গৌতম ভট্টাচার্য: গঙ্গা আমার মা পদ্মা আমার মা/ ও আমার দুই চোখে দুই জলের ধারা/ মেঘনা যমুনা। প্রয়াত ভূপেন হাজারিকা যখন কালজয়ী গানটা প্রথম রেকর্ড করেন, তাঁর কেন, দুই বাংলার সঙ্গীতজগতের কারও দূরতম কল্পনাতেও আসেনি যে এমন একদিন উপস্থিত হতে পারে যখন বাংলাদেশি ক্রিকেট অধিনায়ককে প্রকাশ্যে স্বদেশীয় সমর্থকদের আবেদন করতে হবে, আপনারা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভারত ম্যাচ নিয়ে বিদ্বেষ ছড়ানো বন্ধ করুন। নিজের টিমকেও সতর্ক করতে হবে, এ সব হাইপ থেকে দূরে থেকে মনকে ম্যাচের জন্য শান্ত রাখো।
শুধু ভূপেন হাজারিকা কেন! আজও বাংলাদেশ যাঁকে অকালমৃত্যুতে ভুলে না গিয়ে সমকালীন চেতনায় ভীষণভাবে রেখে দিয়েছে সেই দোহার স্রষ্টা? চার বছর আগে মেলবোর্নে যখন বিশ্বকাপ কোয়ার্টার ফাইনালে ভারত-বাংলাদেশ মুখোমুখি হয় পারিবারিকসূত্রে শ্রীহট্টের কালিকাপ্রসাদ ভট্টাচার্য একটা ফেসবুক পোস্ট দিয়েছিলেন: ‘আজ নিজের ভাষার সঙ্গে নিজের দেশের লড়াই। হৃদয় মুচড়ে নিজের দেশের সঙ্গে আছি।’ হায় কালিকাও যদি জেনে যেতেন ভাষা আর দেশের যুদ্ধ হালফিল কী শোচনীয় এবং অবাঞ্ছিত মোড় নিয়েছে! বাংলা যদি বাংলাদেশের জাতীয় ভাষা হয়। ক্রিকেট হল আধুনিক সময়ে রাজনৈতিক ও সামাজিক ভাষা ক্ষেপণের মঞ্চ। ক্রিকেট এবং একমাত্র ক্রিকেট আর ভারতকে সামনে পেলে তার একচেটিয়া কাজ হল যাবতীয় ক্ষোভ সমেত ফুঁসে ওঠা। কোথায় কী পেতে পারতাম, কোথায় কী পাইনি তার হিসেব খুলে বসা। যাবতীয় ক্ষোভ মনে পড়ে যাওয়া।
প্রতিবার ইন্ডিয়া ম্যাচ এলেই বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের সমস্যা হয়। পারিপার্শ্বিক চাপে এমন আক্রান্ত হয়ে পড়ে যে স্বাভাবিক স্কিল মেলে ধরতে পারে না। মঙ্গলবার নিছক ক্রিকেটীয় নিরিখে বিশ্বকাপের এত তাৎপর্যপূর্ণ ম্যাচ যে বিতর্কের অন্য মুখ বা পৃথক প্রেক্ষিত উপস্থিত হওয়ার কথাই নয়। এজবাস্টন প্রেসবক্সে বসে দেখছি ইংরেজদের সামনে বিপর্যয়ের সাক্ষাৎ আয়না চোখের সামনে এখনও হাজির। এজবাস্টন স্কোরবোর্ড হাজির রয়েছে। যেখানে লেখা ভারত ৩০৬-৫। ধোনি ৩১ বলে ৪২। কেদার ১৩ বলে ১২। এই জুড়ির জুনিয়র পার্টনার শুনছি বাদ গিয়ে আজ দীনেশ কার্তিক ঢুকছেন। ওদিকে এক স্পিনার বসে নাকি ভুবনেশ্বর কুমার আসবেন। তিন পেসারে যাবে ভারত। ঋষভ পন্থের জায়গা থাকছে। যদিও কত নম্বরে কেউ জানে না। ডিকে ঢোকা মানে এক ম্যাচে তিন ভারতীয় কিপার। যা সিকে নাইডুর আমল থেকে আজ পর্যন্ত হয়নি। আসলে একটা ম্যাচ হেরেই ভারতীয় শিবিরে ভূকম্পনের ডেসিবেল লেভেল অভূতপূর্ব। বিপক্ষ বাংলাদেশ বিশ্বকাপে চমকপ্রদ ক্রিকেট খেলছে। তিনশোর ওপর রান এমন নিশ্চিন্ত ভঙ্গিতে তাড়া করে একাধিকবার লক্ষ্যে পৌঁছচ্ছে যে পুরনো অ্যালবাম দেখার বিলাসিতা চলবে না।
