অণ্বেষা অধিকারী: একটি বহুজাতিক সংস্থার বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন ছিল, ‘ইট ক্রিকেট, স্লিপ ক্রিকেট’। বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন হলেও কিছু কিছু মানুষের জীবনে ক্রিকেট সত্যিই সেরকম। তাঁদের শয়নে, স্বপনে এবং জাগরণে শুধুই ক্রিকেট, ক্রিকেট আর ক্রিকেট। ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত তাঁরা। ক্রিকেটই তাঁদের জীবন। অথচ প্রচারের সার্চলাইট এসে পড়ে না তাঁদের উপরে। তাঁরা থেকে যান নেপথ্যেই। আমরা তাঁদের বলি, ‘আনসাং হিরো।’ অলক্ষ্যে, অগোচরে থাকা এই ব্যক্তিত্বদের নিয়ে ড্রিম ইলেভেন ভিডিও সিরিজ স্পনসর করছে। নাম দেওয়া হয়েছে ‘ড্রিম বিগ স্টোরিজ’। সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটাল তুলে ধরছে এমনই এক ‘আনসাং হিরো’কে। তিনি সুজন মুখোপাধ্যায়। ইডেনের পিচ কিউরেটর।
তিনি যখন কাস্টমসে চাকরি করতেন, সেই সময়ে প্র্যাকটিসে গিয়ে দেখতেন, পিচ তৈরির কাজ করছেন মাঠকর্মীরা। ওঁদের কাজ দেখতে খুব ভাল লাগত সুজনবাবুর। পিচ তৈরির প্রাথমিক ধারণা তৈরি হয়েছিল কাস্টমসের মাঠ থেকেই। সময় এগিয়ে গিয়েছে। ইডেনের বাইশ গজের দায়িত্বে এখন তিনি।
২০১৫ সালে ইডেনের দায়িত্ব সুজন মুখোপাধ্যায়ের হাতে তুলে দেন সিএবির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় (Sourav Ganguly)। ইডেনের রাজ্যপাট হাতে নেওয়ার প্রেক্ষাপটও ছিল বেশ ঘটনাবহুল। ক্রিকেটের নন্দনকাননে ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকার টি-টোয়েন্টি ম্যাচ ছিল। কিন্তু বৃষ্টি হওয়ার ফলে মাঠের পরিস্থিতি খারাপ হয়ে যায়। শেষমেশ বাতিল হয়ে যায় ম্যাচ। টাইমমেশিনের সাহায্য না নিয়ে সুজনবাবু বলেন, “ভারত-দক্ষিণ আফ্রিকা ম্যাচ বাতিলের পরেই আমাকে ডেকে পাঠান সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়। পিচ তৈরির দায়িত্ব দেওয়া হয় আমাকে। আমার কাছে কাজটা ছিল খুব চ্যালেঞ্জের। ইডেন গার্ডেন্সের (Eden Gardens) দিকে সারা দুনিয়ার নজর থাকে। সেই মাঠের পিচ তৈরি করব আমি। দুশ্চিন্তা একটু ছিলই। তবে উৎসাহ নিয়ে কাজে নেমে পড়েছিলাম।” এক নিশ্বাসে নিজের মানসিক অবস্থার কথা তুলে ধরেন সুজন মুখোপাধ্যায়।
ক্রিকেট মাঠে ভাল ম্যাচ দেখার টানে ছুটে আসেন দর্শকরা। ব্যাটারদের কাছ থেকে বড় রান দেখতে চান তাঁরা। বলকে কথা বলাবেন বোলাররা, এমন আশা নিয়ে মাঠ ভর্তি করেন ক্রিকেট অনুরাগীরা। ভাল ক্রিকেটের জন্য প্রথম শর্তই হল ভাল পিচ। দক্ষিণ আফ্রিকা এসে গিয়েছে ভারতে। চলতি মাসের ৯ তারিখ প্রথম টি-টোয়েন্টি ম্যাচ নয়াদিল্লিতে। ১২ তারিখ কটকে দ্বিতীয় টি-টোয়েন্টি ম্যাচ। সেই ম্যাচের পিচ তৈরির জন্য ওড়িশা ক্রিকেট সংস্থাকে সাহায্য করবেন সুজনবাবু।
