হার্নিয়া অস্ত্রোপচারের জন্য বেশ কিছুদিন মাঠের বাইরে থাকতে হয়েছে। কিন্তু চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির জন্য জাতীয় দলে ফিরেই বুঝিয়ে দিয়েছেন, কেন তাঁকে দেশের অন্যতম সেরা স্পিনার বলা হয়। ফাইনালের সেরা রোহিত শর্মা হয়েছেন ঠিকই। তবে ট্রফি জেতার ক্ষেত্রে তাঁর ভূমিকাও কিছু কম ছিল না। গুরুত্বপূ্র্ণ দুটো উইকেট তুলে নেন। আদতে সেটাই গেমচেঞ্জার হয়ে যায়। তিনি কুলদীপ যাদব। মঙ্গলবার বিকেলে দিল্লি ক্যাপিটালস শিবিরে যোগ দেওয়ার আগে সকালে ‘সংবাদ প্রতিদিন’-কে ফোনে একান্ত সাক্ষাৎকার দিলেন যিনি। শুনলেন আলাপন সাহা।
প্রশ্ন: হার্নিয়া অপারেশনের পর কামব্যাক। জাতীয় দলে ফিরেই দুরন্ত পারফরম্যান্স। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জেতা। কয়েক মাসের জার্নিটা একটু বলবেন।
কুলদীপ: ইনজুরি হলে একটু তো সমস্যা হবে। হার্নিয়া অপারেশনের পরই অস্ট্রেলিয়া সফর ছিল আমাদের। আমি যেতে পারিনি। অস্ত্রোপচারের সাত-দশদিন পর জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে রিহ্যাব শুরু করি। তখন মনে হয়নি যে সময়ের মধ্যে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে যাব। পুরো কৃতিত্ব দেব জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিকে। বিশেষ করে ট্রেনার-ফিজিও ধনঞ্জয় এবং রজনীকে। ওরা দুর্দান্ত কাজ করেছে। রিহ্যাব পর্ব প্রচণ্ড সিরিয়াসলি নিয়েছিলাম। একটা দিনও মিস করতাম না। রিকভারির জন্য সেটা প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ ছিল। সুস্থ হয়ে ফেরার পর প্রথমে মনে হয়েছিল, একটু সময় লাগবে। দুটো-তিনটে ম্যাচ খেলার পর মনে হয় ছন্দে ফিরেছি।
প্রশ্ন: আপনি বলছিলেন, এনসিএ-তে থাকাকালীন একটা দিনও মিস করতেন না। ছুটি নিতেন না। এরকম হয়েছিল, একদিনের জন্য বাড়িতে গিয়েছিলেন। পরের দিনই আবার জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে চলে আসতে হয়েছিল।
কুলদীপ: জানতাম একটা দিনও যদি রিহ্যাবে মিস করি, তাহলে পরবর্তী সময়ে সমস্যা হতে পারে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির আগে পুরো ফিটও হতে পারব না। শনিবার কিংবা রবিবার সেশনের পর শুধু একদিনের জন্য বাড়ি ফিরতাম। সোমবার সকালে বাড়ি থেকে বেরোতাম। বেঙ্গালুরু পৌঁছে বিকেলে আবার সেশন করতাম। তারপর যখন ফিট হয়ে গেলাম, বেশ কিছু ম্যাচ খেলেছিলাম। প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলতাম। এরকমও হয়েছে, নিজেকে পুরোপুরি ফিট করে তোলার জন্য টানা দু’দিন ম্যাচে ফিল্ডিং করেছি। একশো চল্লিশ ওভার ফিল্ডিং করেছি। অর্থাৎ দিন পিছু সত্তর ওভার। তারপর রনজি ট্রফি খেলেছি। বোলিং করেছি। যত বেশি সম্ভব মাঠে থাকার চেষ্টা করতাম। ফিল্ডিং করতাম। সেটা প্রচণ্ড সাহায্য করেছিল। ইনজুরি থেকে কামব্যাকের সময় রিহ্যাব খুব গুরুত্বপূর্ণ। আপনি যদি সঠিকভাবে রিহ্যাব না করেন, তাহলে সমস্যা হবে।
প্রশ্ন: চোট সারিয়ে ফেরার পর যে কোনও ক্রিকেটারের মনে একটা ভয় কাজ করে। মনে হয়, আগের মতো পারফর্ম করতে পারব তো? আপনার মধ্যেও সেরকম কিছু কাজ করেছিল?
