ফাইল ছবি।
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: মনোজ তিওয়ারি (Manoj Tiwari) আজ আর বিশেষ রাগেন না। মনোজ তিওয়ারি রাগতে প্রায় ভুলেই গিয়েছেন! আবেগ মানুষের জীবন-সফরের জ্বালানি যেমন, সময় বিশেষে তেমন ভোগায় বড়। এই যেমন মনোজ, বাংলা অধিনায়কের পূর্ব জীবনকেই না হয় ধরুন। বছর দশ-বারো আগেও মনোজ তিওয়ারি বলতে এমন এক গনগনে ক্রিকেট চরিত্র বোঝাত, যিনি কি না বাইশ গজের মতো তার বাইরেও লাভাস্রোতে সব কিছুকে ছারখার করে চলে যাবেন! কে কত বড় নক্ষত্র, জাতীয় ক্রিকেট সার্কিটে কার প্রভাবের গরিমা কত, দৃকপাতই করতেন না। মাপতেন না উলটোদিকের প্রতিপক্ষ কত বলীয়ান, ভাবতেন না যে, ‘আমি লড়ে পারব কি না?’ কেন, কেকেআরে খেলার সময় গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে তাঁর ধুন্ধুমার মনে নেই? সেই সময় মনোজের অর্থ ছিল সময়ে-অসময়ে বেয়ারা অগ্নুৎপাত, আগুনে শব্দের আঁচে হাত পুড়ে যাওয়া ‘কোট’, আদতে মনোজ তিওয়ারি ছিলেন পুরোদস্তুর বিতর্কের সমনামী! ফেলে আসা জীবন দেখলে এখন আক্ষেপ হয়?
এক দিক থেকে দেখলে, পুরনো সেই পঁচিশ কিংবা সাতাশের মনোজকে দোষ দেওয়া যায় না। ক্রিকেট-দেবতার খামখেয়ালি আচরণের অবাধ শিকার তিনি তো হয়েছিলেন নিঃসন্দেহে। প্রতিভা-ভাণ্ড মনোজের চিরকালই পরিপূর্ণ ছিল, ভূ-ভারতের তাবড় বাঘা ব্যাটারের চেয়ে কম কিছু ছিলেন না তিনি। শুধু ছিল না ভাগ্য। অদৃষ্টের নির্মম চাবুকে নিয়মিত রক্তপাত সহ্য করতে হত। বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক অভিষেক যখন নিশ্চিত প্রায়, চোট লেগে গেল। পরবর্তীতে দেশের জার্সিতে সেঞ্চুরি করলেন যখন, বিনা বাক্যব্যয়ে চোদ্দোটা ম্যাচ বসে যেতে হল। মনোজ ডাকসাইটে চরিত্র হতে পারেন, কিন্তু দিনের শেষে রক্তমাংসের মানুষ তো? মন তো তাঁরও আছে।
আর এত দিন পরেও চকিত মনে পড়ে যায় সব। টিভিতে ক্রিকেট বিশেষজ্ঞরা বেখেয়ালে মনোজ নিয়ে বলে ফেলেন যখন। ‘‘ভেবে খারাপ লাগে যে, কারণটাই আমি জানতে পারলাম না। কখনও কখনও মনে হয়, ঈশ্বর বোধহয় এ ভাবে আমার পরীক্ষা নিয়েছেন, আমাকে বেশি ভালবাসেন বলে। আমাকে আরও কঠিন করে তুলতে, এত পরীক্ষার মুখে দাঁড় করিয়েছেন। কিন্তু খারাপ লাগে, এখনও ভীষণ খারাপ লাগে।’’ শুনলেও বড় খারাপ লাগে। মনে হয়, এ যেন নিঃস্ব-রিক্ত এক মানুষের কথা, ক্রিকেটের এক ফকির শাহজাহানের কথা, রাজঐশ্বর্য থেকেও যার সব ভেসে গিয়েছে।
কালের নিয়মে নিজেকে ধীরে ধীরে বদলেছেন মনোজ, সরি, বদল এনেছেন তাঁর স্ত্রী। ‘‘যখন আমি খুব আগ্রাসী হয়ে যেতাম, নিজের উপর কোনও নিয়ন্ত্রণ থাকত না, আমার স্ত্রী-ই শান্ত করত আমাকে। পরিবর্তনের যে মনোজ আজ দেখছেন, তার কৃতিত্ব প্রাপ্য আমার স্ত্রী-র। ও-ই আমাকে বলেছিল, ভাল ক্রিকেটার হওয়ার চেয়েও ভাল মানুষ হওয়া বেশি জরুরি।’’ বাংলা টিমের জুনিয়রদের মধ্যে নিজ-প্রতিভার ছায়া দেখলে মনোজ এখন তাঁদের আগলে রাখার চেষ্টা করেন, নিজের উদাহরণ দিয়ে। ‘‘আজকালকার সোশ্যাল মিডিয়া সংস্কৃতি থেকে গা বাঁচিয়ে চলা খুব কঠিন। সামলাতে পারলে ভাল, কিন্তু আসক্ত হয়ে গেলে মুশকিল। আমি সতর্ক করে দিই জুনিয়রদের এ সমস্ত নিয়ে। দেখুন, আমি মানুষকে যা-ই আনন্দ দিয়ে থাকি, ক্রিকেটের জন্যই তো। আজ যে ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হয়েছি, তারও নেপথ্যে ক্রিকেট। তাই জুনিয়র ছেলেদের বলি, আর যা-ই করিস, ক্রিকেটের সঙ্গে আপস করিস না।’’
বলা হয়নি, কালের নিয়মে আরও একটা কাজ করেছেন বাংলা অধিনায়ক। ভারতীয় টিমে খেলার অভিলাষ ভুলে হৃদয়ের বাঁ দিকে শুধুই সযত্নে বাংলার মানচিত্র বসিয়ে নিয়েছেন। ‘‘বছর চারেক আগেও মনে হত, বোধহয় ডাকবে, ডাক আসবে। কিন্তু আমাদের পূর্বাঞ্চলের নির্বাচকই কিছু করল না। যাক গে। জাতীয় দল আর হবে না। কিন্তু বাংলা তো আছে, সব সময় ছিল যেমন। বাংলাকে রনজি (Ranji Trophy) জেতানোর স্বপ্ন আগেও দেখতাম, আজও দেখি।’’
যে স্বপ্নপূরণের অভিযানে আজ থেকে নামবেন মনোজ। আরও একবার। সজাগ থেকে, ঠাণ্ডা থেকে, নিজেকে শান্ত রেখে। আর রাগারাগি না করে। ধুর, মনোজ তিওয়ারি আর রাগবেন কেন? মনোজ তিওয়ারি রাগতে যে ভুলেই গিয়েছেন!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.