বাংলাদেশ : ১৭৩ (মেহিদি হাসান ৪২, জাদেজা ৪/২৯)
ভারত : ১৭৪/৩ (রোহিত ৮৩ ন.আ)
রাজর্ষি গঙ্গোপাধ্যায়, দুবাই: লাম্যের। দুবাই ক্রিক। দুবাই শপিংমল। অমানুষিক বিত্ত আর বৈভব যদি উপরের তিনের মধ্যে দুবাইয়ের সেরা ট্যুরিস্ট স্পটের মানদণ্ড হয়, তৃতীয়র আশেপাশে কেউ আসবে না। অকাতর অর্থ যে একটা শহরের প্রাচুর্যকে কোথায় নিয়ে যেতে পারে, বুঝতে গেলে আমিরশাহির এই শহরে আসা ক্রিকেট পর্যটকের গন্তব্য একবার দুবাই শপিং মল হওয়া উচিত। মেন গেটের সামনে ফেরারি দাঁড় করানো। মলের ভেতরে ঢুকতে না ঢুকতে অপেক্ষা করবে বিশাল জলাশয় আর তার ‘ডান্সিং ফাউন্টেন।’ আধ ঘণ্টা পরপর নানা ভাষার গানের সঙ্গে ফোয়ারার নাচ চলে। ডান্সিং ফাউন্টেনের গা ছুঁয়ে আবার উঠে গিয়েছে অতিকায় বুর্জ খলিফা। রাতে বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু স্থাপত্যকে অদ্ভুত মায়াবী লাগে। তার আধো-অন্ধকার গায়ে মিটমিট আলো জ্বলে। ঠিক এক-একটা হীরকখণ্ড যেন। কেউ সযত্নে বুর্জ খলিফার গা-জুড়ে বসিয়ে দিয়েছে।
শুক্রবার রাতের দুবাই ক্রিকেট স্টেডিয়ামে ভারতীয় টিমকে দেখতে দেখতেও হীরকভাণ্ডার মনে হচ্ছিল। ‘মেন ইন ব্লু’ নামক কাঠামোর গায়ে কেউ যেন এক-একটা হীরকখণ্ড বসিয়ে দিয়েছে! কারও নাম রবীন্দ্র জাদেজা। কারও নাম ভুবনেশ্বর কুমার। কেউ জসপ্রীত বুমরাহ। কেউ বা আবার রোহিত গুরুনাথ শর্মা। বুধ এবং শুক্রবার। এশিয়া কাপের দু’দিনে দুই প্রতিবেশী দেশকে স্রেফ দুরমুশ করে ছাড়ল ভারত। এমন নৃশংস ভঙ্গিতে বাইশ গজে বুলডোজার চালাল যে, ইংল্যান্ড সফরের বিপর্যয় নিয়ে আর কেউ এক্ষুনি চট কথা বলবে বলে মনে হয় না। পাকিস্তান ম্যাচটা ভারত শেষ করেছিল মাত্র ২৯ ওভারে। বাংলাদেশ যুদ্ধ শেষ করতে লাগল তার সামান্য বেশি। ৩৬.২ ওভার। পাকিস্তান ব্যাটিং ভারতীয় বোলিংয়ের সামনে নতজানু হয়েছিল ১৬২ রানে। বাংলাদেশ ব্যাটিং গহ্বরে ঢুকে গেল ১৭৩ তুলতে না তুলতে।
[বোলার হিসেবে কেদার যাদবকে প্রতিষ্ঠা দিয়ে গেল পাকিস্তান ম্যাচ]
এত একতরফা লড়াই হলে সময় সময় বেশ বিরক্তিই লাগে। এত ক্লিনিক্যাল ক্রিকেট যারা খেলছে, তাদের জন্য ব্যাপারটা নিঃসন্দেহে ভাল। কিন্তু ক্রিকেট দর্শকের জন্য নয়। ভারতীয় ইনিংস পঁচিশ ওভারে পড়ার আগেই দেখা গেল, মাঠ অর্ধেক হয়ে গিয়েছে। বাংলাদেশি সমর্থকরা মাঠ ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। বাংলাদেশ ১৭৩ এর জবাবে তখনই রোহিত অপরাজিত হাফসেঞ্চুরি। খেলা দেখে আর হবেটা কী? মুশকিল হল, রোহিত যতই এ দিন অপরাজিত ৮৩ করে যান। যতই তাঁর ব্যাটিং সময় সময় মহম্মদ আজহারউদ্দিনের অলস ঔদ্ধত্য