রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়: ঈষৎ ঝুঁকে থাকা এক মূর্তি, অবিকল সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করছে যেন। যে মূর্তির ভার ‘সহাস্যে’ বহন করছে এক অতিকায় রৌপ্য ট্রফি। যে ট্রফি দেশের সমস্ত ঘরোয়া ক্রিকেটারদের কাছে বড় আকাঙ্ক্ষার বস্তু, যার নাম রনজি ট্রফি (Ranji Trophy)। অনুষ্টুপ মজুমদারের (Anustup Majumdar) ফেসবুক প্রোফাইলে ‘তল্লাশি’ চালালে ছবিটা পাওয়া যায়। বছর তিনেক আগে দেওয়া। প্রায় একই সময়ে, শুধু রনজি ফাইনালের আগে নয়, পরে। উপরে, একদম উপরে লেখা চারটে লাইন। কবীর সুমনের গানের লাইন– বারবার আসি আমরা দু’জন/বারবার ফিরে যাই/আবার আসব আবার বলব/শুধু তোমাকেই চাই…
পোস্টটা মনে আছে আজ? তিন বছর আগে সৌরাষ্ট্রেরই কাছে রনজি ফাইনাল হারের পরের ওই পোস্ট? অনুষ্টুপ, আরও এক রনজি ফাইনালের আগে সব মনে পড়ছে এখন? কথা বড় কম বলেন বঙ্গ নায়ক, শব্দ খরচে প্রবল অনীহা যেন। বরং হাসেন বেশি, এক ছেলেমানুষি হাসি, ভুবনভোলানো হাসি। ‘‘খুঁজে দেখেছেন ওটা? কী বলব আর? রনজি জিততে কে না চায়? আমিও চাই, ওটাই আমার আটত্রিশের তাড়না,’’ বলে আবার নৈঃশব্দকে জড়িয়ে ধরেন অনুষ্টুপ। সাংবাদিকতার শিক্ষা অনুসারে নিরন্তর খোঁচানো চলে। প্রশ্নের শক্তিশেলে। আবার যে সৌরাষ্ট্র সামনে, তিন বছর আগের মতো, সেবার হয়নি, এবার জুড়োবেন না জ্বালা? শুনে মৃদু মাথা নড়ে। সলজ্জ উত্তর আসে, ‘‘আরে, না না। সৌরাষ্ট্র বলে আলাদা মোটিভেশন পাচ্ছি, তেমন কিছু নয়।’’
কখনও কখনও মনে হয়, অনুষ্টুপ মজুমদারের মধ্যে বোধহয় দ্বৈত সত্ত্বা কাজ করে। একই অবয়ব-গৃহে যেন দু’জন অনুষ্টুপ মজুমদার বসবাস করেন। প্রথম জন, মুখবন্ধে-বর্ণিত চরিত্র। যিনি মিতভাষী, স্বভাব-লাজুক, সাংবাদিকদের ঝাঁক দেখলে যিনি শশব্যস্ত হয়ে পড়েন। দ্বিতীয় জন, অ্যাডভেঞ্চার স্পোর্টস প্রিয় অতি আগ্রাসী এক বঙ্গ ব্যাটিং নায়ক। টিম চাপে পড়লে যাঁর কাঁধের মাপ চওড়া হয়ে যায় আপনাআপনি, দুর্জয় সাহসে যিনি ঝাঁপিয়ে পড়েন বোলার-সংহারে, বেরিয়ে পড়েন রান-অন্বেষণে।
চলতি বছর তো বটেই। গত কয়েক বছরজুড়ে বাংলা ক্রিকেটে অনুষ্টুপের অবদান যা, তাতে এবার বত্রিশ বছর পর ইডেনে বাংলা রনজি ফাইনাল জিতলে ক্লাবহাউসে তাঁর মর্মর মূর্তি বসানো উচিত সিএবি-র! আটত্রিশ বছর বয়সে মরশুমে প্রায় আটশো রান, রনজি সেমিফাইনালে মধ্যপ্রদেশের মতো বাঘা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে দু’ইনিংসে সেঞ্চুরি ও আশি– এক জীবনে আর কত রূপকথা সৃষ্টি করে মানুষ? আর প্রতিবার, নিয়ম করে প্রতিবার, বাংলা যত পড়ে চাপে, শেষে ‘শাপ’ কাটে অনুষ্টুপের ব্যাটে! হাঁফিয়ে যান না? নাকি সেই ‘শাপমোচন’কেই জীবনের মোক্ষ করে নিয়েছেন? বাকিদের কাছে যা দিবাস্বপ্ন, সেটাই এখন আপনার কাছে ছেলেখেলা, ক্রিকেটের সহজ-পাঠ?
