গৌতম ভট্টাচার্য, কার্ডিফ: বক্তা সিএসকে-তে ধোনির টিমমেট। দুর্দান্ত বোলিংয়ে আইপিএলে সবাইকে শুধু আশ্চর্যই করেননি, আরও বিস্মিত লাগবে তাঁকে সামনে থেকে দেখলে। হরভজন সিং আট কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেছেন। সংবাদ প্রতিদিন-কে কার্ডিফ মিডিয়া বক্সের খোলা ছাদে দাঁড়িয়ে একান্ত সাক্ষাৎকার দেওয়ার সময় অবশ্য মনে হল কথার ধার এতটুকু কমেনি…
প্রশ্ন: ওভাল এবং কার্ডিফ- কোথাও ভারতীয় ব্যাটিংয়ের প্রথম তিন মহাতারকার বিচ্ছূরণ দেখা গেল না। অনেকে চিন্তিত যে বিশ্বকাপের এর ছায়া পড়বে না তো?
হরভজন: আমি চিন্তিত নই। আমি এখনও মনে করি বিশ্বকাপ জেতার ব্যাপারে ভারত অন্যতম ফেভারিট।
প্রশ্ন: আর কারা ফেভরিট?
হরভজন: ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ড।
প্রশ্ন: পাকিস্তান নয়, নিউজিল্যান্ড?
হরভজন: ইয়েস, পাকিস্তান ভাল টিম কিন্তু কনসিস্টেন্ট নয়। এবারের যা ফরম্যাট তাতে টিম ধারাবাহিক ভাল না খেললে তাদের পক্ষে সেমিফাইনাল যাওয়া খুব কঠিন।
প্রশ্ন: তবুও পাকিস্তান নয়, নিউজিল্যান্ড?
হরভজন: কারণ নিউজিল্যান্ড টিমটার মধ্যে একটা অদ্ভুত পেশাদারিত্ব আছে। এই টিমটা বাইরে থেকে হয়তো মারকাটারি নয় কিন্তু কম রিসোর্সেস থেকেও সেটা পুরো কাজে লাগাতে জানে। ইন্ডিয়ার প্রথম তিনটে ম্যাচ যথাক্রমে সাউথ আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া আর নিউজিল্যান্ড। আমি চাইব শুরুর ম্যাচ যে করে হোক জিততে। শুরুতেই ছন্দ তোলা চাই। নইলে চাপ হয়ে যাবে।
প্রশ্ন: কেন? আইপিএলে তো উলটো বলা হয় যে শুরুতে টেম্পো তুলো না। আস্তে আস্তে ওঠো। সিএসকে তাই করে। এমআই তাই করে। টুর্নামেন্টের বিজনেস এন্ড থেকে আসল চাপটা দেয়।
হরভজন: আইপিএল কোথায় আর বিশ্বকাপ কোথায়! কোনও তুলনাই হয় না! বিশ্বকাপ মানে অনন্ত চাপ। একটা ম্যাচ হারলেন কী চারপাশে কথা শুরু হয়ে যাবে। আপনার নিজের মাথাতেও নেগেটিভ সব চিন্তা জ্যাম হয়ে যাবে। আমি একেবারেই চাইব না বিরাটদের সেটা হোক। ওরা যেন প্রথম থেকে মোমেন্টাম তুলতে পারে। আর সেটা তোলার জন্য ব্যাটিং অর্ডারে প্রথম তিন ব্যাটসম্যানের অন্তত দু’জনকে রান করতে হবে।
প্রশ্ন: সেই রান হচ্ছে কোথায়? কোহলির আজকের ৪৭ বাদ দিলে তো ওপেনাররা দুটো প্র্যাকটিস ম্যাচেই ব্যর্থ।
হরভজন: কী উইকেট দুটোতে আমরা পড়েছি সেটা ভাববেন। কার্ডিফে মাঠের আদ্ধেকটা খোলা বলে বল সবসময়ই বেশি সুইং করে। তারপর এতটা সবুজ পিচ। একটু অসুবিধে হওয়া স্বাভাবিক। আমি অবশ্য তার চেয়েও আশ্চর্য হয়ে গিয়েছি ওভাল পিচ দেখে। মেঘলা পরিবেশে যদি এইরকম উইকেট হয় বল তো বাড়তি মুভ করবেই।
প্রশ্ন: অন্য সব ম্যাচে যখন তিনশো-সাড়ে তিনশো করে রান হচ্ছে সেখানে ইন্ডিয়ার দুটো প্র্যাকটিস ম্যাচেই কঠিন পিচ। অস্বাভাবিক নয়?