পিচ তৈরির পিছনে থাকে পিচ কিউরেটরের (Pitch Curator) হাড় ভাঙা পরিশ্রম। থাকে অনেক মানুষের ঘাম ঝরানোর গল্প। তবেই তো সেই পিচে ফুল ফোটাতে পারেন ক্রিকেটাররা। সিএবি-র চিফ কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায়ের হাতে ইডেনের পিচের রিমোট কন্ট্রোল চলে আসার পর থেকেই চরিত্র বদলেছে বাইশ গজের। ধীর গতির উইকেটের পরিবর্তে ভাল ব্যাটিং পিচ তৈরি হয়েছে ইডেনে। বিসিসিআইয়ের তরফ থেকে সেরা মাঠের পুরস্কারও পেয়েছে ইডেন গার্ডেন্স। একবার, দু’ বার নয়, তিন-তিনবার। সুজনবাবু বলেন, ”ভাল ক্রিকেটের উপযোগী পিচ তৈরি করাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। সেই কারণেই প্রতিদিন নতুন উদ্যমে মাঠে নেমে কাজ করি। মাটি বাছাই থেকে শুরু করে মাঠকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া- সমস্ত কাজেই হাত লাগাই।” প্রতিদিন সকালে ইডেন গার্ডেন্সে গেলে দেখা যাবে সুজনবাবুকে। পিচ তৈরির কাজে নিমগ্ন থাকেন তিনি।
পিচ তৈরির পিছনে থাকে পিচ কিউরেটরের হাড় ভাঙা পরিশ্রম। থাকে অনেক মানুষের ঘাম ঝরানোর গল্প। তবেই তো সেই পিচে ফুল ফোটাতে পারেন ক্রিকেটাররা। সিএবি-র চিফ কিউরেটর সুজন মুখোপাধ্যায়ের হাতে ইডেনের পিচের রিমোট কন্ট্রোল চলে আসার পর থেকেই চরিত্র বদলেছে বাইশ গজের। ধীর গতির উইকেটের পরিবর্তে ভাল ব্যাটিং পিচ তৈরি হয়েছে ইডেনে। বিসিসিআইয়ের তরফ থেকে সেরা মাঠের পুরস্কারও পেয়েছে ইডেন গার্ডেন্স। একবার, দু’ বার নয়, তিন-তিনবার। সুজনবাবু বলেন, ”ভাল ক্রিকেটের উপযোগী পিচ তৈরি করাই আমার একমাত্র উদ্দেশ্য। সেই কারণেই প্রতিদিন নতুন উদ্যমে মাঠে নেমে কাজ করি। মাটি বাছাই থেকে শুরু করে মাঠকর্মীদের নির্দেশ দেওয়া- সমস্ত কাজেই হাত লাগাই।” প্রতিদিন সকালে ইডেন গার্ডেন্সে গেলে দেখা যাবে সুজনবাবুকে। পিচ তৈরির কাজে নিমগ্ন থাকেন তিনি।
প্রথম জীবনে চুটিয়ে ক্রিকেট খেলেছেন তিনি। বাংলার হয়ে রঞ্জি ট্রফিতেও প্রতিনিধিত্ব করেছেন। ক্রিকেটের সঙ্গে তাঁর নাড়ির টান। সারাজীবন ক্রিকেটের সঙ্গেই যুক্ত থাকতে চেয়েছেন তিনি। ক্রিকেটার হিসাবেই কাস্টমসে চাকরি পান তিনি। সেই চাকরি করতে করতেই ২২ গজ তৈরির দিকে মন গিয়েছিল তাঁর। সুজনবাবু বলছেন, “আমি যখন কাস্টমসে চাকরি করতাম, সেই সময়ে মাঠে প্র্যাকটিস করতে যেতাম। তখনই দেখতাম, পিচ তৈরির কাজ করছেন মাঠকর্মীরা। খুব ভাল লাগত ওদের কাজ দেখতে।”
২০০৭ সালে কল্যাণীতে ক্রিকেট মাঠের দায়িত্ব দেওয়া হয়। সেই প্রথম বড় মাঠের পিচ তৈরির ভার পেয়েছিলেন তিনি। কাস্টমসের ১০ জন মালিকে সঙ্গে নিয়ে মাঠ তৈরির কাজ শুরু করেন। এখনও সেই কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। এখনও সপ্তাহে চারদিন কল্যাণীতে গিয়ে মাঠের কাজ করেন তিনি।
