গৌতম ভট্টাচার্য, সাউদাম্পটন: জালালাবাদ থেকে ড্রাইভ করে কাবুল যাচ্ছেন এই অবস্থায় তাঁকে ধরা গেল! কাবুল পৌঁছতে আরও আড়াই ঘণ্টা। আর নেট খুলে দেখছি সোজা গাড়ি চালিয়ে গেলে সাউদাম্পটন পৌঁছতে লাগত সাতাশি ঘণ্টা! ইনি মহম্মদ শাহজাদ, নিঃসন্দেহে ৮৪ ম্যাচে ৩৩ গড় নিয়ে আফগানিস্তানের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান। আর তাঁকেই কিনা বিশ্বকাপের মাঝে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন মুখ্য নির্বাচক। কাবুলে যখন যুদ্ধ চলছে। রোজ আকাশের দিকে অজানা আতঙ্কে বুক দুরুদুরু তখন এক যুদ্ধবিধ্বস্ত শরণার্থী শিবিরে ক্রিকেট শেখেন শাহজাদ।
শুধু শাহজাদ নন। আফগানদের একেক জনের কাহিনি শুনলে মনে হবে বিশ্বকাপে পাঁচ ম্যাচে অংশ নিয়ে পাঁচটা হেরে যাওয়া নিয়ে এদের ব্যাখ্যা করতে যাওয়ার মানে হয় না! যুদ্ধের আগুন থেকে ক্রিকেটকে ধরে উঠে আসাটাই তো জয়। পয়েন্ট তালিকার মতো একটা বোরিং ব্যাপার কী করে জীবনের উত্তরণ ব্যাখ্যা করতে পারে! সমস্যা হল তালিবান জঙ্গি বনাম আমেরিকান ফৌজের আক্রমণের মধ্যে পড়ে তবু তো ক্রিকেট মাঠে উন্নীত হওয়া গেল। এর সঙ্গে যদি ঘরোয়া গৃহযুদ্ধের স্টেনগান চলতে থাকে টিম ইন্ডিয়ার মতো প্রতিপক্ষের সামনে লড়বে কী করে? খেলা শুরুর আগেই তো তার জ্বালানি শেষ হয়ে যাবে। আফগান ক্রিকেট টিমে ঠিক এই মুহূর্তে যা চলছে তা যাদবপুর ইউনিভার্সিটি বা প্রেসিডেন্সি ক্যান্টিন এক শব্দ বুঝিয়ে দেবে- বাওয়াল! রিয়েল বাওয়াল!
যন্ত্রণা কি ভারতীয় শিবিরে নেই? পর্যাপ্ত আছে। শিখর ধাওয়ান চলে যাওয়া অ্যাডজাস্ট করতে না করতেই ভুবিকে নিয়ে কুয়াশা। যতই শামি তৈরি থাকুন, ইংল্যান্ডের মাঠে ভুবি না খেলা মানে পেস বোলিংয়ের কোষ্ঠকাঠিন্য হওয়ার ব্যাপক সম্ভাবনা। এদিন হ্যাম্পশায়ার বোল মাঠে ফিটনেস টেস্ট দিতে এসে তাঁকে একেবারেই স্বাভাবিক দেখায়নি। গোড়ালিতে চোট লাগা বিজয় শংকর অবশ্য কোনওরকম উতরে গেলেন। পাকিস্তান খেলে উঠেই এই রকম দুধভাত প্রতিদ্বন্দ্বী অনেক সময় যেমন সহজ। অনেক সময় কঠিনও! আফগানিস্তানের কিছু হারাবার নেই। ভারতের সব আছে। তবে ওই যে লিখলাম আফগানি কোঁদলের পাশে কিছু নয়।
এমনিতে আফগান কর্তারা এলিজাবেথ টেলরের মতো। লিজ টেলরের জীবনে যেমন সাত স্বামী এসেছিল, আফগান কর্তাদের জীবনে তেমন গত ক’বছরে এসেছে সাত কোচ। বিশ্বকাপের পর এঁরা লিজ টেলরের রেকর্ডও ভেঙে দেবেন কারণ এখনকার কোচ ফিল সিমন্সকে সরিয়ে দিচ্ছেন। বিশ্বকাপ চলাকালীন এমন আন্তর্দেশীয় গৃহযুদ্ধ কম দেখা গিয়েছে। যেখানে রান করা প্লেয়ারকে আনফিট বলে বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। যেখানে টুর্নামেন্টের আগে হঠাৎ করে আসগর আফগানকে সরিয়ে গুলবদিন নইবকে নেতা বেছে নেওয়া হয়। যেখানে কোচ টুইট করেন নির্বাচক প্রধানের বিরুদ্ধে যে তাঁকে না জানিয়ে ক্যাপ্টেন বদলানো হয়েছে। যেখানে টুর্নামেন্টের মাঝে ক্রিকেট বোর্ড সিনিয়র নির্বাচক প্রধানকে ডিমোশন দিয়ে জুনিয়র কমিটির প্রধান বানিয়ে দেয়।