হরভজন: আমার বিশ্বাস বিশ্বকাপ পিচ এমন হবে না। ওয়ান ডে ক্রিকেটে লোকে ধুমধাড়াক্কা ব্যাটিং দেখতে মজা পেতে আসে। সেখানে ব্যাটসম্যান বেশি বিপন্ন হলে ম্যাচের বিনোদনই আক্রান্ত হয়ে যাবে। আর আপনি যে ভারতের জন্য পিচের কথা বললেন আমার মনে হয় না কোনও ডিজাইন আছে। দ্বিপাক্ষিক সিরিজ হলে একটা কথা ছিল। আইসিসি-র ইন্ডিয়াকে খারাপ উইকেট ইচ্ছাকৃত দিয়ে কী লাভ?
প্রশ্ন: চার নম্বর নিয়ে টিমে প্রচুর গবেষণা চলছে। ভারতীয় ক্রিকেটমহলেও। সীমাহীন বিতর্ক যে কার যাওয়া উচিত? আজ লোকেশ রাহুল এসে রান করে দিলেও টিমের প্রথম পছন্দ বিজয় শংকর। আপনি কাকে চান চার নম্বরে?
হরভজন: বিজয় শংকর চাই না। লোকেশ রাহুল হলে খারাপ হয় না। দারুণ স্ট্রোক আছে ছেলেটার। সবচেয়ে চমকপ্রদ হল শট নেওয়ার সময় ওর মাথার পজিশনিং। আজ এত শট খেলল মাথা একবারও হেলতে দেখলেন? তবে আপনি যদি এক কথায় জানতে চান আমার পছন্দ মহেন্দ্র সিং ধোনি। বেস্ট লোক চার নম্বরে খেলার।
প্রশ্ন: কেন?
হরভজন: কারণ এত বছর ধরে ও ছয়-সাতে ফিনিশারের খেলা খেলেছে। প্রচুর চাপ নিয়েছে। এখন ওকে আগে খেলতে দেওয়া হোক। ধোনির ক্ষমতা আছে নেমেই একটা ছয় মেরে অ্যাটাক করার। আমি একজন বোলার হিসেবে বলতে পারি ধোনিকে গোটা বিশ্বের বোলাররা ভয় পায়। শুরুতেই একটা ছয় খেলে বোলারের মাইন্ডসেট বিগড়ে যাবে। স্পিনার তখন টেনে টেনে বল করবে। সিঙ্গলস ছেড়ে দেবে। এটা ধোনির সময়। আর কতদিন খেলবে জানি না। কিন্তু এই বিশ্বকাপে চারে আসুক। এনজয় করুক ধোনি। যদি নিজের খেলা খেলতে পারে কোনও টিম পেরে উঠবে না। বিজয় শংকরের টেকনিক আছে আমি জানি। মাথা ঠান্ডা। ভাল স্ট্রোক খেলে। কিন্তু ধোনি হাতে থাকলে বিজয় কেন? ধোনি ব্যাট হাতে টি-টোয়েন্টি আর ওয়ানডে ম্যাচে অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
প্রশ্ন: এবারের আইপিএল সদ্য ধোনির সঙ্গে খেলে উঠলেন। কী মনে হচ্ছে ধোনির মেজাজ?
