কৃশানু মজুমদার: সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তাঁকে হয়তো দেখা যেত রনজি ফাইনালে (Ranji Trophy Final)। বাংলার হয়ে ইডেন গার্ডেন্সে নেমে পড়তেন তিনি। ‘শীত-গ্রীষ্ম-বর্ষা/ঋদ্ধিই ভরসা’ এমন স্লোগানও হয়তো আছড়ে পড়ত ইডেনের গ্যালারিতে।
সবুজ গালচেতে উইকেটের পিছনে দাঁড়িয়ে ডান-বাঁয়ে সুপারম্যানের মতো শরীর ছুঁড়ে ক্যাচ ধরা তাঁর ট্রেডমার্ক। তার দেখাও হয়তো মিলত। প্রবল চাপের মুখে দাঁড়িয়ে ঋদ্ধির ব্যাট কথা বলত। বঙ্গ ক্রিকেটের ক্রাইসিস ম্যান যে তিনি।
তবে এসব এখন অতীত। ঠিকানাই যে বদলে ফেলেছেন জাতীয় দলের প্রাক্তন তারকা। বাংলা ছেড়ে ঋদ্ধিমান সাহা (Wriddhiman Saha) এখন ত্রিপুরার ক্রিকেটার। তাঁর জার্সিতে সেঁটে গিয়েছে ‘বাংলার প্রাক্তন’ শব্দবন্ধনী।
সেই ঋদ্ধিমান বাংলা-সৌরাষ্ট্রের (Bengal vs Saurashtra) ধুন্ধুমার ফাইনাল নিয়ে কী বলছেন? সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের এই প্রতিবেদককে দূরভাষে ঋদ্ধিমান বলছেন,”একজন ক্রিকেটার হিসেবে এই ম্যাচটা নিয়ে আমার কোনও আগ্রহ নেই। কারণ আমার দল কোয়ালিফাই করেনি। এটা জানি যে বাংলা-সৌরাষ্ট্রের ফাইনাল ম্যাচ হবে। এর বেশি কিছু নয়।”
এ তো গেল একজন খেলোয়াড় হিসেবে ঋদ্ধিমানের প্রতিক্রিয়া। কিন্তু একসময়ে তো তিনি ছিলেন বঙ্গজীবনের অঙ্গ। লক্ষ্মীবার বাংলার স্বপ্নের মাঝে দাঁড়িয়ে সৌরাষ্ট্র। যে দলের বিরুদ্ধে ২০১৯-২০ সালের ফাইনালে বাংলার হয়ে ব্যাট হাতে নেমেছিলেন ঋদ্ধিমানও। ৬৪ রানের ইনিংস খেলেছিলেন। সেই ঋদ্ধি এখন বাংলায় ব্রাত্য। শান্ত গলায় ঋদ্ধি বলছিলেন, ”বাংলার প্রাক্তন ক্রিকেটার হিসেবে বলব, বাংলা ফাইনালে উঠেছে, ধারাবাহিক ভাবে ভাল খেলছে। ট্রফি যদি জেতে তাহলে খুবই ভাল। বাংলার ক্রিকেটের জন্যও ভাল।”
একসময়ে মনোজ তিওয়ারি, লক্ষ্মীরতন শুক্লাদের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়েছেন। মনোজ এখন দলের ক্যাপ্টেন। কোচ লক্ষ্মী। এই দু’জনের যুগলবন্দি কি ইডেনে সোনা ফলাতে পারবে? সমর্থকরা অবশ্য এসব প্রশ্নের মধ্যে নেই। তাঁদের হৃদয়ে একটাই ধ্বনি ‘জয় বাংলা’। মনে প্রবল আশা, ট্রফি আসবে এবার। প্রাক্তন-সতীর্থদের জন্য মেগা-ম্যাচের আগে ঋদ্ধির বার্তা কী? দেশের প্রাক্তন উইকেটকিপার বলছেন, ”ধারাবাহিক ভাবে ভাল খেলছে বাংলা। ফাইনালেও একই ভাবে খেলে যেতে হবে। অতীতেও সেমিফাইনাল-ফাইনালে গিয়ে কোনও একটা কারণে থমকে যেতে হয়েছে। এই দিকটায় লক্ষ্য রাখা দরকার। আগের ভুল যেন আর না হয়।” দারুণ এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে বাংলার ক্রিকেট। মনোজ-অনুষ্টুপরা যদি সৌরাষ্ট্রকে মাটি ধরিয়ে ঘরোয়া ক্রিকেটে ভারতসেরা হন, তাহলে ৩৩ বছরের ট্রফি খরা কাটবে।