‘‘চাপ? সে তো নিতেই হবে। বয়স যত বাড়বে, প্রত্যাশা বাড়বে, চাপও বাড়বে পাল্লা দিয়ে। আর আমার কেন জানি না মনে হয়, চাপে আমার খেলা খোলে বেশি। ওটাকেই এখন বেশি উপভোগ করি,’’ শান্ত গলায় বলে যান দৃঢ় অনুষ্টুপ। এই যে ইডেনে খেলবেন জীবনের সর্বপ্রথম রনজি ফাইনাল, তার উত্তেজনা আছে অনুষ্টুপের। কিন্তু বড় নির্ভার সে উত্তেজনা। ঠিকই আছে। ভারতসেরা বোলাররা যাঁকে বিপাকে ফেলতে পারেন না, ঘরের মাঠ, উত্তুঙ্গ সমর্থন তাঁকে আর টলাতে পারবে কতটুকু? গ্রাহ্যই করার কথা নয়!
এক এক সময় মনে হয়, রেলওয়েজের ব্যর্থতায় আদতে লাভই হয়েছে অনুষ্টুপের। ভাল ব্যাটার বরাবরই তিনি ছিলেন। কিন্তু তাঁর আরাধ্য ফেলু মিত্তিরের মগজের মতো অত ধারালো ছিল না তাঁর অতীত-ব্যাটিং। যা হয়েছে পরবর্তীতে, বাংলায় কেরিয়ারের ‘ফেজ-টু’-তে। নাহ্, রেলওয়েজ পর্ব নিয়ে ভেতরে কোনও আক্ষেপ আর কাজ করে না অনুষ্টুপের। অক্লেশে বরং বলে দেন, ‘‘আমি নিজেও তখন ভাল খেলিনি, সেটা তো সত্যি।’’ কিন্তু বাংলা ক্রিকেটে তাঁর উত্তুঙ্গ সাফলে্যর দ্বিতীয় খণ্ড? তার ব্যাখ্যা কী, কী করছেন যা প্রথম খণ্ডে হয়নি? ‘‘অভিজ্ঞতা বলতে পারেন। এখন অনেক অভিজ্ঞ আমি। এখন নিজে যেমন বুঝতে পারি, কখন কী করতে হবে, তেমনই জুনিয়রদের বলে দিতে পারি অফস্পিনার বল করতে এলে ব্যাটটা কোথায় এগিয়ে দিতে হবে।’’
বাংলা ব্যাটিংয়ের দুর্ভেদ্য ‘প্রাচীর’ ঠিক করে ফেলেছেন যে, রনজি জিতুন বা না জিতুন, টুর্নামেন্ট শেষ হলে বিশপ লেফ্রয় রোডের বাড়িতে যাবেন একবার। যে বাড়িতে এককালে থাকতেন তাঁর আরাধ্য প্রদোষ চন্দ্র মিত্রের স্রষ্টা, দেখে আসবেন সেই সৃষ্টির ল্যাবরেটরি। আটত্রিশ বছরের জীবনে বহু বার ‘যাব’, ‘যাব’ করে যাওয়া তো হয়নি কখনও। সে যান অনুষ্টুপ। কিন্তু রনজি ট্রফিটা জিতলে আরও একটা ব্যাপার ঘটবে। তা কেউ দেখতে পাক বা না পাক।
সুদৃশ্য রৌপ্য ট্রফির উপর ঈষৎ ঝুঁকে থাকা মূর্তি অদৃশ্য ভাবে অবধারিত আরও ঝুঁকবে একটু, নতজানু হবে আরও, নতুন মালিকানার প্রতি অপার শ্রদ্ধায়, সম্মানে। আর হ্যাঁ, কবীর সুমনের গানের ওই চারটে লাইন অনুষ্টুপ মজুমদারকে আজীবনে আর কখনও আক্ষেপের কালিতে লিখতে হবে না!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.