হরভজন: দারুণ। বললাম তো সাদা বলের ক্রিকেটে ওর সমকক্ষ কেউ নেই। আমি টিমের সঙ্গে যুক্ত থাকলে বলতাম, কোনও কথা শুনছি না ধোনি। তোকে বিপক্ষ আগে দেখলে ভয় পায়। তুই সময়েও বেশি পাবি। আয় বাবা চারে আয়।
প্রশ্ন: আর মারতে গিয়ে আউট হয়ে গেলে তো বাকি মিডল অর্ডারে মারাত্মক প্রেসার পড়বে?
হরভজন: আমার মনে হয় না। হার্দিক আছে তো নিচে। ছয় নম্বরে ও দেখে দেবে।
প্রশ্ন: ধোনিকে ক্যাপ্টেন হিসেবে সিএসকে-তে এবার কেমন দেখলেন? এখনও নো টিম মিটিং?
হরভজন: নো টিম মিটিং। হাডলে যা বলার বলে দিত।
প্রশ্ন: আপনার কাছে তো আইপিএলের দুই পৃথিবী। একটা মুম্বই ইন্ডিয়ান্স যেখানে লোকে বলে মিটিং শেষই হয় না। অন্যদিকে সিএসকে যেখানে মিটিংই হয় না।
হরভজন: এমআই-তে সারাদিন মিটিং হয় এটা হয়তো ঠিক নয়। তবে হ্যাঁ, বারবার চর্চা হয়।
প্রশ্ন: কিন্তু একেবারে মিটিং ছাড়া কম্বিনেশন তৈরি হবে কী করে? মাঠে তো বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়ে যাবে!
হরভজন: সেটা হয় না। কোচ তো আলাদা করে সবার সঙ্গে কথা বলেই নিচ্ছেন। ধোনি এসে শুধু বলত ও কী চাইছে। একটা সুবিধে ওর আন্ডারে খেলার যে কখনও অবাস্তব কিছু চায় না। প্রত্যেকের সম্পর্কে খুব রিয়ালিস্টিক অ্যাসেসমেন্ট করে।
প্রশ্ন: আপনার বোলিং হিসেব এবার আইপিএলে দারুণ। ১১ ম্যাচে ১৬ উইকেট। গড় ১৯.৫০। ইকোনমি ৭.০৯। দেখে মনে হচ্ছে এখনও ভারতের হয়ে খেলতে পারেন।
হরভজন: নিজের ফর্মে আমি এতটুকু চমৎকৃত নই। জানতাম এরকম বোলিং করার ক্ষমতা রাখি। আমি মনে করি এখনও ভারতের হয়ে টি-টোয়েন্টি খেলার ক্ষমতা আমার আছে। নেক্সট ইয়ার টি-টোয়েন্টি ওয়ার্ল্ড কাপ অস্ট্রেলিয়ায়। যদি মনে করি নির্বাচকেরা আমায় ভাবছেন তাহলে আরও পরিশ্রম করতেও রাজি আছি। ইনফ্যাক্ট আমাকে হঠাৎ কেন ভারতীয় দল থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছিল জানি না। শুনেছি কিছু সিলেক্টর আমার এগেইনস্টে চলে গেছিলেন।
প্রশ্ন: সন্দীপ পাটিল তখন চেয়ারম্যান। তাঁকে জিজ্ঞেস করেননি কেন?
হরভজন: করেছিলাম। পরিষ্কার জবাব পাইনি।
প্রশ্ন: আপনার আজকের সিএসকে ক্যাপ্টেনই তো তখন ক্যাপ্টেন। ধোনির কাছে জানতে চাননি কেন?
