কৃশানু মজুমদার: দোহার সেন্ট লুসেইল স্টেডিয়াম আর কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স (Eden Gardens) যে প্রায় দু’মাসের ব্যবধানে পাশাপাশি ব্র্যাকেটে বসে পড়বে, বোঝা যায়নি আগে।
আর্জেন্টিনার ৩৬ বছরের খরা মিটিয়ে উদযাপনের প্লাবন ভিজিয়ে দিয়েছে গোটা দেশকে।
এবার বাংলা-ও যেন সেই পথেরই শরিক। ৩৩ বছর ধরে রনজি ট্রফির (Ranji Trophy) স্বাদ পায়নি বাংলা। বারংবার স্বপ্নভঙ্গের সাক্ষী থেকেছে ইডেনের-বরপুত্ররা। এই তুলনা অতিরঞ্জন মনে হলেও ট্রফি-খরার সময়ের এই বিশাল ব্যবধান একই বিন্দুতে এসে মিলিয়ে দিয়ে যাচ্ছে মেসি-মনোজদের।
গানের কথা ধার করেই বলি, ‘তুমি না থাকলে সকালটা এত মিষ্টি হত না।’ তিনিই একদিন এই বাংলায় এনে দিয়েছিলেন এক মিষ্টি সকাল। তিনি না থাকলে বঙ্গ-ক্রিকেট হয়তো সেদিন ইডেন উদ্যানের সবুজ ঘাসে রূপকথা লিখত না। সেই তিনি এখন নিভৃতচারী।
৩৩ বছর আগে অরুণ লালের (Arun Lal) ওই মহাকাব্যচিত ৫২ না থাকলে চ্যাম্পিয়নের বিজয়মাল্য পরতে কি পারত বাংলা?
কোচ হিসেবেও নজিরবিহীনভাবে বাংলাকে (Bengal Cricket) চ্যাম্পিয়নের পোডিয়ামে তুলে ফেলার মোক্ষম সুযোগ পেয়েছিলেন বছর তিনেক আগেই। সৌরাষ্ট্রের কাছেই হেরে বসে বাংলা। বাংলার স্বপ্ন গড়ার মাঝে আবার সেই সৌরাষ্ট্র।
লক্ষ্মীবার বাংলা যখন ইতিহাসের খোঁজে নামবে গঙ্গাপাড়ের মিথ হয়ে যাওয়া স্টেডিয়ামে, তখন দলের সঙ্গে না থেকেও ভীষণভাবে থাকবেন জগদীশলাল অরুণ লাল। এখন থেকেই তিনি দিন গুনতে শুরু করে দিয়েছেন সেই মাহেন্দ্রক্ষণের। সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালের এই প্রতিবেদককে অরুণ লাল বললেন, ”আমরাই জিতব। আমাদের টিম অনেক বেটার। এই দলটা অনেক পরিণত। তরুণ ক্রিকেটাররা দারুণ পারফর্ম করছে।”
২০২০ সালের রনজি ফাইনাল সৌরাষ্ট্র প্রথম ইনিংসে এগিয়ে থাকার সুবাদে জিতে নিয়েছিল। অরুণ লাল বলছেন, ”ক্রুশিয়াল টস আমরা হেরে গিয়েছিলাম।” সেদিনের ব্যর্থতার পিছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। আজ সেগুলো নিয়ে আর কাঁটাছেড়া করতে চান না কেউই। অরুণ লালও নন।
অরুণ লাল মানেই লড়াই। তাঁর ব্যাটের জোরে বাংলা যে সময়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, তখন ছিল না এখনকার মতো সোশ্যাল মিডিয়া। ছিল না মিডিয়ার এত দাপাদাপি। তিনি বঙ্গ ক্রিকেটের চিরকালের ফাইটার। সবার প্রিয় পিগিদা।
দিল্লির হয়ে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলতেন অরুণ। ছ’ বছর খেলেছিলেন। সেভাবে সাফল্য পাননি। চাকরি সূত্রে চলে আসেন কলকাতায়। কালক্রমে বাংলার রঞ্জি দলের স্তম্ভ হয়ে ওঠেন তিনি। ইস্পাত কঠিন মানসিকতায় বলীয়ান হয়ে মাঠে নামেন তিনি এবং দল। আর মানসিকতার এই ব্যাপক পরিবর্তনই সাফল্যের রাস্তায় নিয়ে যায় বাংলাকে। ১৯৮৯-’৯০ মরসুমে দ্বিতীয় বার রনজি ট্রফি জেতে বাংলা।
