গোবিন্দ রায়: এমনিতেই সংসারে নুন আনতে পান্তা ফুরোনার মতো অবস্থা। তাই বাধ্য হয়েই খুব কম বয়সেই সংসারের হাল ধরতে হয়েছিল। তবে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নকে তাড়া করে গিয়েছে বসিরহাট (Basirhat) উত্তর বিধানসভার বিবিপুরের বাসিন্দা জিন্না মণ্ডল। কিন্তু করোনা আবহে বেঁচে থাকাই দায়। তাই এবার সরকারি সাহায্য চাইছে আইপিএলে (IPL) কেকেআরের নেটবোলার হিসেবে পরিচিত মুখ জিন্না।
১৭ বছরের জিন্না মণ্ডল কখনও দিনমজুর, কখনও ক্ষেতমজুর, আবার কখনও খাল-বিল থেকে মাছ ধরে ৮০ কিলোমিটার দূরে কলকাতার ফুটপাথে গিয়ে সেই মাছ বিক্রি করে পেট চালাত। বাবাও ক্ষেতমজুর। তাই সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। তিন ভাই-বোন ও বাবা-মায়ের অভাবের সংসারে তাই বাধ্য হয়েই পড়াশোনা ছেড়ে দিনমজুরের কাজ বেছে নিতে হয় জিন্নাকে। অন্যদিকে, স্বপ্ন ক্রিকেটার হওয়ার। বড় ক্রিকেটার হওয়ার সেই স্বপ্নকে লক্ষ্য করেই এগিয়ে চলছিল দিনমজুর জিন্না।
কলকাতায় সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের অ্যাকাডেমিতে বিনাপয়সায় প্রশিক্ষণের সুযোগও পায় সে। সেখান থেকে আইপিএলে নেট বোলার হিসেবে অনেক প্রশংসাও কুড়িয়েছে। কলকাতা ক্রিকেট লিগে ‘সেন্ট্রাল ক্যালকাটা’র হয়ে সেকেন্ড ডিভিশনেও খেলেছে জিন্না। কিন্তু সমস্যা তৈরি করল করোনা অতিমারি পরিস্থিতি। নেই দিনমজুরের কাজ। সাধারণ যাত্রীদের জন্য ট্রেনও বন্ধ, তাই খাল-বিল থেকে ধরা মাছও কলকাতার বাজারে বিক্রি করতে পারছে না জিন্না। এই অবস্থায় ক্রিকেটের স্বপ্ন তো দূরের কথা, এখন কোনও রকমে খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকাই দায় হয়ে পড়েছে জিন্নার কাছে।
জিন্নার আক্ষেপ, “কোনও সরকারি সাহায্য নেই। করোনা পরিস্থিতিতে কাজ নেই। বাড়িতে বসে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে বা বেসরকারি সংস্থা থেকে যেটুকু ত্রাণ পেয়েছি তাতেই চলছে।” ভগ্নপ্রায় মাটির ঘরের দাওয়ায় বসে কাঁদতে কাঁদতে জিন্নার ক্ষোভ, “ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন বোধহয় আর পূরণ হল না। সরকার থেকে যদি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিত তাহলে কিছু সুরাহা হত।” শুধু জিন্নাই নয়, গোটা বসিরহাট মহকুমা জুড়ে এরকম কতশত জিন্নার স্বপ্ন ভাঙতে চলেছে করোনা পরিস্থিতির কারণে। এক সময়ে এ রাজ্যে ফুটবলার তৈরির অন্যতম প্রধান কারখানা হিসেবে পরিচিত ছিল বসিরহাট। রাজ্যের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশ-বিদেশে গিয়েও মুঠো মুঠো সাফল্য কুড়িয়ে এনেছেন মিহির বসু, বিক্রমজিৎ দেবনাথ, রবীন সেনগুপ্ত (ঘ্যাস দা), দীপেন্দু বিশ্বাস, নীলেশ সরকার, নাসির আহমেদ, হাবিবুর রহমান, নাড়ু গোপাল হাইত, নাজিমুল হকরা। কিন্তু বর্তমানে বসিরহাট থেকে ওঠা সেই প্রতিভার সংখ্যা তলানিতে এসে ঠেকেছে। বসিরহাটের সেই নতুন প্রতিভায় এখন বরং ভাটার টান। সে ফুটবল হোক, কী ক্রিকেট বা অন্য কোনও খেলা। জিন্নার মতো হাজারও প্রতিভা গুমড়ে কাঁদছে বসিরহাটের অলিতে গলিতে। শুধু পাশে কেউ নেই বলে, হাজারও প্রতিভা হারিয়ে যাচ্ছে।
এ বিষয়ে বসিরহাটের প্রাক্তন ফুটবলার মিহির বসুর বক্তব্য, “করোনা পরিস্থিতি শুধু বসিরহাট বলে নয়, গোটা রাজ্যের দুঃস্থ প্লেয়ারদের একটা কাছে বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই সময় যদি প্রশাসন বা খেলাধুলার সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা তাঁদের পাশে না দাঁড়ায় তাহলে তাঁরা টিকে থাকতে পারবে না। শুধু এখন বলেই নয়, সরকার বা সমাজ এই বিষয়টি নিয়ে কখনওই গুরুত্ব দেয়নি। যদি গুরুত্ব দিত তাহলে অনেক প্রতিভা হারিয়ে যেত না।” জিন্নার পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্যের আশ্বাস দিয়েছেন পঞ্চায়েত প্রধান জামাল মন্ডল, বসিরহাট উত্তরের প্রাক্তন বিধায়ক এটিএম আব্দুল্লাহরা। তবে এই আশ্বাসে দিনমজুর ক্রিকেটার জিন্না কতটা উপকৃত হবে তা সময়ই বলবে, আর বাকি জিন্নাদের ক্ষেত্রে কী হবে ? এই সমস্ত প্রতিভাকে বাঁচাতে প্রশাসন কি এগিয়ে আসবে ? উঠছে সেই প্রশ্নই।
তবে জিন্না জানায়, প্রশাসনিক সাহায্য না পেলেও বট গাছের মতো পাশে পেয়েছেন স্থানীয় তৃণমূলের শ্রমিক সংগঠনের সভাপতি মাহমুদ হাসানকে। সময়ে-অসময়ে, সুবিধা-অসুবিধায় জিন্নার পাশে দাঁড়িয়েছেন তিনি। কখনও কলকাতায় প্রশিক্ষণ নিতে যাওয়ার খরচ বা কখনও সংসার খরচ দিয়ে সাহায্য করেছেন গ্রামের মাহমুদ ভাই। কিন্তু তাতে আর কতখানি ? মাহমুদ হাসান জানান, “জিন্না বড় ক্রিকেটার হোক, এটা শুধু জিন্নারই স্বপ্ন নয়, স্বপ্ন আমারও। একসময় ক্রিকেট আমারও স্বপ্ন ছিল। কিন্তু পয়সার অভাবে তা পূরণ হয়নি। তাই জিন্না খেলুক আমিও চাই। কলকাতার মাঠে জিন্নাকে খেলতে দেখলে ভাবি আমি জিন্নার জায়গায়। ও কলকাতার যেখানে ট্রায়ালে গেছে আমিও গিয়েছি। ওর পাশে সব সময় আছি।”
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.