সেই টিম যে একটা ম্যাচ ছাড়া পুরো পঞ্চাশ ওভার ব্যাট করতে পারেনি। আর তাদের মাত্র তিনজন হাফসেঞ্চুরি করেছে তাতে আশ্চর্য কী? গত ক’দিন ধরে আফগান সাংবাদিকদের সাউদাম্পটন প্রেসবক্সে এসে প্রথম কাজ, টুইটার খোলা। আবার কিছু হল কি না? আবার কে কী বলল? রশিদ খান সম্পর্কেও নানা কথা রটছে। সাউদাম্পটন মাঠের লাগোয়া হোটেলের তিনতলায় বসে যিনি এদিন ওয়ার্ল্ড যোগা ডে-তে নিজের ছবি ইনস্টাগ্রামে পোস্ট করছিলেন সেই অজিঙ্ক রাহানের ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে দেওয়া ইন্টারভিউ মনে আছে? টুর্নামেন্টের সম্ভাব্য সেরা পাঁচে রাহানে রেখেছিলেন রশিদকে। আফগান টি-টোয়েন্টি টিমের ক্যাপ্টেন সেই রশিদের কী হল যে এ পর্যন্ত মাত্র তিন উইকেট পেয়েছেন? আর আগের দিন মর্গ্যানের কাছে ওই বীভৎস ঠ্যাঙানি খেলেন? তিনি কি নতুন ক্যাপ্টেনের অধীনে স্বচ্ছন্দ নন? রশিদ অস্বীকার করছেন কিন্তু কথাটা বাজারে চলছেই।
ভারত যদি বিশাল ব্যবধানে আফগানিস্তানকে না হারায় তবে বিষয়টা আজগুবি মনে হবে। শনিবার হল নেট রান নেট বাড়িয়ে নেওয়ার দিন। যদিও এরা বলছে নেক্সট উইক থেকে ইংল্যান্ড সামার শুরু হবে। বৃষ্টি উঠে যাবে। কিন্তু এমন বৃষ্টিবাদলার দেশে না আঁচালে বিশ্বাস নেই। মহম্মদ শাহজাদ গাড়ি চালাতে চালাতে বলছিলেন, উপরে বোমারু বিমান। নীচে ধোঁয়া। গুলি চলার আওয়াজ এর মধ্যে কী করে কাবুলের শরণার্থী ক্যাম্পে প্র্যাকটিস করতেন। সেখান থেকে জীবনের পাকদণ্ডী বেয়ে উঠে এসেছেন। এখানেও নিজের ক্রিকেট ওয়াইফাই পাসওয়ার্ড ফিরে পাওয়ার আগাম সুখবর পাচ্ছেন। বোর্ড তাঁকে শুধু টিমে ফেরাবে না। প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে অস্ট্রেলিয়ায় আগামী টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভাল ফলের জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করবে। ঠিকঠাক নির্বাচন করবে। শাহজাদকে শুধু এখন মুখ বন্ধ রাখতে বলা হয়েছে।
শুনতে শুনতে মনে হল আফগানদের যা হয়েছে রবি শাস্ত্রীর দেশের ক্রিকেট ইতিহাস ঘাঁটলেও তো একই জিনিস পাওয়া যাবে। প্রথম টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার চার বছর বাদে যখন টিম ছত্রিশের ইংল্যান্ড সফরে আসে লালা অমরনাথকে এইভাবে মহম্মদ শাহজাদের মতো বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। সেবারের অধিনায়ক ভিজিয়ানাগ্রামের মহারাজ সম্পর্কে ব্রিটিশ প্রেস লিখেছিল, মহারাজার রোলস রয়েসের সংখ্যা গোটা সিরিজে তাঁর রানের চেয়ে বেশি। আর তিনি নাকি ওপেনিং জুড়ি মুস্তাক-মার্চেন্ট পার্টনারশিপ দিনের খেলা শেষে অক্ষত দেখে ডেকে পাঠান মুস্তাক আলিকে। বলেন, “কাল যদি ওই মার্চেন্টকে রান আউট করতে পারো তা হলে একটা
দামি রিস্টওয়াচ পাবে।”
আফগানদের নিয়ে তাই পরচর্চা করে লাভ নেই। ভারতের লক্ষ্য হওয়া উচিত রেসিং কারের সার্ভিসিংয়ের মতো এই সুযোগে নিজেদের কলকব্জাগুলো চেক করে নেওয়া। পরের প্রতিপক্ষ ওয়েস্ট ইন্ডিজ। যারা এদিন লন্ডনে প্রাক্তন তারকা ক্রিকেটারদের ডেকে সেই পঁচাত্তরের বিশ্বকাপ জয়ের বার্ষিকী পালন করল। এরা পয়েন্ট তালিকায় যেখানেই থাক প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে সব সময় ভয়ংকর। তার চেয়ে পেটের পক্ষে আফগান জিলিপি অনেক সেফ!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.