হৃদিভাজণেষু বিরাট কোহলি,
মেলবোর্নে হ্যারিস রউফকে মারা ওই দুটো অসাধারণ ছক্কা মনে রাখতে চাই চিরদিন।
ভুলে যেতে চাই, গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে আপনার তর্কাতর্কি, উদ্ধত আচরণ।
পুণের মাঠে ব্যাকফুটে মারা আপনার ‘বিরাট’ ছক্কাটা বারবার দেখতে চাই। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে যে ছক্কা গোটা দেশকে সম্মোহীত করে দিয়েছিল।
ভুলে যেতে চাই, মাঠের ভিতরে অকারণে প্রতিপক্ষকে গালমন্দ করা।
সাত বছর আগের এক টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে আপনার অস্বাভাবিক ব্যাটিং আমৃত্যু মনে রাখতে চাই। সেই মন ভোলানো ব্যাটিং আপনাকে চেজমাস্টার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিল।
ভুলে যেতে চাই, নভীন উল হককে (Naveen Ul Haq) আপনার জুতো দেখানো।
পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেষ ৮ বলে ২৮ রান তাড়া আমি গভীর রাতে রোজ একবার করে দেখি। প্রায় হারতে বসা একটা ম্যাচ রক্তমাংসের একজন মানুষ কীভাবে বের করে আনতে পারেন, সেটা দেখে উজ্জীবিত হই। আমার রক্তের গতি বেড়ে যায়। গভীর রাতে বাড়তি আত্মবিশ্বাস পাই। জীবনযুদ্ধে যখন হেরে যেতে থাকি, তখন আপনার অমর ইনিংস দেখে নিভৃতে মনকে অভয় দিয়ে বলি, ”বিরাট কোহলি পারলে আমি পারব না কেন।”
সত্যি বলছি মিস্টার কোহলি, আপনার দুরন্ত রান চেজ ভুলতে চাই না। বরং তা দেখে অনুপ্রাণিত হতে চাই। ভুলে যেতে চাই, মাঠের ভিতরে আগ্রাসনের নামে আপনার অতি আগ্রাসন। যা দেখে নিন্দুকেরা বলেন, ”বিরাট ভদ্রতা-সভ্যতার সীমা ছাড়াচ্ছে।”
মেলবোর্নের সন্ধ্যায় সবুজ মাঠে আপনি ঘুসি ছুড়ছিলেন। পাকিস্তানকে হারানোর ঘুসি। বিরাট কোহলির হাত অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। সঈদ আনোয়ার অতীতে বলতেন, “সচিন দে দে, সিয়াচেন লে লে।”
আজ আনোয়ার খেললে হয়তো বলতেন, “বিরাটের হাত দুটো নিয়ে নাও, সিয়াচেন দিয়ে দাও।”
বিরাট কোহলি, আপনার পাক-জয় উদযাপন মনের ক্যানভাসে চিরকাল থেকে যাক। সেদিন আপনার সঙ্গে আমরাও শূন্যে ঘুসি ছুড়ছিলাম।
মন থেকে মুছে যাক, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের (Sourav Ganguly) সঙ্গে আপনার করমর্দন না করার দৃশ্য। ইডেনে গোলাপি বল টেস্টের সময়ে এই সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ই বলেছিলেন, ”এখন সবাই বিরাট কোহলিকে দেখতে মাঠে আসবে।”
বিরাট কোহলি দেশের শ্বাসপ্রশ্বাসে। আপনি প্রশংসা ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সৌরভকে। বলেছিলেন, ”দাদার আগ্রাসী অধিনায়কত্বই আমাদের আগ্রাসী হতে শিখিয়েছে।” গাভাসকর সেদিন খুব রাগ করেছিলেন। দাদা আর ভাইয়ের সম্পর্ক আজ এই পর্যায়ে পৌঁছল কেন বিরাট কোহলি?
