গৌতম ভট্টাচার্য, নটিংহ্যাম: বিরাট কোহলিদের হোটেলের ঠিক গায়ে তারক চ্যাটার্জি লেন বা হাড়কাটা গলি টাইপের একটা সরু চিলতে রয়েছে।
আজকের ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর খেলার পাতায় ছাতা মাথায় রবীন্দ্র জাদেজার যে ছবিটা ছাপা হয়েছে, সেটা ওই গলির মুখে দাঁড়িয়ে। অবিকল উত্তর কলকাতা ঢঙের সেই গলিটা জাদেজা একা নন, কমবেশি অনেক ভারতীয় ক্রিকেটারই ব্যবহার করেন। ওটা শেষ হতেই যে নটিংহ্যামের আধুনিক রূপ, আলো ঝলমল সব ব্র্যান্ডেড দোকান আর রেস্তোরাঁ। প্রাসাদোপম সব বাড়িও। তারই একটা নটিংহ্যাম টাউন হল। মস্কোতে যেমন রেড স্কোয়ারের আশেপাশে বিশ্বকাপ ফুটবলের প্রাচুর্য ভরা সব অঙ্গসজ্জা ছিল, এখানেও তাই। ক্রেমলিনের মতো এখানেও রাস্তার বিভিন্ন জায়গায় ঝুলছে বিশ্বকাপের বল। কোথাও বিলবোর্ড। একটা দোকানের সামনে লেখা রয়েছে ম্যাচ দেখতে যাওয়ার সময় এখান থেকে রবিনহুড টুপি পরে যেতে ভুলবেন না।
কোহলিকে একদিনের ক্রিকেটে বিশ্বসেরা ব্যাটসম্যান মানতে এখনও যদি তর্কের প্রয়োজন থাকে, রবিনহুড যে নটিংহ্যামশায়ারের সর্বকালের সেরা রপ্তানি সেটা তর্কাতীত। মধ্যযুগীয় অ্যাংলো স্যাক্সন ইংল্যান্ডের এক চরিত্র যিনি আদৌ ছিলেন কিনা প্রমাণিত নয়। যথেষ্ট ঐতিহাসিক সত্যতা পাওয়া যায় না। কিন্তু লোকগাথার এমন অপ্রতিদ্বন্দ্বী মহানায়ক যে নটিংহ্যামশায়ার ঢুকলে তাঁর নাম শুনতে হবেই! ইন্ডিয়ান টিম যে হোটেলে আছে, সেটাই তো মেড মারিয়ান ওয়ে। রবিনহুডের বান্ধবীর নামে রাস্তা। রবিনহুড প্যালেস আছে এখানে। সিটি ট্যুর হয় যেখানে প্রাসাদের মধ্যে সব কিছু আপনি ঘুরে দেখতে পারেন। রবিন হুড মেমেন্টো কিনতে পারেন। আর সামান্য বেশি কিছু খরচা করতে রাজি থাকলে পর্যটকের জন্য লোভনীয় শেরউড ফরেস্ট টুর আছে। বোটানিক্যাল গার্ডেনের বটগাছের খ্যাতি আধুনিক সময় লুপ্তপ্রায়। কিন্তু শেরউডের বিখ্যাত সেই ওক গাছের জনপ্রিয়তা যেন বিশ্বব্যাপী বেড়েই চলেছে। এখানেই তো লিটল জন সহ সঙ্গীসাথীদের নিয়ে নিজস্ব রাজদরবার বসাতেন রবিন। মধ্যযুগীয় এই দয়ালু দস্যুর জনপ্রিয়তায় ভাগ বসাতে চেয়েছে ইয়র্কশায়ারও। শোনা যায় বয়কটের কাউন্টিতেই রবিন হুডের জন্ম। ওখানে তাঁর একটা সমাধিও আছে। যা অসমর্থিত। নটিংহ্যামশায়ার কিন্তু নিজের দাবি ছাড়েনি এবং এবার তো দেখছি বিশ্বকাপ বিপণনেও কৌশলে তাঁকে লাগিয়ে দিয়েছে।
