সুমিত বিশ্বাস, পুরুলিয়া: গাছের সঙ্গে গাছের বিয়ে! না, কোনও সংস্কার বা কুসংস্কারের বশে নয়। এমন কর্মকাণ্ডের পিছনে উদ্দেশ্য অতি সাধু। অবাধে বৃক্ষ নিধন রুখতে গ্রামের প্রাচীন অশ্বত্থ ও বট গাছের বিয়ে দিলেন মানুষজন। উলুধ্বনি, মালাবদল, মন্ত্রোচ্চারণ-সহ হিন্দু শাস্ত্র মতে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হল অশ্বত্থ ও বট বৃক্ষ। শুধু এটুকুই নয়, দুই বৃক্ষের এমন শুভ পরিণয়ে পাত পড়ল গ্রামে। চলল বালক ভোজনও।
বিশ্ব উষ্ণায়নের থাবায় বসুন্ধরার শরীর পুড়ছে, অনাবৃষ্টিতে আরও শুকনো, খটখটে হয়ে যাচ্ছে রুখাশুখা এলাকা। তারপরেও গাছ কেটে জঙ্গল সাফ করার বিরাম নেই। তাতে সংকট বাড়ছে ধরিত্রীর, বিপদ ক্রমশ বাড়ছে সাধারণ মানুষজন। সেই কথা উপলব্ধি করেই গাছ কাটা ঠেকাতে দুই গাছের বিয়ে দিলেন পুরুলিয়ার কোটশিলা বনাঞ্চলের স্থানীয় বাসিন্দারা। বেগুনকোদরে মানুষজনের এমন উদ্যোগের তারিফ করেছে বনদপ্তর। যাঁরা পরিবেশ রক্ষায় এভাবে এগিয়ে এসে অজ পাড়া-গাঁয়ে নজির সৃষ্টি করেছেন, তাঁদের সকলকে পুরস্কৃত করার ঘোষণা করেছে কোটশিলা বনাঞ্চল কর্তৃপক্ষ।
এই বৃক্ষ দম্পতি ব্যক্তিগত মালিকানাধীন। আজ থেকে প্রায় দু’দশক আগে দুটি গাছের চারা রোপন করেছিলেন এই গ্রামের বাসিন্দা ফটিকচন্দ্র দত্ত ও তাঁর স্ত্রী শেফালিবালা দত্ত। এখন দু’জনই বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তাই তাঁদের কথামতোই ছেলে ধীরেনচন্দ্র দত্ত গ্রামবাসীদের সঙ্গে নিয়ে, পুরোহিত ডেকে একেবারে হিন্দু শাস্ত্র মেনে দুই গাছের বিয়ে দেন। শুক্রবার দুই গাছের বিয়ে দেখতে এলাকার পরিবেশপ্রেমী মানুষজন-সহ ওই এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দা শামিল হয়েছিলেন। কোটশিলা বনাঞ্চলের আধিকারিক সোমা দাস বলেন, “অভিনব উদ্যোগ। বৃক্ষ নিধন ঠেকাতে এমন প্রয়াস সত্যিই আমার বনাঞ্চলে নজির গড়েছে।যাঁদের উদ্যোগে এই গাছের বিয়ে দেওয়া হয়েছে, তাঁদেরকে আমার বনাঞ্চল থেকে আগামী ৩ মার্চ বন্যপ্রাণ দিবসে পুরস্কৃত করব। এই কাজের মধ্য দিয়ে ওই গ্রামের মানুষজন আলাদা বার্তা দিলেন।”
এই দুই গাছের বিয়েতে বর–কনের মতই তাদেরকে সাজিয়ে তোলা হয়। গাছের চারপাশে আলপনা দিয়ে বট বৃক্ষে দেওয়া হয় চন্দনের ফোঁটা। কলাগাছ দিয়ে তৈরি করা হয় ছাঁদনাতলাও। স্থানীয় বাসিন্দা ধীরেনচন্দ্র দত্ত বলেন, “বাবা–মা এই গাছ রোপন করেছিলেন। তাঁদের বয়স এখন প্রায় আশি। যেভাবে চারপাশে গাছ কাটা হচ্ছে, তাতে তাঁরা ভীষণই উদ্বিগ্ন। তাই বাবা–মা বললেন, পুরোহিত ডেকে মন্ত্র আউড়ে দুই গাছের বিয়ে দিয়ে দিতে। তাহলে আর এই গাছ কাটার কেউ সাহস পাবেন না।”
এলাকার পরিবেশপ্রেমী তপন কুমার বিদের কথায়, “যেভাবে পুরোহিত ডেকে পুজোর মাধ্যমে দুই গাছের বিয়ে দেওয়া হল, তাতে আর এই দুই গাছে কুঠার ছোঁয়াতে পারবেন না কেউ। ফলে গ্রীষ্মের দাবদাহ থেকে রক্ষা মিলবে। ক্লান্ত পথিকরা এই বৃক্ষের ছায়াতলে ঠাঁই পাবেন। আশ্রয় পাবে পাখিরাও।” সাত–আট ফুট দূরত্বে থাকা এই দুই বৃক্ষ এখন দম্পতি। আর তাদের দাম্পত্যে বেঁধে দিয়ে গাছ কাটা ঠেকাতে যে উদ্যোগ নিলেন অজ পাড়া গাঁ বেগুনকোদরের বাসিন্দারা, তা সত্যিই নজির হয়ে রইল।
ছবি: অমিত সিং দেও।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.