বিরাট কোহলি, যেদিন মাঠের ভিতরেই অগ্রজ গৌতম গম্ভীরের (Gautam Gambhir) সঙ্গে আপনি বিতর্কে জড়ালেন, নভীন উল হককে গালমন্দ করলেন, সেদিন মনভোলানো এক দৃশ্যের জন্ম দিয়েছিলেন আপনি নিজেই।
পুলিশের কড়া নজর এড়িয়ে, বেড়া টপকে গ্যালারি থেকে সবার অলক্ষ্যে এক ভক্ত নেমে এসেছিলেন মাঠে। আপনাকে একবার ছোঁবেন বলে। আপনি ভক্তের ভগবান। আপনার পা ছুঁলেন ওই ভক্ত। আপনি তাঁকে বুকে টেনে নিলেন কোনও প্রতিক্রিয়া না দেখিয়েই। পরক্ষণেই সেই ভক্ত দু’ হাত তুললেন। যেন বিশ্বরূপ দর্শন হয়ে গিয়েছে তাঁর। মনের মণিকোঠায় থেকে যাক ওই দৃশ্য।
ভুলে যেতে চাই, আপনাকে নিয়ে নেতিবাচক সব কথা।
বিরাট কোহলি (Virat Kohli), কলকাতায় বিস্ফোরণ ঘটানো ওই সাংবাদিক বৈঠক ভুলব না কোনওদিন। ২০১৫ বিশ্বকাপ থেকে বিদায়ের পরে সবাই অনুষ্কা শর্মাকে অভিশাপ দিচ্ছিল। ভারতের হারের জন্য অনুষ্কাকে দায়ী করছিলেন দেশের মানুষ। অভিমানী আপনি কলকাতায় এসে বলে গেলেন, ”মানুষ যেভাবে আমার ব্যক্তিগত জীবন এবং অনুষ্কাকে নিয়ে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, তা অত্যন্ত অসম্মানজনক।”
শুধুমাত্র অনুষ্কাকে অসম্মানিত হতে হয়েছে বলে আপনি বিস্ফোরণ ঘটালেন, তা মানি না। একজন অসহায়, নিন্দিত মহিলার পাশে আপনি দাঁড়ালেন। এই সমাজ এখনও কলঙ্কিত করে মহিলাকে। পরাজয়ের জন্য কালি লেপন করে কারও বান্ধবী, কারও স্ত্রীকে। আপনি তার প্রতিবাদ জানালেন। মনে থেকে যাক সেই প্রতিবাদী বিরাটকে।
সব কিছু মন মতো হয় না বিরাট কোহলি। শুনেছি, আপনার পছন্দমতো প্রতিবেদন না হলে আপনি সাংবাদিককূলকে আক্রমণ করেন। বিশ্রী শব্দ প্রয়োগ করেন। ভুলে যেতে চাই দুর্বিনীত স্বভাবের বিরাট কোহলিকে।
আমার প্রাক্তন বসের কাছে শুনেছিলাম এক গল্প। বস তখন ক্রিকেট সংক্রান্ত একটি সংবাদমাধ্যমে কাজ করতেন। শচীন তেণ্ডুলকরের বিরুদ্ধে একটা শব্দ ব্যবহার করেছিলেন এক প্রতিবেদনে। শচীন সেই শব্দটা ভাল ভাবে নেননি। তিনি নাকি রোজ রাতে একটা নির্দিষ্ট সময়ে বিনীত ভাবে ফোন করে বসকে অনুরোধ করতেন শব্দটা সরিয়ে দেওয়ার জন্য। ভদ্রতার সীমা কোনওদিনই লঙ্ঘন করেননি শচীন। দিন কুড়ির কাছাকাছি ফোন করেছিলেন শচীন। বস বলতেন, ওই রাতগুলো অসহনীয় ছিল।
বিরাট কোহলি, আপনি বিলক্ষণ জানেন, ‘রেসপেক্ট ফর টিমমেটস অ্যান্ড অপোনেন্টস আর দ্য বেসিক স্পিরিট অফ দ্য গেম’। বিরাট কোহলি, ভুলে যেতে চাই, অনিল কুম্বলের সঙ্গে আপনার কুখ্যাত সম্পর্কের কথা। শিষ্যর আচরণে আহত গুরু ছেড়ে দিলেন দেশের কোচের দায়িত্ব। আদৌ কি ভাল বিজ্ঞাপন ছিল তা?