মনে পড়িয়ে দিক। এ দিনকার মতো ভারতীয় সর্বাধিনায়ক একজনই। রবীন্দ্র জাদেজা। ক্রিকেটকে লোকে অনিশ্চয়তার খেলা বলে। ক্রিকেট নিয়ে পুরাকালের প্রবাদ হল, শেষ বল না হওয়া পর্যন্ত ম্যাচের ভাগ্য নিয়ে শেষ কথা বলা যায় না। কে জানত, ক্রিকেটারের ক্ষেত্রেও সেটা সমান প্রযোজ্য। চোদ্দো মাস ক্রিকেট কারাগারে কোনও ক্রিকেটার থাকলেই তার জীবন নির্ধারিত হয়ে যায় না। ১৪ মাসের ‘নির্বাসন’ শেষ করেও সে পারে আবার ফিরতে। জীবনের আলোয় প্রত্যাবর্তন করতে।
রবীন্দ্র জাদেজার ওয়ান ডে কেরিয়ার মোটামুটি শেষই হয়ে গিয়েছিল। ৬ জুলাই, ২০১৭ কিংস্টনে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে শেষ ওয়ান ডে খেলেছিলেন। রবিচন্দ্রণ অশ্বিন তবু টেস্ট টিমে প্রায় নিয়মিত খেলেন। কিন্তু জাদেজা ওয়ান ডে-তে তো নয়ই। হালফিলে টেস্টেও ক্রমশ অনিয়মিত হয়ে পড়ছিলেন। কে জানত, একটা ওভাল টেস্ট বাঁ-হাতি অলরাউন্ডারের ক্রিকেট কেরিয়ারটাই আবার জোয়ারমুখো করে দেবে। হার্দিক পান্ডিয়া চোট পেয়ে ছিটকে না গেলে এখানেও ডাক পড়ত না। ক্রিকেট নামক সেই মহান অনিশ্চয়তাই জাদেজার ওয়ান ডে ক্রিকেট ফিরিয়ে দিয়ে গেল।
দশ ওভারে মাত্র ২৯ রান দিয়ে চার-চারটে উইকেট নিলেন জাদেজা! মুশফিকুর। মোসাদ্দেক। মিঠুন। সাকিব। সবাই এ দিন তাঁর স্পিন-ফাঁসে বধ। দুবাই ক্রিকেট প্রেসবক্সে পদ্মাপারের কোনও কোনও সাংবাদিক আফশোস করছিলেন যে, তামিম ইকবাল টুর্নামেন্ট থেকে ছিটকে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাটিংকেও ভেন্টিলেশনে ঢুকিয়ে দিয়েছেন। সহমত হওয়া যাচ্ছে না। কারণ শেষ দিকে বাংলাদেশেরই মেহিদি হাসান মিরাজ আর মাশরাফি মোর্তাজা অষ্টম উইকেটে ৬৬ রানের পার্টনারশিপ করে বুঝিয়ে গেলেন, দুবাই উইকেটে প্রথমে ব্যাট করা কোনও জটিল জিওমেট্রি ছিল না।
[চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে হারের মধুর প্রতিশোধ, এশিয়া কাপে পাক-বধ ভারতের]
চোদ্দো মাস পর জাদেজা প্রথম উইকেটটা তুললেন সাকিবের। কাকতালীয় ভাবে যিনি কি না জাদেজার শেষ ওয়ান ডে উইকেটও ছিলেন। গত জুনের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির বাংলাদেশ ম্যাচে। তবে সাকিবের উইকেট তোলার কৃতিত্বটা কোনও এক মহেন্দ্র সিং ধোনিকেও অনায়াসে দেওয়া যায়। ধোনির ব্যাটিং আর আগের মতো নেই। বড় শটে ঠিকঠাক টাইমিং হয় না আর। ব্যাটিংয়ের সময় অন্তত তাঁকে বিস্মৃত সিংহ লাগল এ দিনও। কিন্তু কিপিং আর অদৃশ্য অধিনায়কত্ব করার সময় নয়। জাদেজার ঠিক আগের বলটাই স্কোয়ার লেগ দিয়ে পাঠিয়ে বাউন্ডারি তুলে নিয়েছিলেন