দর্শকরা যেন ভাল ক্রিকেট দেখতে পান, সেটাই ছিল সুজনবাবুর (Sujan Mukherjee) স্বপ্ন। নিজের কাজ প্রসঙ্গে তিনি জানিয়েছেন, “সবসময়ে আমার পাশে ছিলেন সৌরভ। যখন যা প্রয়োজন হয়েছে মাঠের জন্য, সব কিছুরই ব্যবস্থা করে দিয়েছেন।” শুধু আন্তর্জাতিক ম্যাচ নয়, রঞ্জি ট্রফি-সহ বিভিন্ন ঘরোয়া টুর্নামেন্টেও ব্যবহার করা হয় এই পিচ। আন্তর্জাতিক ম্যাচ ও ঘরোয়া ম্যাচ তো এক নয়। মোটিভেশনের অভাব হয় না? এসব নিয়ে মাথা ঘামান না সুজন মুখোপাধ্যায়। ভাল পিচ বানানোই তাঁর একমাত্র কাজ। সততার সঙ্গে নিজের কাজ করে যাওয়াতেই আনন্দ তাঁর। ঘরোয়া ক্রিকেটের ম্যাচ খেলেই উঠে আসেন তরুণ প্রতিভারা। নতুনদের কথা মাথায় রেখে তাঁদের জন্যও ভাল পিচ বানান তিনি। পক্ষপাতিত্ব নেই। ব্যাটার ও বোলার দু’ পক্ষই সমান সাহায্য পান।
তবে ক্রিকেটার ও পিচ কিউরেটরের মধ্যে সংঘাতের উদাহরণ তো রয়েছে অনেকই। ২০১২ সালে ভারত-ইংল্যান্ড টেস্ট ম্যাচ হয়েছিল ইডেনে। চার ম্যাচের সিরিজে ১-১ ফল ছিল সেই সময়ে। তৃতীয় ম্যাচে জয় পেতে মরিয়া ভারত অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনি স্পিন সহায়ক উইকেটের দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু ধোনির কথা মানেননি ইডেনের তৎকালীন কিউরেটর প্রবীর মুখোপাধ্যায়। সেই ম্যাচেই ধারাভাষ্য দিতে আসা ইংলিশ ক্রিকেটার মাইক আথারটনকে পিচ দেখার অনুমতিও দেননি তিনি। কিন্তু এই ক্ষেত্রে নিজেকে ‘লাকি’ বলে দাবি করেছেন সুজনবাবু। তিনি বলেছেন, “বহুদিন ধরে পিচ তৈরি করছি, কিন্তু আজ পর্যন্ত কেউই বিশেষ ধরনের পিচ বানাতে বলেনি। এদিক থেকে আমি বেশ লাকি।”
তাঁর হাত ধরেই ভারতের মাটিতে প্রথম দিন-রাতের টেস্ট ম্যাচের পিচ তৈরি হয়েছে। আইপিএলে সেরা মাঠের তকমা পেয়েছে ইডেন, তাও সুজনবাবুর বানানো পিচেই। সদ্য সমাপ্ত আইপিএল প্লে অফের দুটি ম্যাচ খেলা হয়েছে ইডেনে। বৃষ্টির কারণে খেলা শুরু হতে দেরি হলেও ওভার সংখ্যা ছাঁটা হয়নি। তাঁর মতো কিউরেটর রয়েছেন বলেই সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বিসিসিআই প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় বলতে পারেন, “বৃষ্টি থামলেই খেলা শুরু হবে। কোনও চিন্তা নেই।” এতকিছুর পরেও অজানাই থেকে যাবে পর্দার আড়ালে থাকা কিউরেটররা! ওসব নিয়ে ভাবিত নন সুজনবাবু। বলছেন, “আমার কাজ মাঠের পিচ তৈরি করা। সেটাই করে যাব। মানুষ যেন ভাল ক্রিকেট দেখতে পান, সেই চেষ্টাই করব।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.