ওড়িশার সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পের কালো বাঘ। প্রতিদিন চিত্র।
সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: হলুদের উপর কালো ডোরাকাটা। আর এই ‘সৌন্দর্য’-ই সুন্দরবনের দক্ষিণরায়কে ‘রয়্যাল’ করে তুলেছে। কিন্তু সেই হলুদের উপর কালো ডোরাকাটা-ই যে হারিয়ে যাচ্ছে ওড়িশার সিমলিপাল ব্যাঘ্র প্রকল্পে।
জিনগঠিত কারণে রূপ বদলে সিমলিপালের রয়্যাল বেঙ্গল হয়ে গিয়েছে কালো। দেশের চতুর্থ বৃহত্তম টাইগার রিজার্ভে এমন ঘটনায় উদ্বেগ ভারতের ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞদের। আর সেই কারণেই মহারাষ্ট্রের তাডোবা-আন্ধারি ব্যাঘ্র প্রকল্প থেকে সিমলিপালে জিনাত ও যমুনাকে নিয়ে আসা হয়। যাতে সেখানকার পুরুষ বাঘেদের সঙ্গে গোপন মেলামেশা হয়। হয় প্রজনন। কিন্তু দুজনেই ঘরছাড়া হয়ে যাওয়ায় রীতিমতো কালঘাম ছুটছে ওই ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষের। এই কারণেই জিনাত হয়ে গিয়েছে এতটা গুরুত্বপূর্ণ। যার জন্য একমাস ধরে ওই ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষের আইএফএস পদমর্যাদার ইস্ট, ওয়েস্ট ফিল্ড ডিরেক্টর জিনাতের পিছন পিছন মাটি কামড়ে পড়ে রয়েছেন। কখনও ঝাড়খণ্ডের জঙ্গল। কখনও আবার বাংলায়। রবিবার বেশি রাতে রাইকা পাহাড়ের জঙ্গলে জিনাতের জন্য ফাঁদ পাতার সময় ওই আধিকারিকরা এই কথা তুলে ধরেন। রাজ্যের মুখ্য বনপাল (দক্ষিণ-পশ্চিম চক্র) বিদ্যুৎ সরকার বলেন, “এরকম একটি প্রকল্প ওই ব্যাঘ্র প্রকল্প নিয়েছে। এটি একটি দীর্ঘমেয়াদী কাজ। সেই কারণেই জিনাত এতটা গুরুত্বপূর্ণ।”
ওই ব্যাঘ্র প্রকল্পের আধিকারিকদের সূত্রে জানা গিয়েছে, বর্তমানে সেখানে যে ৩৫টি বাঘ রয়েছে তার মধ্যে অর্ধেকের বেশি শরীরে কালচে রঙ। যেন কেউ ‘ময়লা’ করে দিয়েছে বাঘের শরীর। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সিমলিপালে থাকা বাঘগুলি নিজেদের মধ্যেই মেটিং করছে। যাকে বলা হয় ‘ইনব্রিডিং’। হয়তো কোনও একটা বাঘের জিন মেলানিস্টিক। যার জিনগত বৈশিষ্ট্য সমগ্র ব্যাঘ্র প্রকল্পে ছড়িয়ে পড়ে। যার দরুন সেখানকার একের পর এক বাঘেদের কালো বানিয়ে দিচ্ছে।
১৯৯৩ সাল থেকে সিমলিপালের রয়্যাল বেঙ্গলের এমন রূপ বদল চোখে পড়েছে। যার পোশাকি নাম ‘সিউডো-মেলানিস্টিক টাইগার’। চলতি বছর থেকে সিমলিপালে এই কালো রঙ বাঘ যেন ছেয়ে যায়। তাতেই চিন্তা বাড়ে দেশের ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞদের। এমনকি ন্যাশনাল টাইগার কনজারভেশন কর্তৃপক্ষের কর্তারাও আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, এভাবে চলতে থাকলে রয়্যাল বেঙ্গলের সেই পুরনো চেহারাটাই হারিয়ে যাবে না তো! তখন রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারকে আর রয়্যাল বলা যাবে? তবে জিনঘটিত এই সমস্যার বিষয়টির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দিয়েছেন ওই প্রকল্পের আধিকারিকরা। তাঁদের কথায়, চুলে মেলানিন থাকার কারণে কালো রঙের চুল হয়। বয়স বাড়লে মানুষের চুল সাদা হয় মেলানিনের পরিমাণ কমে গেলে। পশ্চিম ভারতে যে ব্ল্যাক প্যান্থার বা কালো চিতা বাঘ দেখা যায় তার কারণও সেই মেলানিজম। কিন্তু তাই বলে রয়্যাল বেঙ্গলের এমন দর্শন!
ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞদের কথায়, জিনের সমস্যায় সিমলিপালের বাঘেদের চামড়ায় মেলানিনের পরিমাণ বেড়ে গিয়েছে। তাই তাদের পিঠ হয়ে গিয়েছে কালো কুচকুচে। একনজরে দেখলে মনে হবে, কেউ যেন আলকাতরা ঢেলে দিয়েছেন। এই বাঘদেরকেই বলা হয় মেলানিস্টিক টাইগার বা কালো বাঘ। বাঘের এই রূপ বদলকে ঘিরে ওড়িশা সরকার বিষয়টিকে পর্যটনে জুড়ে দিয়েছে। কালো বাঘ সাফারি পর্যন্ত চলছে। কিন্তু অন্যদিকে উদ্বেগ বাড়িয়ে দিচ্ছে ব্যাঘ্র বিশেষজ্ঞদের। তাই হলুদ ডোরাকাটা ফিরিয়ে আনতেই গত ১৫ নভেম্বর জিনাত ও যমুনাকে নিয়ে আসা হয়। কিন্তু আপাতত জিনাতের ঠিকানা বাংলায় বান্দোয়ানের রাইকা পাহাড়-জঙ্গল। তবে যমুনা রয়েছে ঘরেই- বালাসোরে। কিন্তু দুই ঘরছাড়াদের নাগাল পায়নি ওই ব্যাঘ্র প্রকল্প কর্তৃপক্ষ।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.