Advertisement
Advertisement
Lucy

কিশোরী লুসিই আমাদের পূর্বসূরি! কেমন ছিল আদিম মানবীর শেষ দিন?

কেমন ছিল ৩২ লক্ষ বছর আগের একদিন?

What the iconic fossil Lucy reveals about our ancient ancestors
Published by: Biswadip Dey
  • Posted:November 24, 2024 5:18 pm
  • Updated:November 24, 2024 5:29 pm  

বিশ্বদীপ দে: লুসি হাঁটছিল। ৩২ লক্ষ বছর আগে। তবু আমরা তাকে দেখতে পাচ্ছি। আমরা মানে আধুনিক মানুষেরা। অস্ট্রালোপিথেকাস জনগোষ্ঠীর এক সদ্য কিশোরীর শেষ দিনটা ‘খুঁজে’ পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাঁরা মানেন সব ফসিলসই স্পেশাল। কিন্তু লুসির মতো কেউই নয়। জীবাশ্মবিদ জেরেমি ডিসিলভার মতে, ”লুসি আমাদের পরশপাথর। সমস্ত গবেষণাতেই ওর কাছে ফিরে আসতে হয়। আর ও সেটারই যোগ্য।” জলাশয়ের কাছে মৃত্যু হয়েছিল লুসির। কিন্তু সে আজও ‘জীবিত’। আধুনিক মানুষ নিজেদের বিবর্তনের ধারাকে বুঝতে যে ফসিলসগুলি ‘পড়তে’ চেষ্টা করেছে সেই তালিকায় লুসি এক অনতিক্রম্য নাম।

১৯৭৪ সালের ২৪ নভেম্বর। আজ থেকে ঠিক পঞ্চাশ বছর আগের একদিন। ইথিওপিয়ার হাডারে জীবাশ্মবিদ ডোনাল্ড জোহানসন হোঁচট খেলেন পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে থাকা এক হাড়ের খোঁচায়। শুরু হল ওই অঞ্চলে খোঁজাখুঁজি। পরবর্তী সপ্তাহ দুয়েক সময়ে মিলল এক মানব শরীরের ৪০ শতাংশ হাড়গোড়। এযাবৎ লভ্য আদিম মানুষের সমস্ত ফসিলসের মধ্যে এটাই ‘পূর্ণতা’য় সবার আগে। তাই লুসির কাছে ফিরে আসতেই হয় বিজ্ঞানীদের। তাকে ছুঁয়েই আদিম মানবের পথচলার ইতিহাসকে বোঝার চেষ্টা করে চলেছেন তাঁরা। কিন্তু লুসি নামটা কোথা থেকে এল? জানা যায়, বিখ্যাত বিটলসের বিখ্যাত গান ‘লুসি ইন দ্য স্কাই উইথ ডায়মন্ডস’ থেকেই আদিম কিশোরীকে এই নাম দেওয়া হয়েছিল। 

Advertisement
এখানেই মিলেছিল লুসির ফসিলস

গত পাঁচ দশক ধরে লুসির শরীরের ৪০ শতাংশ হাড়গোড়কে খুঁটিয়ে দেখেছেন জীবাশ্মবিদরা। তাঁরা নিশ্চিত অস্ট্রালোপিথেকাস আফারেন্সিসরাই সরাসরি মানব প্রজাতির পূর্বপুরুষ। আদিম যুগ থেকে আধুনিক মানুষ পর্যন্ত যে ‘বংশলতিকা’, তা খুঁজে পাওয়ার পথে তৈরি হওয়া নানা প্রশ্নের উত্তর পঞ্চাশ বছর ধরে দিয়ে চলেছে লুসি। আর এই বিস্তৃত গবেষণা পরিষ্কার করে দিয়েছে, তার সম্পর্কে এত বেশি তথ্য হাতে এসেছে যে তার শেষ দিনটা এত দূরের সময় থেকেও যেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।

কেমন ছিল লুসির জীবনের শেষ দিনটা? বিজ্ঞানীরা জানাচ্ছেন, দিনের শুরুটা সম্ভবত ছিল একেবারেই সাধারণ। গাছের অনেক উপরে ঘুম ভেঙেছিল লুসির। তার পর সে নেমে এসেছিল মাটিতে। আজকের কোনও মানব শিশু যেভাবে হাঁটে, সেভাবেই টলমল করে সে পথ চলত। দৃষ্টি থাকত সজাগ। কেননা আদিম লতাগুল্মে ঢাকা সেই অরণ্যময় পৃথিবীতে সর্বত্রই ছিল বিপদের আশঙ্কা! যখন তখন গাছপালার আড়াল থেকে লাফিয়ে পড়তে পারে বড় দাঁতওয়ালা বাঘ থেকে হায়না। জলাশয়ে গিজগিজ করছে অতিকায় কুমির। অসতর্ক হওয়া মানেই নিশ্চিত মৃত্যু। সেই যুগে তাই আমাদের পূর্বপুরুষরা কেউই একা থাকত না। দল বেঁধে থাকাটাই ছিল স্বাভাবিক। কেননা সমাজ সেই অর্থে গড়ে না উঠলেও দলে থাকার উপযোগিতা ভালোই বুঝেছিল তারা। সেই আদিম পৃথিবী… হাসপাতাল নেই, ঘরবাড়ি নেই, আশ্রয় বলতে গাছপালা, চারপাশে ছড়িয়ে রয়েছে নরসংহারক সব প্রাণীর দল… পরস্পরের পাশে না দাঁড়ালে ছোটখাটো চেহারার অস্ট্রালোপিথেকাসদের বাঁচাবে কে?