ওই মরসুমেই কোয়ার্টার ফাইনালে মুম্বইয়ের বিরুদ্ধে অরুণ লালের অপরাজিত ১৮৯ বাংলা ক্রিকেটের লোকগাথায় জায়গা পেয়েছে। ফাইনালে প্রবল প্রতিপক্ষ দিল্লির বিরুদ্ধে অরুণের ব্যাট প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল।
পুরনো দিনের ঘটনা এখন আবছা হয়ে গিয়েছে তাঁর স্মৃতি থেকে। সময় এমনই। অনেক কিছু ভুলিয়ে দেয়। অরুণ লাল যেমন মনে করতে পারেন না ফাইনালে নামার আগে পি কে ব্যানার্জির ভোকাল টনিকের কথা। তবে সেদিনের টানটান ফাইনাল প্রসঙ্গে অরুণ লাল বলছেন, ”সবটা এখন আর ভাল করে মনে পড়ে না। দিল্লি টিম খুব স্ট্রং ছিল। ভারতীয় দলে খেলা ক্রিকেটারের সংখ্যা বেশি ছিল দিল্লির ওই দলে। আমরা খুব ভাল বোলিং ও ফিল্ডিং করেছিলাম। ওদের বেশি রান করতে দিইনি। ওখানেই চেঞ্জ হয়ে গিয়েছিল ম্যাচ। তার উপর বৃষ্টি পড়ছিল, খেলা বন্ধ হচ্ছিল আবার শুরু হচ্ছিল।”
নিজের সেই ইনিংস সম্পর্কে কী বলছেন চিরকালের লড়াকু ক্রিকেটার? অরুণ লাল বলছেন, ”যখন দিল্লিকে বেশি রান করতে দিইনি, তখন আমার মনে হয়েছিল এর থেকে ভাল সুযোগ আর পাওয়া যাবে না। বুঝতে পেরেছিলাম উইকেটে টিকে থাকা দরকার। সেই কাজটাই আমি করেছিলাম।”
অতীত থেকে দ্রুত বর্তমানে ফেরেন অরুণ লাল। বলছেন, ”আমাদের এখনকার বোলিং দুর্দান্ত। তিন-চার বছর ধরে দেশের সেরা বোলিং আমাদেরই। মুকেশ ইজ অলমোস্ট প্লেয়িং ফর ইন্ডিয়া। আকাশদীপ যা ফর্মে আছে, ওর ইন্ডিয়া খেলার কথা। সব মিলিয়ে অ্যাডভান্টেজ বেঙ্গল।”
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অরুণ লালের ব্যাট থেকে সাফল্য সেভাবে আসেনি। শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে অভিষেক টেস্টে ৬৩ রান করেছিলেন তিনি। ইডেনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে করেছিলেন ৯৩। এটাই তাঁর আন্তর্জাতিক কেরিয়ারে সর্বোচ্চ স্কোর। তাঁর নামের পাশে লেখা রয়েছে মাত্র ১৬টি টেস্ট। ক্রিকেটার হিসেবে রনজি চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন। কোচ হিসেবেও রনজি জয়ের কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন। কিন্তু সৌরাষ্ট্র স্বপ্ন ভাঙে তাঁর। সুযোগ পেয়েও তার সদ্ব্যবহার করতে না পারার জন্য কি আক্ষেপ রয়েছে? অরুণ লাল হাসতে হাসতে বলেন, ”কেন আক্ষেপ করব। আমি আনন্দ করছি।”
ঠিকই বলেছেন অরুণ। রনজি ফাইনালে জয় অরুণ লালের সঙ্গে এক পোডিয়ামে বসিয়ে দিতে পারে মনোজ-অনুষ্টুপদের। অনুজের সাফল্য তো অগ্রজকে আনন্দিতই করে। স্বপ্ন দেখা শুরু করেছেন মনোজরা। সেই স্বপ্নে ভাসছেন অরুণও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.