হরভজন: চেয়েছিলাম। ও বলেছিল এটা সিলেক্টরদের ডিসিশন। ওর কিছু করার নেই।
প্রশ্ন: ধোনি না গাঙ্গুলি? ক্যাপ্টেন সেরা কে? আপনার র্যাপিড ফায়ার।
হরভজন: ধোনি দুর্ধর্ষ। ওর অ্যাচিভমেন্টই ওর হয়ে কথা বলে। তবে একটা কথা মনে রাখবেন। সৌরভ গাঙ্গুলি একটা টিমকে নতুন করে দাঁড় করিয়েছে। আমরা যারা কিছু ছিলাম না তাদের উপর ইনভেস্ট করে বড় বড় প্লেয়ার বানিয়েছে। আর একটা কথা মনে রাখবেন সৌরভ গাঙ্গুলি যখন ইন্ডিয়া ক্যাপ্টেন হয়েছিল, তখন ভারতীয় ক্রিকেটের রাস্তাটা কী ভয়ংকর দুর্গম ছিল। ম্যাচ ফিক্সিং নিয়ে নোংরা সন্দেহ আর বিদ্বেষ। লোকে ক্রিকেট মাঠে আসা বন্ধ করে দিয়েছিল। সেই অবস্থা থেকে একটা টিমকে চ্যাম্পিয়ন টিম হিসেবে তৈরি করা, মানুষের মনে বিশ্বাস ফেরানো।
প্রশ্ন: বুঝলাম। এবার বলুন ইংল্যান্ড বিশ্বকাপ জেতার ভারতীয় মন্ত্র কী হওয়া উচিত?
হরভজন: প্লেয়ারদের নিজেদের প্রতি অখণ্ড বিশ্বাস যে আমরা উইনিং টিম। আমি আজ হয়তো পারছি না। কিন্তু কেউ না কেউ ঠিক দাঁড়িয়ে যাবে। এই বিশ্বাসটা আমাদের ২০১১ বিশ্বকাপে ছিল। দ্বিতীয় ফ্যাক্টর বিরাট কোহলির ফর্ম। কোহলি ফর্মে ব্যাট করলে কাপ জেতার চান্স অনেক বাড়বে। কোহলি না খেললে আমি আশা দেখছি না।
প্রশ্ন: কোহলি, না শচীন?
হরভজন: তুলনা করা যায় না। দুটো দু’সময়ের ক্রিকেটার। তার মধ্যে নিয়ম বদলেছে। সারফেস অনেক বদলেছে। বোলিং বদলেছে। কী করে তুলনা হয়?
প্রশ্ন: এটা তো সবাই বলে। আপনি অন্য কিছু বলুন।
হরভজন: কোহলি দুর্দান্ত। যে সব ম্যাচ জেতানো ইনিংস ও খেলে, বসে দেখাটাই স্বর্গসুখ। কিন্তু শচীনের সঙ্গে কী করে তুলনা করব? শচীন ক্রিকেটের ঈশ্বর। যেভাবে বছরের পর বছর ডমিনেট করেছে। যে সব শট খেলেছে। যা বোলিং খেলেছে এবং রান করে গিয়েছে তা তো রূপকথা।
প্রশ্ন: কিন্তু কোহলির উপর তো টিম দাঁড়িয়ে থাকে। এই যে আপনি বললেন বিশ্বকাপ জিততে হলে তাঁর ফর্ম সবচেয়ে বড় ফ্যাক্টর।
হরভজন: অ্যাবসোলিউটলি। কোহলির ফর্ম সবচেয়ে ইম্পর্ট্যান্ট।
প্রশ্ন: কিন্তু এটা একটা অমানুষিক চাপ নয় যে আমি লিডও করব। আবার সবচেয়ে বেশি রান করব, দলকে জেতাব।
হরভজন: ঠিক বলেছেন। আমি একমত। এই অমানুষিক চাপ সামলানো দেড় মাস ধরে সম্ভব নয়। তাই বিরাটকে অন্যভাবে ব্যাপারটা অ্যাপ্রোচ করতে হবে। ব্যাটসম্যান হিসেবে ভাবতে হবে। ক্যাপ্টেন হিসেবে নয়।
প্রশ্ন: বুঝলাম না।
হরভজন: ক্যাপ্টেন হিসেবে যদি টিমকে চ্যাম্পিয়ন করার কথা প্রতিনিয়ত ভাবে সেটা সাংঘাতিক হবে। ওই চাপ ব্যাটিংয়ে প্রভাব ফেলবে। সর্বনাশ হয়ে যাবে ভারতের। তার চেয়ে বিরাট শুধুই ভাবুক রান করা নিয়ে। ও যদি রান করে আমরা এমনিতেই জিতে যাব।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.