ইদানীং কালে দেখা যাচ্ছে, ঘরের কলকাতা নাইট রাইডার্স ওপার বাংলা থেকে ক্রিকেটার আনছে। অথচ এবাংলার ছেলেরা দল না পেয়ে চলে যাচ্ছেন ভিনরাজ্যের ফ্র্যাঞ্চাইজিতে। রনজি চ্যাম্পিয়ন হলে বদলাবে কি পরম্পরা? বাংলার ছেলেরা আরও বেশি করে কি জাতীয় দলে ডাক পাবে? ঋদ্ধিমানের বক্তব্য, ”সাম্প্রতিক কালে দেখা যাচ্ছে কোনও ক্রিকেটার ভাল খেললে ইন্ডিয়া এ বা সিনিয়র দলে ডাক পাচ্ছে। চ্যাম্পিয়ন হলে আরও বেশি খেলোয়াড়কে ডাকা হবে। চ্যাম্পিয়ন হলে ছেলেদের দিকে বেশি করে নজর পড়বে। আরও বেশি সংখ্যক খেলোয়াড় জায়গা পাবে জাতীয় দলে বা ইন্ডিয়া এ দলে।” আশার কথা শোনাচ্ছেন ঋদ্ধিমান।
রনজি ফাইনালে বাংলার আশাভরসা বোলিং। ব্যাটিও সমান ভাল। আসল আসল সময়ে বাংলার ব্যাটাররা জ্বলে উঠেছেন। ঋদ্ধি জোর দিচ্ছেন ধারাবাহিকতার উপরে। এর সঙ্গেই তিনি যোগ করছেন, ”বাংলা চিরকালই বোলিং ভাল করে। বোলিং ভাল বলেই বেশির ভাগ ম্যাচ জিতেছে। ২০টি উইকেট নেওয়ার মতো ক্ষমতা যদি কোনও দলের থাকে, তাহলে সেই দল পয়েন্ট পায় এবং ম্যাচ জেতে। পেসাররা ঘুরিয়ে ফিরিয়ে উইকেট নিচ্ছে। ব্যাটসম্যানরাও দারুণ সাপোর্ট করছে।” সব মিলিয়ে বাংলা রনজি ফাইনালে। আর বাংলার এই ক্রিকেট পরিক্রমায় ঝলসে উঠেছে অনুষ্টুপ মজুমদারের মতো বর্ষীয়ান ক্রিকেটারের ব্যাট। ধারাবাহিকতার আরেক নামই বোধহয় অনুষ্টুপ। দল যখনই বিপন্ন, তখনই তিনি রান করেন। ঋদ্ধির ব্যাখ্যা, ”কেউ যদি নিজের দায়িত্ব ভাল করে বোঝে, পরিস্থিতির মূল্যায়ন ভাল করে করতে পারে, তখন সে বারবার কঠিন পরিস্থিতিতে ভাল পারফরম্যান্স তুলে ধরতে পারে।” ঋদ্ধির ব্যাটও তো এমন পরিস্থিতিতে জ্বলে উঠত। ‘স্টিফ নেক’ নিয়েও জাতীয় দলের হয়ে লড়ে গিয়েছেন। সুনীল গাভাসকরের প্রশংসা বর্ষিত হয়েছিল তাঁর উপরে।
চিরকালের ‘ফাইটার’ যদি আজ লক্ষ্মী-মনোজদের পাশে থাকতেন, তাহলে কীভাবে উৎসাহ দিতেন দলকে? কী ভোকাল টনিক দিতেন মিতভাষী ঋদ্ধিমান? জাতীয় দলের হয়ে খেলা উইকেটকিপার বলছেন, “যে দল ফাইনালে উঠেছে, সেই দল এমনিতেই চাঙ্গা থাকে। নতুন করে কিছু বলার দরকার হয় না। দল জিততে থাকলে দলের পরিবেশ সবথেকে ভাল থাকে। বাংলা এখন জিতছে। প্রতিটি খেলোয়াড় ফাইনালের জন্য তৈরি। এর থেকে ভাল অবস্থা আর কী হতে পারে।”