লুসি নামের সেই কিশোরী

লুসির শেষ দিনের কথা সবটা বলার আগে তার সম্পর্কে আর একটু বলা যাক। তার হাড়গোড় পরীক্ষা করে বিজ্ঞানীদের প্রাথমিক ভাবে মনে হয়েছিল হয়তো সে একেবারেই ছোট্ট একটা মেয়ে। বয়স ৬-৭-এর বেশি হবে না। কিন্তু তার গজিয়ে ওঠা আক্কেল দাঁত দেখে মনে হচ্ছে মৃত্যুর সময় সে ছিল এক সদ্য কিশোরী। এবং সম্ভবত তার শিশুসন্তানও ছিল। যদিও অপেক্ষাকৃত অনেক সরু শ্রোণিদেশ দেখে অনুমান করা যায়, সন্তান প্রসব করতে কোনও প্রাগৈতিহাসিক ‘দাইমা’কে তার প্রয়োজন হয়েছিল। সেই যুগে ১৫ থেকে ২০ জন আদিম মানব-মানবী একসঙ্গে থাকত বলেই মনে করা হয়। ঠিক আজকের যুগের শিম্পাঞ্জিদের মতোই। সুতরাং সেই দলেরই কোনও পুরুষই সম্ভবত ছিল তার পুরুষ সঙ্গী।

এহেন লুসি জীবনের শেষদিনও হয়তো একলা ছিল না। আগেই বলা হয়েছে একসঙ্গে থাকাই ছিল তাদের অভ্যেস। এবং হয়তো লুসির কোলেই ছিল তার সদ্যোজাত। তাকে নিয়েই সে খুঁজে বেড়াচ্ছিল খাবার। অর্থাৎ ফলমূল, পোকামাকড় ইত্যাদি। সেই আদিম পৃথিবীতে কৃষিকাজ ছিল অধরা। খাবার মজুত করতেও সম্ভবত জানা ছিল না তাদের। তাই লুসিও অন্যদের মতোই খাবার পেয়েই মুখে পুরে ফেলত। এবং শেষদিন ঘাস, শিকড় ও পোকামাকড় সে কিছু খেয়েওছিল। তার দাঁতে লেগে থাকা রাসায়নিক পরীক্ষা করে তেমনটাই জানতে পেরেছেন বিজ্ঞানীরা। এবং হয়তো পাখির ডিম, হরিণের মাংসও সে ছিঁড়ে খেয়েছিল অল্পবিস্তর। আসলে সেই ভয়ংকর পরিবেশে ধীরগতির দ্বিপদ প্রাণী হিসেবে খুব বেশি বাছাইয়ের সুযোগ ছিল না তাদের সামনে। আগুন জ্বেলে রান্না করা শিখতে তখনও ঢের বাকি।

লুসির আবিষ্কর্তা ডোনাল্ড জোহানসন

জীবনের শেষ মুহূর্তে কোনও জলাশয়ের কাছে ছিল লুসি। গবেষকরা তাঁর মৃত্যুর দুটি কারণ খুঁজে পেয়েছেন।একটি হল, কুমিরের শিকার হওয়া। আচমকাই হয়তো জল থেকে উঠে এসে সে ছিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিল লুসিকে। আরও একটি কারণ হতে পারে গাছ থেকে পড়ে যাওয়া। দুই সম্ভাবনাই রয়েছে। প্রথমটির সপক্ষে প্রমাণ পেলভিসে শ্বাপদের দাঁতের চিহ্ন। দ্বিতীয় ক্ষেত্রে চিহ্ন হিসেবে রয়েছে ডান কাঁধ, পাঁজর ও হাঁটু ভাঙার সংকেত।

৩২ লক্ষ বছর পরও ‘জীবিত’ লুসি

৩২ লক্ষ বছর আগে মারা যাওয়ার সময় সেই অসহায় কিশোরী কি ভাবতে পেরেছিল কালখণ্ডের কোনও এক প্রান্ত থেকে তার সেই শেষদিনটিকে নির্মাণ করবে তার উত্তরসূরিরা! জাগতিক মৃত্যুর পর্ব পেরিয়ে এসে সে থেকে যাবে মানুষের বিবর্তনের এক মাইলফলক হয়ে। যে ফলককে ছুঁয়ে ছুঁয়েই নিজেদের ইতিহাসকে সম্পূর্ণ করবে হোমো স্যাপিয়েন্সরা। জেরেমি ডিসিলভার কথাটায় আবার ফিরে আসতে হবে শেষে। সমস্ত গবেষণাতেই ওর কাছে ফিরে আসতে হয়। লুসি তাই থেকে গিয়েছে আজও। থেকে যাবে আরও বহুদিন। যতদিন বিজ্ঞান থাকবে।

Sangbad Pratidin News App

খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ

Advertisement