শেরউডের জঙ্গল পেরিয়ে আধঘণ্টাখানেক গেলে নানকারগেট। ক্রিকেট ইতিহাসের বিখ্যাত স্পট। এ পাড়ার একটা লাল ইটের বাড়িতে বিশ্বকাপের সাদা বল নয়। অরিজিনাল লাল ক্রিকেট বল খোদাই করা রয়েছে। এটাই যে বিতর্কিত বডিলাইন বোলার হ্যারল্ড লারউডের জন্মের বাড়ি! বাউরালে তিনি না জন্মালেও স্রেফ শৈশব কাটানোর জন্য সেটা ডন ব্র্যাডম্যান তীর্থ হয়ে গিয়েছে।ক্রিকেটপ্রেমীদের আরও বড় তীর্থ কিন্তু হওয়া উচিত তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী লারউডের বাড়ি! ইংল্যান্ডের সর্বকালের দ্রুততম বোলার এখানেই কাটান তাঁর জন্মের প্রথম চব্বিশ বছর। সেই কয়লাখনিতে আঠারো বছয় বয়সে কয়লা বয়ে নিয়ে যাওয়া থেকে নটিংহ্যামশায়ার এবং ইংল্যান্ড টিমে রোমাঞ্চকর উত্থান। সপ্তাহে দু’পাউন্ড মাইনে থেকে বিশ্বক্রিকেটের সর্বকালের ট্র্যাজিক নায়ক।
ওয়ান ডে ক্রিকেট একেবারেই পছন্দ করতেন না। কিন্তু তাঁর কাউন্টি যে লারউডীয় ইমেজকে বিশ্বকাপ বিপণনে ব্যবহার করেছে। প্রচার পুস্তিকায় নানা জায়গায় তাঁর নাম। নটিংহ্যামশায়ারের পুরপিতা যেমন রবিন হুডের কথা বলছেন। তেমনি লারউডেরও। আর গোটা শহর যে বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সফল সংগঠনে নেমে পড়েছে তা নটিংহ্যাম ফরেস্ট ফুটবল স্টেডিয়ামের আশপাশ দিয়ে গেলেও চোখে পড়বে। সমস্যা হল উৎসাহ পরিবহনের একটা অনিবার্য টানেল লাগে। না হলে নিরর্থক বাষ্প হয়ে উড়ে যাবে। এখানে দেখছি তারই উপক্রম। কারণ ট্রেন্টব্রিজ মাঠের আউটফিল্ড যে এখনও ভিজে চুপচুপ করছে। দিনভর জল বার করা হল তবু শেষ বিকেলেও এত পিচ্ছিল যে ৩০বি বা ১এ বাস ধরার জন্য একটা দশ মিটারের দৌড়ও সম্ভব নয়। বুমরাহ, সামিরা প্র্যাকটিসে এসে তাই বসে থাকলেন। স্পিনারদের অবধি বল করার মতো শক্ত জমি নেই। থ্রো-ডাউন করে করে অগত্যা বিরাট-রোহিতদের প্র্যাকটিস দেওয়া হল।
একবার খেলা শুরু হয়ে গেলে না দর্শক, না মিডিয়া, না অফিশিয়ালস, কারও মাঠকর্মীদের কথা মনে থাকে না। কিন্তু ট্রেন্টব্রিজ সারিয়ে তোলার জন্য বিকেল অবধি যে পরিমাণ খাটনি তাঁরা খাটছেন, সেটা অনবদ্য! ট্রেন্টব্রিজ মাঠ ঐতিহাসিকভাবে চিত্তাকর্ষক ক্রিকেট উপহার দিয়েছে। রিচার্ড হ্যাডলি আর ক্লাইভ রাইস যেহেতু এখানকার দুই বিদেশি পেশাদার ছিলেন, পিচে সব সময় ঘাস আর বাউন্স থাকত। নটসের সঙ্গে টস জিতে কোনও কাউন্টি ফিল্ডিং নিত না। আধুনিক সময় এই মাঠে পেস উৎপীড়নের ঘটনা তো একেবারে টাটকা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ওয়েস্ট ইন্ডিজ পেসারদের তাণ্ডবে সরফরাজদের ১০৫ অল আউট হয়ে যাওয়া। টনটনে মহম্মদ আমেরের ফর্মে ফেরা যদি ভারতের দুশ্চিন্তার ভাঁজ সামান্য বাড়ায় তাতে ট্রেন্টব্রিজ পিচের চরিত্রও যোগ করতে হবে। স্যাঁতস্যাঁতে পিচ, আকাশে মেঘের প্যান্ডেল আর মানানসই লাইটিংয়ের জন্য বল হাতে ট্রেন্ট বোল্ট, লকি ফার্গুসনরা। ব্যাপারটা যথেষ্ট সহজ কোনওমতেই নয়। মনে রাখতে হবে নিউজিল্যান্ড শুধু গতবারের রানার আপ নয়, দুর্দান্ত ফিল্ড করে!
