টাউন ক্লাবের তাঁবু। নিজস্ব চিত্র।
রাজু মুখোপাধ্যায়: টাউন ক্লাব নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে কাগজে কিছু-কিছু লেখা পড়ছি। জানি না, সে সব ঠিক না ভুল। কিন্তু ‘গড়াপেটা’ অভিযোগের নিশানা ঐতিহ্যশালী টাউন ক্লাব হওয়ায় বড় দুঃখ পাচ্ছি। যন্ত্রণা হচ্ছে।
আসলে টাউন ক্লাবকে জানতে হলে, তার ইতিহাস সর্বপ্রথম জানতে হবে। ১৮৮৪ সালে জন্ম টাউন ক্লাবের। দেখতে-দেখতে একশো চল্লিশ বছর হয়ে গেল। ময়দানের প্রথম ভারতীয় কিংবা বাঙালি ক্লাব হল টাউন (Town Club)। যা প্রবাদপ্রতিম সারদারঞ্জন রায়ের হাতে স্থাপিত। যাকে আমরা বাংলা ক্রিকেটের জনক বলে চিনি-জানি। পেশায় যিনি প্রোফেসর ছিলেন। সেই সময় মহারাজা অফ সন্তোষ, যার নামে কি না ভারতীয় ফুটবলের সন্তোষ ট্রফি, তিনি যুক্ত ছিলেন টাউন ক্লাবের সঙ্গে! স্বামী বিবেকানন্দ খেলতে আসতেন টাউন ক্লাবে! তখনও তিনি স্বামীজি হননি, নরেন্দ্রনাথ দত্ত বলে পরিচিত ছিলেন।
সেই সময় কলকাতা ক্রিকেট ক্লাব ইডেন গার্ডেন্সে শুধুমাত্র টাউন ক্লাবকে খেলার আমন্ত্রণ জানাত। সারদারঞ্জন রায়ের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে। টাউনকে আমন্ত্রণ জানানো হত কারণ, তখনকার দিনে তারাই ছিল ময়দানের একমাত্র ভারতীয় ক্লাব, বাঙালি ক্লাব। ‘উদ্বোধন’ পত্রিকা পড়ে জেনেছি, কলকাতা ক্রিকেট ক্লাবের (Calcutta Cricket League) বিরুদ্ধে খেলতে নেমে বল হাতে সাত উইকেট নিয়েছিলেন স্বামীজি। যা পরে লিখেওছি আমার বই ‘ইডেন গার্ডেন্স: লেজেন্ড অ্যান্ড রোম্যান্স’-এ। পরবর্তী সময়ে বাংলা ক্রিকেটের আর এক দিকপাল চরিত্র দেখাশোনা করতেন টাউনের। কার্তিক বোস নামে যাকে চেনে লোকে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন আবার জিতেন বন্দ্যোপাধ্যায়, যিনি রনজি ট্রফিতে (Ranji Trophy) বাংলার প্রথম বাঙালি অধিনায়ক। এঁরা সবাই একসঙ্গে রনজি খেলতেন, রনজি ট্রফি জিতেওছেন ১৯৩৮-’৩৯-এ। পরে এঁরা যখন কোচ হন, টাউন ক্লাব হয়ে ওঠে বাংলা ক্রিকেটের নার্সারি। শ্যামসুন্দর মিত্র থেকে প্রকাশ পোদ্দার– এঁরা প্রত্যেকে টাউনে খেলতেন। টাউন থেকে খেলা শিখেছেন মন্টু বন্দ্যোপাধ্যায়, পুটু চৌধুরী, পঙ্কজ রায়রা। পঙ্কজ রায়ের গুরু ছিলেন কার্তিক বোস। কার্তিক বোসের বাড়ি ছিল আমহার্স্ট স্ট্রিটে। পঙ্কজ রায় সেখানে গিয়ে খেলা শিখতেন। আর প্র্যাকটিস করতেন টাউন ক্লাবের মাঠে। টাউন ক্লাবের মর্যাদা কতটা বুঝতে পারছেন?