এটা নতুন সময়! মাশরাফিদের নতুন টিম! একটু বেচাল হলে ম্যাচ চলে যাবে এবং এজবাস্টন না জিতলে কে বলতে পারে ভারতের সেমিফাইনাল ভাগ্য উৎকন্ঠার মধ্যে পড়বে না? যতই তাদের এগারো পয়েন্ট তোলা থাক। তখন শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে শেষ ম্যাচ জিততেই হবে। নইলে চলে যেতে হবে নেট রান রেটের মতো অমর্যাদাকর গলিঘুঁজিতে। বাংলাদেশে আঙ্গিক আরওই সহজ। ইন্ডিয়া ম্যাচ না জিতলে মঙ্গলবার এজবাস্টনে বিশ্বকাপ শেষ! ইন্ডিয়া ম্যাচ জিতলেও আবার লর্ডসে পাকিস্তানকে হারাতে হবে। তবে ওঠা যাবে শেষ চারে।
এজবাস্টনে ধোনি ও তাঁর সতীর্থদের ব্যর্থতায় পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশও আক্রান্ত! ফারাক্কার পানির সঙ্গে সেই উষ্মাও না ম্যাচের বাউন্ডারির সীমানার বাইরে হাজির হয়! আরও একটা দুশ্চিন্তা। ক্রিকেটীয় নৈপুণ্যে এত সব সম্পদ নিয়ে ভারত যেমন নানান অবিশ্বাস্য ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছে, বাংলাদেশ সেখানে নতুন প্রত্যয়ে ঝলমলে। ভারত যখন আহত বিজয় শঙ্করের বদলে স্ট্যান্ড বাই লিস্টের আশেপাশে না থাকা মায়াঙ্ক আগরওয়ালকে উড়িয়ে এনে নির্বাচক কমিটির কোহলির হাতের পুতুল হয়ে যাওয়া প্রমাণ করছে। তখন সাকিব আল হাসান নিজেকে পুনরায় উপস্থিত করেছেন বাংলাদেশ ক্রিকেটের সর্বকালের সেরা তারকা হিসেবে! ইংল্যান্ড বিশ্বকাপে ৪৭৬ রান ও ১০ উইকেটে মোড়া সাকিবের ক্রিকেটীয় প্রত্যাবর্তন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের চেয়ে কোনও অংশে কম রক্তমাংসের নয়। কী হবে তিন নম্বরে নেমে আবার যদি তিনি বাংলাদেশ ইনিংস পরিচালনা করেন!
ভারত মুখে যাই বলুক, ভেতরে ভেতরে দমে আছে। চব্বিশ ঘণ্টা আগে তাদের এমন ব্যতিক্রমী দিন গিয়েছে যে রোহিত শর্মা আর বিরাট কোহলি পারফর্ম করার পরেও টিম হেরেছে। এটা শেষ কবে হয়েছে যে ওয়ান ডে ক্রিকেটের দুই ব্যাটিং গুরু রান করার পরেও টিম জিততে ব্যর্থ? ভাবনার শীতল স্রোত বইবেই যে কী হবে যদি এঁদের একজন রান না পান? ঋষভ পন্থকে আগে তৈরি করে রাখলে এই অবস্থা হত না। কিন্তু প্ল্যান বি তো কিছুই হয়নি। গোটা টিম চলছে একজনের ব্যক্তিগত রুচি ও মর্জি অনুযায়ী। বাকিরা তাঁর নীরব তোতা কি না আগামী ক’দিনে উত্তর জানা যাবে। এখনকার মতো মামলা ডিআরএসে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.