স্রেফ যা দরকার সেই প্রয়োজনটুকু মিটিয়ে দেন। ভেঙ্কি মাইসোরেরও একই বক্তব্য। নিজের জীবনের উত্থানপতন দিয়েই শাহরুখ জানেন, সময়ের এক-একটা বাঁক তাঁর জন্য পৃথক ভূমিকা নির্দিষ্ট করে। সেটুকু পালন করে যাওয়াই তাঁর কর্তব্য। সে সিনেমা হোক বা ময়দান! নাহ্ তাঁর দর্শন থেকে তিনি সরেননি। আজও হয়তো তিনি বিশ্বাস করেন যে, রুপো জেতা যায় না, বড়জোর সোনা হারানো যেতে পারে। সেইসঙ্গে এ-ও জানেন যে, সেই সোনার কুচি করতলে ধরতে সবুর করতে হয়। মহাকালের খাতায় ইনস্ট্যান্ট গ্র্যাটিফিকেশন বলে যে কোনও শব্দ নেই, তা শাহরুখের থেকে ভালো আর কে জানেন!
অতএব তিনি ফিরেছেন। ফিরেছে তাঁর নাইটরাও। আর ফিরেছে সেই বিশ্বাস। হার-জিতে যে বিশ্বাস টলে না। দু-এক বছরের গণিত সে হিসাব বদলাতে পারে না। যুদ্ধ তো চলে- মাঠে কিংবা জীবনে। সব রকম যুদ্ধই লড়তে হয় সবাইকে। শাহরুখকেও। জীবনের অপরাজেয় ‘নাইট; বলেই তিনি জানেন কীভাবে হয়ে উঠতে হয় মাঠের সফল ‘নাইট’। জানেন, নিজের কাছে নিজেকে প্রমাণ করা ছাড়া বড় যুদ্ধজয় আর কিছু নেই। অপেক্ষার অস্ত্রে তাই শান দিয়ে যেতে হয় ক্লান্তিহীন। অতএব হেরে গিয়ে জিতে যাওয়ার পোয়েটিক জাস্টিস এখন ক্লিশে; শাহরুখ যেন নতুন করে বোঝালেন, যিনি অপেক্ষা করতে জানেন তিনিই বাজিগর। কারা যেন বলাবলি করেন, আজকাল কামব্যাক লিখলে অটোকারেক্টও শাহরুখ খান সাজেস্ট করে। বোধহয় তাঁরা বাড়িয়ে কিছু বলেন না!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.