তিনি কি আবেগ-বর্জিত মানুষ? কৌতূহল মেটাতেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়া হল, ”সব ঠিক থাকলে আপনিও তো বাংলার হয়ে ফাইনালেই নামতেন?” ঋদ্ধির সাফ জবাব, ”ফাইনাল নিয়ে ভাবছি না। কারণ আমি এখন আর বাংলার নই। তাই ভাবতে যাব কেন? নিজের সিদ্ধান্ত নিয়ে আমি ভাবি না। ভেবেচিন্তেই আমি সিদ্ধান্ত নিই। সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরে আমি আবার সিদ্ধান্ত বদলে ফেলি না।”
ঘরের মাঠে খেলতে নামছে বাংলা। চেনা পরিবেশ। ইডেনের পরিচিত গ্যালারি থেকে ভেসে আসবে সমর্থকদের শব্দব্রহ্ম। তাতে বাড়তি অ্যাড্রিনালিন ঝরবে। মোটিভেশন বাড়বে ক্রিকেটারদের। ঋদ্ধি মানছেন না। তিনি বলছেন, ”ঘরের মাঠ বলে বাংলা অ্যাডভান্টেজ পাচ্ছে আমি মানি না। কারণ ঘরের মাঠ হলেও বাংলার ব্যাটসম্যানকে ব্যাট করে রান করতে হবে। আবার বোলারদের বল করে উইকেট তুলতে হবে। সৌরাষ্ট্রকেও একই ভাবে রান করতে হবে আর উইকেট তুলতে হবে। ঘরের মাঠ বলে বাংলার ব্যাটসম্যানদের অতিরিক্ত ১০-১৫ রান কেউ দেবে না। আবার ২-৩টি উইকেটও কেউ পুরস্কার হিসেবে দিয়ে দেবে না। সৌরাষ্ট্রও খেলবে। বাংলাও খেলবে। আসল সময়ে যারা ভাল খেলবে, তারাই জিতবে।” তাই বলে চেনা পরিবেশ কি কোনওভাবেই সাহায্য করে না? পরিচিত পরিবেশ পেলে কি আত্মবিশ্বাস বাড়ে না খেলোয়াড়দের? ঋদ্ধির সাফ জবাব, ”এটা ব্যক্তিবিশেষের উপরে নির্ভর করে। কারওর আত্মবিশ্বাস বাড়ে আবার কেউ ওভার কনফিডেন্ট হয়ে যায়।”
এদিকে রনজি ফাইনালের পারদ চড়তে শুরু করে দিয়েছে। সোশ্যাল মিডিয়া-সহ বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে ‘ইডেন চলো’র ডাক দেওয়া হচ্ছে। ঋদ্ধি বলছেন, ”খেলা দেখতে এসো এরকম একটা ব্যাপার হচ্ছে বলে আমার জানা নেই। আর যদি হয়েও থাকে, তাহলে সব ম্যাচেই হওয়া উচিত। শুধু ফাইনাল কেন? ভাল জায়গায় পৌঁছলে তবেই খেলা দেখার জন্য ডাক দেওয়া হবে আর অন্যসময় এমন উদ্যোগ দেখা যাবে না, এটা একেবারেই ঠিক নয়।”
ঋদ্ধির মনে এখনও জমা আছে একরাশ অভিমান। তাঁর দায়বদ্ধতা নিয়ে একসময়ে প্রশ্ন তোলা হয়েছিল বঙ্গের ক্রিকেটসমাজ থেকে। সেই অপমান এখনও হয়তো তাঁর রক্তের গতি বাড়িয়ে দেয়। ঋদ্ধি বলে চলেন, ”গায়ে হাত পায়ে ব্যথা নিয়ে তো আমি বাংলার হয়ে ম্যাচ খেলিনি! সেই কারণেই হয়তো আজ আমি বাংলায় নেই। এনিয়ে আর কী বলব? একটা কথাই বলতে পারি, যখন যেটায় মনোনিবেশ করি, সেটাই ভাল করে করার চেষ্টা করি।” শেষের কথাগুলো বেশ জোর দিয়ে বলছিলেন ঋদ্ধিমান। দায়বদ্ধতা, একাগ্রতা, কাজের প্রতি সততা, লড়াই-ই যে ঋদ্ধিমান সাহার বড় পরিচয়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.