সাকিব। ধোনিকে দেখা গেল, আচমকা ক্যাপ্টেন রোহিতকে বলছেন মিড উইকেট থেকে শিখর ধাওয়ানকে তুলে এনে স্কোয়ার লেগে দাঁড়াতে। ধাওয়ান দাঁড়ালেন এবং পরের বলেই স্কোয়ার লেগে সোজা সাকিবের ক্যাচ! ধোনি আর হয়তো বছরখানেক খেলবেন। হয়তো বিশ্বকাপ পর্যন্ত। কিংবা তার একটু বেশি। কিন্তু তারপর? তাঁর মগজের সার্ভিস আর কোথা থেকে পাওয়া যাবে? কিপিংয়ের সময়ও তো। তিন স্পিনার নিয়ে নেমেছিল ভারত। যার বিরুদ্ধে প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানের পালটা অস্ত্র হতে পারত স্টেপ আউট। কিন্তু ধোনি উইকেটের ঘাড়ের কাছে গিয়ে এমন পজিশন নিলেন যে, দুঃস্বপ্নেও স্টেপ আউট করার কথা ভাবতে পারল না বাংলাদেশ। মুশফিকুর একবার স্টাম্পড হতে হতে বাঁচলেন। মোসাদ্দেক একবার বাঁচলেন। বাংলাদেশ তারপর আর দুঃসাহস দেখায়নি।
বাংলাদেশ ক্রিকেটের সঙ্গে জড়িত কেউ কেউ বলছিলেন, দুঃসাহস দূরের ব্যাপার। ভারতের সঙ্গে লড়ার মতো যথেষ্ট সাহসই বাংলাদেশ দেখাতে পারেনি। সহস্র শতাংশ ঠিক। আসলে বাংলাদেশ অনেকটাই ক্রিকেটের বাইরের ব্যাপারস্যাপার নিয়ে বেশি ভাবছিল। তারা গত কয়েক দিনে যত না ক্রিকেট নিয়ে কথা বলেছে, তার চেয়ে অনেক বেশি বলেছে এশিয়া কাপের সূচি নিয়ে। টুর্নামেন্ট থেকে গ্রুপ চ্যাম্পিয়নের ব্যাপারস্যাপার তুলে দেওয়া নিয়ে কাঁদুনি গেয়েছে। পরপর খেলা নিয়ে অভিযোগ তুলেছে। পদ্মাপারের মিডিয়া সঙ্গে জুড়েছে, এ সবই ভারতের চক্রান্ত। অথচ পরপর ম্যাচ ভারত খেলেছে। খেলেছে আফগানিস্তান। এমনিতেই ২০১৫ বিশ্বকাপের পর থেকে দু’দেশের ক্রিকেটীয় সম্পর্ক প্রায় রোনাল্ডো-মেসির ‘বন্ধুত্বে’র মতো। সামনে লোক দেখানো ভদ্রতা আছে। কিন্তু ভেতরে ভেতরে শৈত্য। হালফিলে খেলার আগে এই দু’দেশের জাতীয় সঙ্গীত বাজার সময় যে ভাল লাগাটা টের পাওয়া যায়, দু’টো জাতীয় সঙ্গীতই এক চিরবরেণ্য বাঙালির সৃষ্ট ভেবে, ঠিক ততটা মেজাজ খিঁচড়োতে শুরু করে খেলা গড়াতে থাকলে। রবীন্দ্র জাদেজার একটা ‘নো’ বল নিয়ে যে ভাবে ‘ভুয়া ভুয়া’ বিদ্রূপে ভরিয়ে দিল বাংলাদেশ ক্রিকেট জনতা, স্রেফ ন্যক্কারজনক।
কোথাও গিয়ে তাই মনে হচ্ছে, এটার তাই আবার দরকার ছিল। চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে ৯ উইকেটে হারের পর আবার ৭ উইকেটে হারাটা পদ্মাপারের প্রয়োজন ছিল। প্রয়োজন ছিল জাদেজার চার উইকেটে কারা আসল ‘ভুয়া’ বোঝানোর। দরকার ছিল রোহিতের অপরাজিত ৮৩-তে বাংলাদেশকে অভিযোগ ছেড়ে আবার ক্রিকেটে ফেরানোর। এতে উন্নতি হলে, লাভ হলে, পদ্মারই হবে। গঙ্গার নয়!
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.