রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: ক্ষুরধার মস্তিষ্ক এবং অতুলনীয় ক্রিকেট বোধের জন্য স্বাধীনতাত্তোর বাংলার একমাত্র রনজি জয়ী অধিনায়ক সম্বরণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের (Sambaran Banerjee) যথেষ্ট নাম-যশ আছে। আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে বাংলা রনজি জেতে যখন, অধিনায়ক ছিলেন সম্বরণ। তা, ঠিক বত্রিশ বছর পর, ইডেনে আবারও এক রনজি ফাইনালের (Ranji Trophy Final) প্রাক্ মুহূর্তে সম্বরণ পূর্ব অভিজ্ঞতা থেকে খসখস করে গোটা কয়েক পরামর্শ-পয়েন্ট তুলে দিলেন, যা একবার মগজাস্ত্রের নোটবুকে রেখে দিলে, আজ থেকে মনোজ তিওয়ারির বাংলার লাভ ছাড়া ক্ষতি হবে না!
প্রথমত, নাম দেখে খেলা যাবে না। প্রতিপক্ষের টিমলিস্টে কে আছে, আছে কতশত রাঘববোয়াল, দৃকপাতের প্রয়োজন নেই। দুই, ফাইনালের চাপ না নিয়ে ভাত-ডালের স্বাভাবিক ক্রিকেট। টিম যা খেলে এসেছে এত দিন, খেলে যাক আর পাঁচ দিন। তিন, ফিল্ডিংকে তুখোড় করার চেষ্টা। মাঠে নড়াচড়ায় বিপক্ষকে বুঝিয়ে দেওয়া যে, বাংলা ইডেনে রনজি ফাইনালটা এক এবং একমাত্র জিততে এসেছে!
বত্রিশ বছর আগের রনজি ফাইনাল যেন বুধবার গড়গড়িয়ে ফ্ল্যাশব্যাকে দেখতে পাচ্ছিলেন সম্বরণ। বলছিলেন, ‘‘দিল্লির বিরুদ্ধে আমরা সে দিন একটা কাজ করেছিলাম। প্রথম বল থেকে তীব্র স্লেজিং। আসলে তার আগের বছর কোটলা রনজি ফাইনালে ওরা আমাদের খুব খারাপ ভাবে স্লেজ করেছিল। ঠিক করেছিুলাম, সুদে-আসলে সমস্ত ফিরিয়ে দেব।’’ দ্রুত এরপর সম্বরণের সঙ্গে জুড়ে যান তাঁরই রনজি জয়ী আরও দুই সতীর্থ। ইন্দুভূষণ রায় বলে দিলেন, একেবারে রনজির প্রথম ম্যাচের মডেল অনুসরণ করা উচিত মনোজদের (Manoj Tiwary)। যতটা প্রাণখোলা খেলেছিল তখন টিম, তারই পুনরাবৃত্তি করা প্রয়োজন। যাঁর মনে হচ্ছে, এই বাংলার সেরা প্রাপ্তি, অধিনায়ক আর কোচিং গ্রুপের মধ্যে দায়িত্ব-সীমান্ত তৈরি হয়ে যাওয়া। অরুণ লাল, বত্রিশ বছর আগের ফাইনালে অমূল্য হাফসেঞ্চুরি করা অরুণ, বাংলাকে গত বছর পর্যন্ত কোচিং করানো অরুণ, এত বিশদে গেলেনই না। রীতিমতো ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেন সৌরাষ্ট্রকে। বলে দিলেন, ‘‘বাংলাকে শুধু সাড়ে তিনশো করতে হবে, আর ছন্দটা ধরে রাখতে হবে, ব্যস। বাকি আর কিছু নিয়ে ভাবার কিছু নেই।’’
