স্টাফ রিপোর্টার: মুকেশ কুমারের (Mukesh Kumar) গলাটা ফোনে কেমন যেন বিহ্বলই শোনাচ্ছিল। সবেমাত্র ইরানি ট্রফির দ্বিতীয় দিনের খেলা শেষে হোটেলে ঢুকেছেন। খবর এল– দক্ষিণ আফ্রিকার (South Africa) বিরুদ্ধে ওয়ান ডে সিরিজের টিমে নির্বাচিত হয়েছেন! ফোনে প্রথমে কী বলবেন, বুঝতে পারছিলেন না। “কলকাতায় পুজো চলছে, আর সেই সময় কি না আমি ইন্ডিয়া কল পেয়ে গেলাম! আমি আর শাহবাজ একই সঙ্গে। মাতারাণীর কৃপা, বুঝলেন পুরোটাই মাতারাণীর কৃপা!”
বাংলা পেসারের আবেগাক্রান্ত হয়ে পড়া স্বাভাবিক, অতি স্বাভাবিক। যে ছেলের একটা সময় হাড়ের রোগে ক্রিকেট কেরিয়ারই ঘোরতর অনিশ্চয়তার মুখে পড়ে গিয়েছিল, যে ছেলের একটা সময় একজোড়া জুতো ছিল না, তার এত দূর আসা বিহ্বলতা দাবি করে বই কী! মুকেশের বাবা প্রয়াত কাশীনাথ সিং পেশায় ট্যাক্সিচালক ছিলেন। রবিবার মহাকীর্তির দিন প্রয়াত পিতাকে মনে পড়া মুকেশের পক্ষে খুব স্বাভাবিক ছিল, পড়েওছে। তিন বার সিআরপিএফের পরীক্ষা দেওয়া মুকেশ অস্ফুটে বলছিলেন, “খবরটা শোনার পর মাথাটা ফাঁকা হয়ে গিয়েছিল জানেন? আমি যখন রনজি খেলি, বাবা তখনও বিশ্বাস করতেন না যে ক্রিকেট খেলে আমার পক্ষে ভাল কিছু করা সম্ভব। আজ যদি বাবা থাকতেন! মা আছেন। মা খবরটা শুনে কেঁদে ফেলেছেন। বাড়িতেও সবাই আনন্দে কেঁদে ফেলেছে।”
বাংলা পেসার কথাগুলো বলেন যখন, রূপকথা-রূপকথা শোনায়। অবশ্য তাঁর ক্রিকেট সফরটাই তো চলমান রূপকথা। বছর আটেক আগে ভিশন ২০২০-র এক শিবিরে আবির্ভাব হয় মুকেশের। তখন ভিশনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন প্রাক্তন বাংলা পেসার রণদেব বসু। বলতে গেলে, মুকেশের উত্থান তাঁরই হাত ধরে। শোনা যায়, ভিশনের ট্রায়ালে মুকেশের নাম ধরে ডাকাডাকি চলছে যখন, তখন তিনি উধাও হয়ে গিয়েছিলেন। পরে এসে জানতে পারেন, ট্রায়াল শেষ। অনেক বলাটলার পর রণদেব তাঁর ট্রায়াল নেন, এবং বোলিং দেখামাত্র তাঁর নাম প্রস্তাব করেন ভিশনের তৎকালীন পেস বোলিং কোচ ওয়াকার ইউনিসকে!
প্রতিবন্ধকতা তার পরেও ছিল। স্পোর্টস শ্যু লাগত মুকেশের। কিন্তু কেনার মতো যথেষ্ট টাকা ছিল না। এক সিএবি (CAB) কর্তা শেষ পর্যন্ত মুকেশকে নিজের ক্লাবে সই করিয়ে পঁচিশ হাজার টাকা দিয়েছিলেন বাংলা পেসারকে। যা দিয়ে তিনটে জুতো কেনা হয়েছিল। দাঁড়ান, দাঁড়ান। বাধা-বিপত্তি এর পরেও তাড়া করেছিল মুকেশকে। দীর্ঘদিনের অপুষ্টির কারণে হাড়ের রোগ হয় মুকেশের। এবারও ত্রাতা হিসেবে হাজির হন রণদেব। তৎকালীন সিএবি প্রেসিডেন্ট সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়কে (Sourav Ganguly) গিয়ে সব কিছু বলেন। সৌরভই চিকিৎসার সমস্ত বন্দোবস্ত করে দেন। এর পর রনজি ট্রফি, হরিয়ানার সঙ্গে প্রথম ম্যাচ, এবং প্রথম ম্যাচেই চার উইকেট!
আজ ভাবলে মনে হয়. এত দিনের পরিশ্রমের বৃত্ত সম্পূর্ণ হল? শুনে এবার লজ্জা পেয়ে যান বাংলা পেসার। বলতে থাকেন, “আরে, সবে তো সফর শুরু হল। এখনই কী এমন করেছি? আমাকে আরও অনেক দূর যেতে হবে। এখনও দেশের হয়ে ম্যাচ খেলিনি আমি। খেলে টিমে আমাকে স্থায়ী নিজের জায়গা তৈরি করতে হবে। তবে বলব, আমি সফল।” কিন্তু বর্তমানে তাঁর কেরিয়ারে কি সোনার সময় চলছে না? নিউজিল্যান্ড ‘এ’-র বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ পারফরম্যান্স। চলতি ইরানি ট্রফিতে আগুনে বোলিং। মুকেশ এবারও ‘ডেড ডিফেন্স’ করেন। বলেন, “এর চেয়েও ভাল হতে পারে। এর চেয়েও ভাল আমি করতে পারি। আমি তো আগেই বললাম, সুযোগ যেখানেই পাব, সেখানেই ভাল করার চেষ্টা করব।”
কী ভাবছেন পাঠক? ভারতীয় ড্রেসিংরুমের সদরদরজা ঠেলে ঢুকে পড়ার পরেও একজন ক্রিকেটার এতটা নম্র, এতটা বিনয়ী? কী করা যাবে, এটাই মুকেশ কুমার, এটাই মুকেশ কুমারের পৃথিবী, আর সেই পৃথিবীতে আপনাকে স্বাগত!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.