দশ বছরের ওপার হতে...
অর্পণ দাস: এই দুনিয়ায় নাকি সবাই সবাইকে ভুল বোঝে। আজ বলে নয়, চিরকালীন ইতিহাসেই ‘ভুল বোঝাবুঝি’ এক নিত্য সমস্যা। দূরত্ব বাড়ে, ভেঙে যায় সম্পর্ক। চেনা সমাজের কাছে অপরিচিত হয়ে ওঠেন খুব কাছের মানুষ। পৃথিবীর গণ্ডি পেরিয়ে মহাশূন্যে পাড়ি দেওয়া সম্ভব হলেও ভুল ভাঙানোর কোনও যন্ত্র আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। সেটা হলে কি গৌতম গম্ভীর (Gautam Gambhir) একবার পরখ করে দেখতে চাইতেন না?
উত্তরটা এক কথায় দেওয়া মুশকিল। ক্রিকেটের ইতিহাসে সবচেয়ে ‘ভুল বোঝা’ খেলোয়াড়দের তালিকায় সবার উপরে থাকতে পারে তাঁর নাম। অন্তত ভারতের ক্ষেত্রে তো বটেই। বীরপূজার ঢক্কানিনাদ থেকে অনেকটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একজন মানুষ। তাঁকে নিয়ে বিতর্ক আছে। সে কথা অস্বীকার করার কোনও উপায় নেই। মাঝে পাঁচবছরের একটা রাজনৈতিক জীবন আছে। অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় মন্তব্য আছে। মাঠের মধ্যে বা বাইরে আগ্রাসী মেজাজে অকারণে জড়িয়ে পড়া গণ্ডগোল আছে। যা তাঁর ‘হিরো ইমেজ’-কে যমুনার জলে ভাসিয়ে দিয়েছে।
আসলে রাজা হওয়ার সাধ কোনওদিনই ছিল না হয়তো। চেয়েছিলেন শুধু দেশের জয়, দলের জয়। সেসব তাঁর অর্জন করা হয়ে গিয়েছে বহু আগেই। দুটো বিশ্বকাপ ফাইনালে তাঁর দুর্ধর্ষ ইনিংসের কথা নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার দরকার নেই। ২০১১-তে দেশের জার্সিতে কাদার দাগ অনেক না বলা কথা বলে দেয়। তার পরের বছর চেন্নাইয়ের মাটিতে দাঁড়িয়ে আইপিএল ট্রফি। নিজের শহর দিল্লি ছেড়ে পরেছিলেন কেকেআরের জার্সি। একের পর এক বছর শুধুই ব্যর্থতাই দেখেছে নাইটরা। ঘরের ছেলে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের হাত ধরে আসেনি তথাকথিত সাফল্য। সেই সময়ে গম্ভীর এলেন, দেখলেন, জয় করলেন। ২০১৪-তে ফের ট্রফি এল নাইটদের ঘরে।
তার পর জীবন গিয়েছে চলে দশ বছরের পার। সেই চেনা ব্যর্থতা নিয়েই নতমুখে বাড়ি ফিরেছে ইডেনের জনতা। অসংখ্য ক্রিকেট তারকায় গড়া টিম প্রখর আলো জ্বালিয়ে আইপিএল ট্রফির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেনি নাইটদের। কোথাও যেন অভাব ছিল জাদুকাঠির ছোঁয়ার। যার অন্য নাম গৌতম গম্ভীর। অতীতের স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে এই মরশুমে নাইটভক্তরা আবিষ্কার করল ট্রফি তাঁদের হাতের মুঠোয়। এক লহমায় অতীত থেকে বাস্তবের মাটিতে পদার্পণ। যে বাস্তব কঠোর-কঠিন নয়, রাতের ইডেনের বেগুনি আলোর রোশনাইয়ের মতো মোহময়ী।
অথচ মরশুমের শুরুতে সংশয়ের কমতি ছিল না। মিচেল স্টার্ককে কিনে ২৫ কোটি টাকা জলে ভাসানো হল কিনা সেই প্রশ্নও উঠছিল। সঙ্গে নারিন, রাসেল, মণীশ পাণ্ডের মতো বুড়ো ঘোড়া। বাকি বিদেশি বলতে ‘বাতিল’ ফিল সল্ট। বিতর্ক বিদ্ধ শ্রেয়স আইয়ারের নেতৃত্ব নিয়ে গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল। আর রইল বাকি অঙ্গকৃষ, হর্ষিত, বৈভবের মতো একঝাঁক উঠতি প্লেয়ার। এদের নিয়ে আইপিএল জয়? পাহাড় প্রমাণ কাজ বলতে যা বোঝায়, এ যেন ঠিক তাই।
কিন্তু গম্ভীর তো চিরকাল সেই কাজটাই করে এসেছেন। কোচ চন্দ্রকান্ত পণ্ডিতদের সঙ্গে নিয়ে এবারও তার ব্যতিক্রম হল না। প্রমাণ করে দিলেন খেলাটা খাতায়-কলমে হয় না। হয় মাঠে। যেখানে প্রতিটা দিন শুরু করতে হয় শূন্য থেকে। প্রতিটা দিন ঝড়াতে হয় ঘাম-রক্ত। কী মন্ত্রে তিনি নাইটদের জাগিয়েছেন জানা নেই। কিন্তু মাঠে ২০০ শতাংশ দিয়েছে প্রত্যেকে। আর তার ফল? নাইটদের ঘরে তৃতীয় আইপিএল ট্রফি।
এই মুহূর্তে তিনিই ক্রিকেট ইতিহাসের একমাত্র প্লেয়ার যিনি অধিনায়ক ও মেন্টর হিসেবে আইপিএল জিতলেন। এই সাফল্য নিশ্চয়ই তাঁর চোখ ধাঁধিয়ে দেবে না। বরং স্বভাবসিদ্ধ হাসি হেসে ডুব দেবেন পরের পরিকল্পনায়। কিন্তু এটাও ঠিক যে, নাইট জনতার কাছে এখন তিনিই ‘গুরু’। কদিন আগেই এক সমর্থক চোখের জলে গম্ভীরকে জানিয়েছিলেন, “তোমায় হৃদমাঝারে রাখব, ছেড়ে দেব না।” আজ এটা সব সমর্থকেরই মনের কথা। গম্ভীরের ক্ষেত্রে কোনও ‘ভুল’ করেনি এই শহর। ঠিক চিনে নিয়েছে তাঁর ‘মনহরা’কে। একমাত্র নাইট রাইডার্সের ভক্তরাই তাঁকে দিয়েছে নায়কের সম্মান। একটু অস্বস্তি হয়তো হতে পারে জিজি-র। কিন্তু কী করা যাবে? বাঙালি তো এরকমই। আপন করে রাখতে জানে। বক্ষমাঝে রাখতে জানে। একবার নাহয় দলের সঙ্গে নিজেও ভালোবাসার মুকুট পরে তিনি দেখতেই পারেন। কেউ ‘ভুল’ বুঝবে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.