কুলদীপ: যে কোনও চোট-আঘাত সমস্যার পরই একটা ব্যাপার মাথায় থাকে। সেটা কামব্যাক করতে হবে। জানতাম ছন্দে আসতে একটু সময় লাগতে পারে। দু’টো-তিনটে ম্যাচ লেগেছে সেই ছন্দে ফিরে আসতে। ইনফ্যাক্ট চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সময়ও মনে হয়েছিল, আরও একটু ভালো হতে পারত। চোট-আঘাত সমস্যা কাটিয়ে ফিরে নিজেকে একটু সময় দিতেই হয় আগের ছন্দে ফেরার জন্য। সেটা ম্যাচ খেলতে খেলতেই চলে আসে।
প্রশ্ন: গত আট মাস ভারতীয় টিমের জন্য দুর্ধর্ষ সময় গিয়েছে। প্রথমে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জয়। তারপর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি। দু’টো আইসিসি ট্রফি জয়ী টিমেরই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ
অংশ ছিলেন আপনি।
কুলদীপ: টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতার মুহূর্তটা খুব স্পেশাল ছিল। ওই বিশ্বকাপ জেতার জন্য পুরো টিম তেতে ছিল। তার আগে আমরা বেশ কয়েকটা আইসিসি ইভেন্টের ফাইনাল-সেমিফাইনাল হেরেছিলাম। ফাইনাল পর্যন্ত পৌঁছচ্ছিলাম। কিন্তু শেষ ল্যাপটা আর পেরোতে পারছিলাম না। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আমরা চ্যাম্পিয়ন হই। তারপর চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জয়। এটাও খুব স্পেশাল। যে কোনও আইসিসি ট্রফি জয়ই ভীষণ তৃপ্তি দেয়। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফি জুড়ে আমরা ভালো ক্রিকেট খেলেছি। আমাদের টিমকে দেখে মনে হয়েছিল, দল অসম্ভব পরিণত ক্রিকেট খেলছে। আর কী বলুন তো, সবাই যখন দীর্ঘদিন একসঙ্গে খেলে তখন টিমে নিজের ভূমিকা কী, সেটা প্রত্যেকে খুব ভালো করে বোঝে। জানে কোন পরিস্থিতিতে কী করতে হবে। সবাই জানে টিম, ক্যাপ্টেন আপনার থেকে কী চাইছে। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে নামার আগে টিমের একটাই লক্ষ্য ছিল–ভালো ক্রিকেট খেলা। জানতাম, ভালো ক্রিকেট খেললে ট্রফি জেতার সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। পুরো টিম টুর্নামেন্টে সেটাই করেছি আমরা। লিগ পর্বে তিনটে ম্যাচের তিনটেতেই জিতি। তারপর সেমিফাইনাল-ফাইনালেও নিখুঁত ক্রিকেট খেলেছে টিম। আইসিসি ট্রফি জেতা টিম হিসাবে, একজন ক্রিকেটার হিসাবে দুর্ধর্ষ অ্যাচিভমেন্ট।
প্রশ্ন: ফাইনালে নিজের স্পেলটা নিয়ে একটু বলবেন। নিউজিল্যান্ড শুরুটা খুব ভালো করেছিল। আপনি যখন বোলিং করতে এলেন, তখন চাপও ছিল বেশ। কিন্তু প্রথম দু’ওভারে দু’টো উইকেট নিলেন আপনি। রাচীন রবীন্দ্রকে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির ফাইনালে প্রথম ডেলিভারিটা গুগলি করেন। আগে থেকে পরিকল্পনা করেছিলেন?
কুলদীপ: আমার মাইন্ডসেট একেবারে পরিষ্কার ছিল। উইকেট নিতে হবে। ওরা তখন ভালো ব্যাটিং করছিল। শুধু ভাবছিলাম, নিজের কোন ডেলিভারি সেরা হবে। ওই পরিস্থিতিতে কী বোলিং করা উচিত, সে’সব মাথায় ঘুরছিল। শুরুর দিকে বল বেশ হার্ড ছিল। বল উইকেটে পড়ে একটু জোরে যাচ্ছিল। অনেক সময় পঁচিশ-তিরিশ ওভারের পর বল সেই গতিতে ট্রাভেল করে না। তাই ঠিক করি, প্রথম বলেই রাচিনকে একটু কনফিউজ করে দেব। ডেলিভারিটা করার পর বল ড্রিফট করে অনেকটা ভেতরে চলে যায়। ব্যাটার রিঅ্যাক্ট করার সেরকম সময় পায়নি। আর আমি যেটা চাইছিলাম ঠিক সেটাই হয়।
প্রশ্ন: পরের ওভারেই আবার কেন উইলিয়ামসনকে আউট করলেন।
কুলদীপ: নিউজিল্যান্ডের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্লেয়ার হল কেন উইলিয়ামসন। জানতাম ব্যাটিংয়ের শুরুতে উইলিয়ামসন একটু সময় নেয়। দশ-বারোটা বল দেখেশুনে খেলে। আমি গতিতে বৈচিত্র নিয়ে আসার চেষ্টা করছিলাম। কয়েকটা একটু স্লো ডেলিভারি করি। চেষ্টা করছিলাম এমন বোলিং করতে, যাতে উইলিয়ামসন স্টেপ আউট করে। চিপ করার চেষ্টা করে। জানতাম ও শুরুতে সিঙ্গলস নিয়ে খেলার চেষ্টা করবে। তাই একটু ফ্লাইট করার চেষ্টা করি। সেটা করেই সাফল্য আসে। উইলিয়ামসনের উইকট খুব গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ওইসময় ওদের দু’টো উইকেট চলে যাওয়ার পর দারুণভাবে ম্যাচে ফিরে আসি আমরা।
প্রশ্ন: একটা কথা বলুন। শেষ তিনটে ম্যাচে দল চার স্পিনার নিয়ে খেলেছে। সেখানে পারফরম্যান্স ভালো না হলে প্রশ্ন উঠতে পারত। এগুলো কি কোথাও বাড়তি চাপ তৈরি করে?
