ক্ষীরোদ ভট্টাচার্য: ২০০০ সালে মানুষ, ইঁদুর ও বাঁদরের জিনগত কাঠামোর (জেনেটিক ইনস্ট্রাকশন বা জিনোম সিকোয়েন্স) বিশ্লেষণের বিশাল গবেষণার কাজ শুরু হয়েছিল, সেই ধারাবাহিকতা বজায় রেখে গত দু’দশক ধরে চলেছে এই বিশ্বের ২৪০টি স্তন্যপায়ী প্রাণীর জিনোম সিকোয়েন্স স্টাডি। সেই সমীক্ষার বিশ্লেষণ করে এক অনভিপ্রেত ফলাফল সম্প্রতি হাতে এসেছে। কোটি কোটি বছরের বিবর্তনে এক প্রাণী থেকে নতুন প্রাণী তৈরি হয়েছে।
গত সপ্তাহে বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানপত্রিকা ‘সায়েন্স’-এ মোট ১১টি প্রবন্ধে তা প্রকাশ করা হয়েছে। এই ঘটনায় উচ্ছ্বসিত হয়ে খবর হিসাবে তা প্রকাশ করেছে বিশ্বের আর এক প্রথম সারির বিজ্ঞানপত্রিকা ‘নেচার’। বিশ্বব্যাপী এই বৃহৎ গবেষণা প্রকল্পটির নাম রাখা হয়েছে ‘জুনোমিয়া’। এই গবেষণার সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন ৩০টি গবেষণা প্রতিষ্ঠানের ১৫০ জন বিশিষ্ট বিজ্ঞানী।
কী পাওয়া গিয়েছে এই সুবৃহৎ গবেষণায়? মানুষ-সহ বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীর ক্রমবিবর্তনের ধারা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে এই সমীক্ষার ফলাফলে। দেখা যাচ্ছে, লক্ষ কোটি বছর ধরে কীভাবে এই প্রথিবীর প্রাণীকুল বিবর্তিত হয়েছে। ‘ফাইলোজেনেটিক ট্রি’র (প্রজাতিগত বিন্যাস) মাধ্যমে দেখানো হয়েছে, বিভিন্ন প্রাণী কত লক্ষ কোটি বছর পরে কোন প্রাণীতে বিবর্তিত হয়েছে। এও জানা যাচ্ছে, কেন কোনও প্রাণী শীতঘুমে যায়, কেন কোনও প্রাণীর ঘ্রাণশক্তি বেশি, কেন কোনও প্রাণীর শরীর থেকে মাথাটা এত বড় যে নড়তেই সমস্যা।
এই গবেষণা প্রকল্পের পরিসর এখানেই শেষ নয়। এরই অন্তর্গত ‘জিনোম ওয়াইড অ্যাসোসিয়েশন স্টাডি’। তাতে উঠে এসেছে মানুষের কোন জিন, কোন রোগের জন্য দায়ী; যা ভবিষ্যতে রোগের পূর্বাভাস, রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসায় বিপুলভাবে সাহায্য করবে বলে বিজ্ঞানীদের আশা। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স-এর এক অধ্যাপকের কথায়, গত ১০ বছর ধরে বন্যপ্রাণীদের জিনোম সিকোয়েন্সিং নিয়ে যথেষ্ট আগ্রহ তৈরি হয়েছে। তিমির বেশ কয়েকটি প্রজাতির জিন বিশ্লেষণ (সিকোয়েন্সিং) করে একেবারে আণবিক স্তরে (মলিকিউলার লেভেল) বোঝার চেষ্টা করা হয়েছে, কী ভাবে দীর্ঘ জীবন পায় তারা, কীভাবে তারা জয় করে ক্যানসারের আশঙ্কাকে। ঘোড়া এবং কুকুরদের জিন সিকোয়েন্সিং করে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়েছে তাদের গতিবেগের নেপথ্যে দায়ী তথাকথিত ‘স্পিড জিন’ মায়োস্ট্যাটিন। ‘জুনোমিয়া’র মতো আন্তর্জাতিক প্রয়াসে নানা প্রাণীর জিন সিকোয়েন্স করে মানুষের জিনগত রোগে আলো ফেলা সম্ভব হবে।
বিজ্ঞানের জগতে এই প্রকল্পের সুদূরপ্রসারী প্রভাব কোথায়? বিশেষজ্ঞদের অভিমত, বিশ্বজুড়ে একই সময়ে একই বিষয়ে এমন গবেষণার মাধ্যমে প্রাণীর জিনোমে ভাল করে পরখ করার কাজটা শুরু হয়ে গেল। এর অন্দরে ঢুকে খোঁজ চালালে প্রকৃতির রহস্য উন্মোচনে আরও একধাপ এগোনো যাবে। আর তাই এই ধরনের আরও গবেষণা প্রকল্পের কাজ হাতে নেওয়া হচ্ছে, যেমনটা নেওয়া হয়েছে ‘ভার্টিব্রেট জিনোম সিকোয়েন্স’ প্রকল্প। গবেষকদের অভিমত, চার্লস ডারউইন প্রাণীর গঠনগত চরিত্র বিশ্লেষণ করে বিবর্তনের যে তত্ত্ব বিশ্বের সামনে খাড়া করেছিলেন, তা একেবারে আণবিক স্তরে জিন বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রমাণিত হচ্ছে, এটা একই সঙ্গে অভূতপূর্ব ও গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। মৈনাকও মনে করছেন, এর ফলে স্তন্যপায়ীদের বিবর্তনের উপর গবেষণায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসতে পারে। ‘জুনোমিয়া’য় ‘ট্যাসিট’ নামে যে প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে, তা এককথায় অনবদ্য। কারণ, তা টিস্যু-নির্দিষ্ট নানাবিধ ‘এনহ্যান্সার’কে চিহ্নিত করতে পারে। এই ‘এনহ্যান্সার’গুলি জিন নয়, কিন্তু নানাবিধ প্রজাতির মধ্যে তার বহিঃপ্রকাশ রয়েছে বলে একাধিক প্রজাতির মধ্যে নানা বৈশিষ্ট্য প্রকাশে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। মানুষের কিছু ‘এনহ্যান্সার’-এ ইতিমধ্যেই ক্যানসার-সহ নানা রোগের সঙ্গে সম্পর্কিত মিউটেশনের খোঁজ মিলেছে। ফলে অন্য স্তন্যপায়ীদের মধ্যে এই এনহ্যান্সার-এর মতো ডিএনএ উপাদান এবং মানুষের দেহে তার সমসত্ত্ব সিকোয়েন্সের খোঁজ মানবদেহের রোগ-ব্যাধির নানা অজানা দিকের উপর আলোকপাত করতে পারে বলে বিজ্ঞানীদের আশা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.