খচখচ শুধু একটাই– বৃহস্পতিবারের জন্য যে আবহাওয়া অফিস থেকে ইয়েলো ওয়েদার ওয়ার্নিং ইস্যু করা রয়েছে। ইয়েলো ওয়ার্নিং মানে যা বোঝা গেল, বৃষ্টির আশঙ্কা শতকরা আশি ভাগ। প্লাস বন্যার আশঙ্কা। লন্ডন এবং সংলগ্ন রেলপথযাত্রা ইতিমধ্যে বারবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। বাতিল হচ্ছে পরের পর ট্রেন। এখন বিবিসি পূর্বাভাসে বলছে, কোনও কোনও বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যা অবধি হতে পারে। এত বর্ষণসিক্ত জুন নাকি ব্রিটেন দেখেনি!
আইসিসি কর্তারা এই রেকর্ডের কথাই আত্মপক্ষসমর্থনে বলছেন। টনটনের ম্যাচটা খুব জোর বেরিয়ে গেছে কিন্তু এই পূর্বাভাস নিয়ে ভারত-নিউজিল্যান্ড পার করা যাবে? একটা ম্যাচ সম্পূর্ণ হওয়ার জন্য অন্তত কুড়ি ওভার করে দুটো টিমকে ব্যাট করতে হবে। নিছক ফোরকাস্টকে যদি ধ্রুব মানতে হয়, সেই কুড়ি ওভারও সমস্যা হতে পারে। এবারে ব্রিটেনের ক্রীড়াসূচিতে একটা অদ্ভুত ব্যতিক্রম ঘটিয়ে উইম্বলডন ফাইনাল আর বিশ্বকাপ ফাইনালের দিন এক। সেন্টার কোর্ট আর লর্ডস ১৪ জুলাই একই দিনে পুরস্কার তুলে দেবে তার জয়ীদের হাতে। কিন্তু অল ইংল্যান্ড ক্লাবের কর্তারা যেমন সময়ের দাবি মেনে উইম্বলডনের ছাদ ঢাকার দূরদর্শিতা দেখিয়েছেন, ক্রিকেট কর্তারা তা দেখালেন কোথায়? অস্ট্রেলিয়ান ওপেনে বৃষ্টি হলেও থামবে না। খেলা হবে। উইম্বলডনেও হবে। অথচ ট্রেন্টব্রিজে বিষ্যুদবার বল মাঠে পড়বে কি না কেউ জানে না। দু’টিম জানে না ওভার আচমকা কমে গেলে কোন কম্বিনেশন খেলাবে? কারণ কতটা কমবে সেটাও তো বোঝা যাচ্ছে না। স্যাটেলাইট টিভি এবং আধুনিক স্পনসরশিপের সময় ভাবা যায় কোনও খেলা প্রকৃতির দয়ায় নিজেকে এমন সমর্পণ করে রেখেছে?
বিশ্বকাপের সূচি ঘোষণার সময় থেকেই ভারত সমর্থকরা বলছিলেন, অলক্ষুণে ১৩ তারিখে আমাদের খেলা দিল কেন? ইংল্যান্ডের মতো পশ্চিমি দেশে তেরো সংখ্যাটা এতই অশুভ যে, অনেক হোটেলে থার্টিন্থ ফ্লোর অবধি থাকে না। নটিংহ্যামে অবশ্য ‘থার্সডে দ্য থার্টিন্থ’ নয়। আক্রোশের মুখে আইসিসি। সোশ্যাল মিডিয়া থেকে ক্রিকেটমহলের নানা মুখ। আক্রোশ একদিকেই ধাবিত– আইসিসি। কেন বৃষ্টির কথা আগাম ভাবেনি? রবিনহুডের চিরশত্রু কে ছিল মনে আছে তো? ইয়েলো ওয়ার্নিংয়ের মুখে পড়া আইসিসি এখন শহরে তাই– শেরিফ অফ নটিংহ্যাম!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.