অরুণরা যতই বলুন ভাবার কিছু নেই, ভাবার আছে অনেক কিছু। ক্রিকেটীয় স্কিল বিচারে, বাংলা (Bengal) এবং সৌরাষ্ট্র দু’টো টিম প্রায় সমান-সমান। বঙ্গ বোলিং পেশিশক্তিতে এগিয়ে থাকলে, সৌরাষ্ট্র (Saurashtra) লোয়ার অর্ডার আবার যথেষ্ট দুঁদে। টিমের এগারো নম্বরও ব্যাটিংটা করে দিতে পারেন। স্মৃতি খুব বিশ্বাসঘাতকতা না করলে, তিন বছর আগে রাজকোটে রনজি ট্রফির ফাইনালে বাংলা হেরে গিয়েছিল সৌরাষ্ট্র লোয়ার অর্ডারের কাছে। প্রথম ইনিংসে ব্যাট করার সময় সৌরাষ্ট্র শেষ উইকেটে তুলেছিল ৫৬ রান। আর বাংলা প্রথম ইনিংস লিড বিচারে ফাইনাল যুদ্ধ হারে ৪৪ রানে। দাঁড়ান, আরও আছে। এক, সৌরাষ্ট্রের দুই বাঁ হাতি পেসার জয়দেব উনাদকট এবং চেতন সাকারিয়া। প্রথাগত সাংবাদিক সম্মেলনে সৌরাষ্ট্র অধিনায়ক উনাদকটকে এ দিন জিজ্ঞাসা করা হয় যে, আপনারা তো সবুজ পিচে অনভ্যস্ত। কী মনে হচ্ছে, ইডেনের সবুজ বাইশ গজ দেখে? প্রশ্ন শুনে উনাদকট গোল-গোল চোখ করে পাল্টা জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তাই নাকি? আপনাদের মনে হয় যে আমরা অনভ্যস্ত?’’
সৌরাষ্ট্র অধিনায়কের কর্কশ কণ্ঠস্বর থেকে এটুকু বোধগম্য হয় যে, এহেন প্রশ্ন-শলাকা মোটেও তাঁর মনঃপূত হয়নি। সত্যি বলতে, টস হেরে ইডেনের সবুজ পিচে উনাদকট-সাকারিয়া খেলা কিন্তু মোটেও জলবৎ তরলং হবে না। দ্বিতীয়ত, অভিষেককারী ওপেনার সুমন্ত গুপ্ত। ইডেন রনজি ফাইনালে নামছেন যিনি। বঙ্গ শিবির থেকে বলা হল, নিজের উইকেটকে কী ভাবে দূর্মূল্য করতে হয়, জানেন সুমন্ত। ঠিক আছে, দেখা যাক। ফাইনালে সুমন্ত নিজের উইকেটকে দুর্মূল্য করলেই হল।
বাংলা অধিনায়ক মনোজ তিওয়ারিকে দেখে মনে হল না, ফাইনাল নিয়ে দুশ্চিন্তার লেশমাত্র আছে বলে! বরং ফুঁসছেন প্রায়, ফুটছেন অতিশয়। বঙ্গ সাংবাদিকদের উদ্দেশ্য করে বললেন, ‘‘আমি জানি, বাইরে গেলে আপনাদেরও শুনতে হয় যে, বাংলা ক্রিকেট এগোচ্ছে না। আমি স্বপ্ন দেখি, রনজি ট্রফি জিতে বাংলার ক্রিকেটপ্রেমীদের হাতে, আপনাদের হাতে তুলে দিচ্ছি! যাতে আপনারা বাইরে গিয়ে বলতে পারেন, বাংলাও পারে!’’ তিন বছর আগে ফাইনাল হারের জ্বালা জুড়োতে ইচ্ছে করছে এবার? কোথাও গিয়ে বদলা ঘুরছে মাথায়? ‘‘সৌরাষ্ট্রকে হারাতে হলে কিন্তু হারাতে হবে স্কিলে। স্ট্র্যাটেজিতে। আর একটা কথা। জুনিয়রদের মধ্যে রাগ-টাগ থাকে না বিশেষ। থাকে সিনিয়রদের মধ্যে। জ্বালাটা তাদের। উনাদকট আমার ভাল বন্ধু। কিন্তু মাঠে পাঁচ দিন ছাড়া যাবে না।’’
বলুন মনোজ, চলুক এ সব, ধরুক আগুন যন্ত্রণার বারুদে। সবচেয়ে বড় কথা, বাংলা সঙ্গে পাবে ‘দ্বাদশ ব্যক্তি’, যা পাবে না সৌরাষ্ট্র, নাম যার সমর্থন। বত্রিশ বছরের অভিশাপ কাটাতে প্রাণের বাংলাকে এটুকু দেবে না শহর?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.