টাউন ক্লাব নিয়ে লিখতে গিয়ে কত অসামান্য স্মৃতিও মনে পড়ছে। মোহনবাগানের (Mohun Bagan) মতোই অসম্ভব ঐতিহ্যশালী ক্লাব হল টাউন। মোহনবাগান প্লেয়ারদের তখন একটা অলিখিত প্রথা ছিল যে, কেরিয়ারের শেষ বছর টাউনে খেলা। ছয়ের দশকে বাংলা ক্রিকেটার নিমাই ঘোষ যা শুরু করেন। বাংলার নির্ভরযোগ্য ওপেনার ছিলেন তিনি। বাঙাল ভাষায় গড়গড়িয়ে কথা বলতেন। সবাই অত্যন্ত শ্রদ্ধা করত নিমাই ঘোষকে। উনি আমার অন্যতম গুরুও ছিলেন। নিমাই ঘোষ বলতেন, “ছাড়ুমই যখন, স্বামীজির পায়ের তলায় গিয়া খেলা ছাড়ুম!” অর্থাৎ, ক্রিকেটজীবনের শেষ বছরটা টাউন ক্লাবে গিয়ে খেলব। খেলে ছাড়ব। যে ক্লাবের হয়ে স্বামী বিবেকানন্দ (Swami Vivekanada) খেলেছেন। সে প্রথা মেনে আমিও তাই করেছি। কেরিয়ার শেষ করেছি টাউন ক্লাব থেকে। পুরোটাই আমাদের সময়কার ভাবাবেগ বলতে পারেন। আসলে তখন ঘন-ঘন ক্লাব বদলানোর চল ছিল না ক্রিকেটারদের। মোহনবাগানে যে খেলত, সে গোটা জীবন মোহনবাগানেই খেলত।
আজকালকার যুগে কলকাতায় খেলাধুলোর চালচিত্র বদলে গিয়েছে অনেক। অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন স্থানীয় ছেলেরা স্থানীয় ক্রিকেটে কম খেলে। ভিন রাজ্যের ছেলেরা বেশি খেলে। সে যাক। কিন্তু কোনও কলঙ্কের সঙ্গে টাউনের নাম যখন জড়িয়ে যায়, অসম্ভব খারাপ লাগে। যে ক্লাবের সঙ্গে সারদারঞ্জন রায়, মহারাজা অব সন্তোষ, স্বামী বিবেকানন্দের নাম যুক্ত, সেই ক্লাবকে ঘিরে সামান্যতম অভিযোগও নেওয়া সম্ভব হয় না। সেই ক্লাবের গায়ে এতটুকু আঁচড়ও সহ্য হয় না। আবারও লিখছি, আমি জানি না কী ঘটেছে। কিন্তু আমি আশা করব, টাউন ক্লাব যাতে কোনও সমস্যায় জড়িয়ে না পড়ে। অন্য ক্লাবে কোথায় কী হচ্ছে, আমার জানার দরকার নেই। কিন্তু স্বামীজির ক্লাব যদি কালিমালিপ্ত হয়, বাংলা ক্রিকেটের কাছে, বাঙালির কাছে তা বিশাল ধাক্কা।
ময়দানের সঙ্গে আমার এখন আর বিশেষ যোগাযোগ নেই। কাগজেই পড়েছি, টাউন ক্লাব বর্তমানে সিএবি যুগ্ম সচিব দেবব্রত দাস চালান। তাঁকে কিন্তু নিজের গুরুদায়িত্বটা বুঝতে হবে। যারাই খেলা চালান, তাঁদের বুঝতে হবে খেলাটা কিন্তু শুধুই খেলা নয়। খেলার একটা বিশাল প্রভাব পড়ে সমাজে। তা ছাড়া যে ক্লাবের সঙ্গে এত বড়-বড় সব নাম জড়িয়ে, সেই ক্লাবের প্রতিনিধিকে নিজের দায়িত্ব বুঝতে হবে। তাঁর চলনবলনই অন্য রকম হবে। তাঁকে বুঝতে হবে, বাকি যে যা করুক, আমার দেখার দরকার নেই। আমি কোনও অন্যায় করব না। আমি কোনও দুর্নীতি করব না। আমি জানি না এ কাজ কেউ করেছেন কি না? কিন্তু যদি কেউ করে থাকেন, বলব সামনে আসুন, দায়িত্ব নিন। জানি না শেষ পর্যন্ত কী হবে। কিন্তু টাউন ক্লাব ‘গট-আপ’ করেছে বলে শেষে যদি প্রমাণিত হয়, আমার দুঃখের সীমা থাকবে না।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.