আপনার সঙ্গে বন্ধুত্ব টেকে না, এই অভিযোগ আর শুনতে চাই না। গৌতম গম্ভীরের সঙ্গে আপনার সম্পর্ক এখন তলানিতে। অথচ ইডেন গার্ডেন্সে গম্ভীর আপনার হাতেই তুলে দিয়েছিলেন তাঁর পুরস্কার। সেটা ছিল আপনার প্রথম সেঞ্চুরি। সেই সেঞ্চুরি স্মরণীয় করে রাখার জন্য গম্ভীর নিজে নেননি ম্যান অফ দ্য ম্যাচের পুরস্কার। এগিয়ে দিয়েছিলেন আপনাকে।
যে ইডেনে এমন ছবি তৈরি হয়েছিল, সেই ইডেনই আবার দেখেছে আপনি তেড়ে যাচ্ছেন গম্ভীরের দিকে।
বিরাট কোহলি, বিশ্বাস করুন সব ভুলে যেতে চাই। মনে রাখতে চাই আপনার ব্যাট আর বলের ঠিকঠাক টাইমিংয়ে তৈরি হওয়া মিঠে শব্দটা।
বিরাট কোহলি, আপনি দেশনায়ক। উঠতি ক্রিকেটারদের আইডল। আপনাকে দেখেই ছোট ছোট ছেলেরা ক্রিকেট মাঠে যান খেলা শিখতে। মা-বাবাদের চোখে স্বপ্ন থাকে, তাঁদের ছেলেও একদিন বিরাট কোহলি হবে। ভুলবেন না, নায়ক হলে দায়িত্ব বাড়ে। যা ইচ্ছা তাই করা যায় না। যাচ্ছেতাই কিছু মানায় না আপনাকে।
আপনার মেয়ে ভামিকা বড় হলে ওর বন্ধুরা নিশ্চয় পুরনো ভিডিও চালিয়ে বলবে, ”তোর বাবা দারুণ খেলত রে। একার হাতে কত ম্যাচ দেশকে জিতিয়েছে।” আপনার মেয়ে বাবার গর্বে গরিয়ান হবে।
ভামিকার বন্ধুরা আবার বলবে না তো, ”তোর বাবা মাঠে গালাগালি করত, লোককে অসম্মান করত”? বাবার অসম্মান মেনে নিতে পারবে মেয়ে?
বিরাট কোহলি, আমরা সবসময়ে বলব,”দ্য কিং ক্যান ডু নো রং।” আপনি ভুল করতে পারেন, তা আমরা মানছি না, মানব না।
বিরাট কোহলি, বিতর্কে না জড়ালেও আপনি গ্রেটই থাকবেন। আপনার গ্রেটনেসে কেউই থাবা বসাতে পারবে না। স্লেজিং না করলেও আপনি-ই জিতবেন হাতের বাইরে বেরিয়ে যাওয়া ম্যাচ।
বিরাট কোহলি, প্রতিপক্ষকে গালমন্দ না করলেও সেঞ্চুরি অনায়াসে আসবে আপনার ব্যাট থেকে। কারওর দিকে তেড়ে না গেলেও আপনি জন গণ মনের অধিনায়ক-ই থেকে যাবেন।
বিরাট কোহলি, একবার ভেবে দেখবেন প্লিজ। এ আমার একার কথা নয়। আপনার অগুনতি ভক্তের মনের কথা।
ইতি
আপনার একান্ত অনুরাগী,
কৃশানু মজুমদার
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.