কুলদীপ: মনে হয় না সেরকম কিছু হয়। মাঠের মধ্যে আমরা এই ব্যাপারগুলো কিছুই অনুভব করি না। তবে একটা কথা ঠিক, টিমে চারজন স্পিনার থাকলে ম্যানেজ করা একটু চাপের। এরকম খুব কমই হয় যে, টিমের চারজন স্পিনারই উইকেট নিচ্ছে। কেউ একজন বিপক্ষের উপর চাপ তৈরি করে। উল্টোদিক থেকে এসে একজন উইকেট নেয়। পুরো টুর্নামেন্টেই আমাদের চারজন স্পিনার বিপক্ষকে আগাগোড়া চাপে রেখেছিলাম। তারপর কেউ না কেউ এসে উইকেট নিয়েছে। যদি জানেন যে আপনার বোলিং ভালো হচ্ছে, তাহলে ভাবনার কিছু থাকে না। উইকেট যখন-তখন চলে আসতে পারে। সেমিফাইনালে উইকেট আসেনি। ফাইনালে যেমন উইকেট পেলাম। গুরুত্বপূ্র্ণ হল চারজন স্পিনারকে কীভাবে ম্যানেজ করা হচ্ছে।
প্রশ্ন: এখানে অধিনায়ক রোহিত শর্মার কথা আলাদা করে বলতে হবে। আলাদা করে প্রশংসা করতে হবে।
কুলদীপ: অবশ্যই। রোহিতভাই দুর্দান্ত। দারুণভাবে টিমকে ম্যানেজ করে। সবাইকে বিশ্বাস জোগায়। আমাদের কী করতে হবে, কার থেকে টিম কী চাইছে, খুব ভালোভাবে বুঝিয়ে দেয়। ট্যাকটিক্যালি এই টুর্নামেন্টে বাকিদের থেকে অনেক এগিয়ে ছিল রোহিতভাই। শুধু এই টুর্নামেন্ট নয়, এটা সব টুর্নামেন্টেই হয়েছে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে দেখেছেন। রোহিতভাইয়ের আরও একটা বড় গুণ কী জানেন? টিমের যেটা দরকার, সেটাকে সবসময় ব্যাক করে যায়। কোনও কিছুকে জটিল করে না। সব ব্যাপার খুব সহজ-সরল রাখে। এই ট্রফি জয়ের নেপথ্যে রোহিতভাইয়ের অবদান বিশাল। ওকে কৃতিত্ব দিতেই হবে।
প্রশ্ন: শেষ প্রশ্ন। মঙ্গলবারই আপনি দিল্লি ক্যাপিটালস শিবিরে যোগ দিচ্ছেন। কী মনে হয়, চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির এই ফর্ম আইপিএলে আত্মবিশ্বাস আরও বাড়িয়ে দেবে আপনার?
কুলদীপ: আইপিএল সম্পূর্ণ আলাদা ফরম্যাট। এটা টি-টোয়েন্টি। সবাই জানে এই ফরম্যাট কতটা চ্যালেঞ্জিং। ইম্প্যাক্ট প্লেয়ার থাকায় আইপিএলে আরও বেশি চ্যালেঞ্জ থাকে। দেখুন এই পর্যায়ে এসে নতুন করে আর আত্মবিশ্বাসের প্রয়োজন হয় না। আপনি যখন জুনিয়র থাকেন, তখন হয়তো কনফিডেন্সের প্রয়োজন হয়। আমি ব্যাপারগুলোকে খুব সহজ রাখি। এখন জানি আমাকে কী বোলিং করতে হবে। কখনও ভালো পারফরম্যান্স হয়, কখনও আবার হয় না। কখনও উইকেট আসে, কখনও আসে না। কিন্তু আসল হল প্রসেস। কী করে আরও ভালো বোলিং করা যায়, সেটা সবসময় ভাবতে হবে। আর সেটাই আমার লক্ষ্য থাকে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2025 Sangbad Pratidin Digital Pvt. Ltd. All rights reserved.