নবেন্দু ঘোষ,বসিরহাট: প্লাস্টিক বিরোধী অভিযান চলছে দেশজুড়ে। সে সম্পর্কে সকলকে সচেতন করতে অভিনব এক রাস্তা নিলেন উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালির গৃহশিক্ষক। কয়েকজনকে ছাত্রকে সঙ্গে নিয়ে তিনি প্লাস্টিকের জলের বোতল দিয়ে তৈরি করে ফেললেন একটি গোটা জলযান। আর তা নিয়ে ভেসে পড়লেন নদীতে। সন্দেশখালি ব্লকের বিভিন্ন জায়গা নদীপথে ঘুরেই তিনি প্লাস্টিকের বিপদ সম্পর্কিত বার্তা দিলেন।
সন্দেশখালি ব্লকের কালিনগর ১ ব্লকের রাজু সর্দার পেশায় গৃহশিক্ষক। প্লাস্টিকের বোতল ব্যবহার নিয়ে আশেপাশের মানুষজনকে সচেতন করতে তিনি ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে পরিকল্পনা করেন। পাশের গ্রাম ছোট শেহেরায় বাসিন্দা শুভেন্দু মণ্ডল, রবিশংকর প্রসাদ, সইফুদ্দিন মোল্লা, রাইহান মোল্লা-সহ ন’জন ছাত্র এবং আরও কয়েকজন ছাত্রী তাঁদের গৃহশিক্ষক রাজু সর্দারের উৎসাহে উৎসাহিত হয়ে অক্টোবরের প্রথম দিকে
বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্লাস্টিকের জলের বোতল সংগ্রহ করেন প্রায় দু’সপ্তাহ ধরে। এরপর রাতদিন সবাই মিলে কাজ করে ৫৬০০ প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে একটি জলযান তৈরি করে। যেখানে একটি মেশিনও আছে, যাতে জলযানটি চালাতে হাল বাইতে না হয়।
এই জলযানটি নিয়ে ২০ অক্টোবর থেকে তাঁরা নদীতে নেমে পড়েছে। এবং এই জলযানটি করে তাঁরা ইতিমধ্যে হিঙ্গলগঞ্জ ও সন্দেশখালি ব্লকের ধামাখালি, সরবেরিয়া, কালিনগর, গাজিখালি, নেজাট, বেদেমারি, ভবানীপুর-সহ বিভিন্ন প্রত্যন্ত এলাকার বিভিন্ন খেয়া ঘাটে তাঁরা যান। ২৮ তারিখ পর্যন্ত তাঁরা নদীপথে এভাবেই মিনাখা ও হাসনাবাদ ব্লকের বিভিন্ন খেয়াঘাটে যাবেন বলে জানা গেল। বুধবার বাইলানির ডাঁশা নদীর
খেয়াঘাটে সন্ধেবেলায় গিয়ে দেখা গেল, তাঁদের প্লাস্টিকের বোতল দিয়ে তৈরি এই জলযান দেখতে ভিড় জমিয়েছেন খেয়াঘাটের যাত্রী ও স্থানীয় বাসিন্দারা। তাঁরা জানালেন, ডাঁশা নদী দিয়ে যাবেন ইছামতী নদীর দিকে। এই জলযান দেখতে মানুষের উৎসাহ ছিল চোখে পড়ার মতো। এবং এত মানুষকে কাছে পেয়ে এই জলযানটির মূল কারিগর রাজু সর্দার তাঁদের জানালেন প্লাস্টিকের বোতলে জল খাওয়ার বিপদ
সম্পর্কে। সেইসঙ্গে ডেঙ্গু নিয়েই মানুষকে সচেতন করলেন।
এই জলযানের গায়ে প্লাস্টিকের ক্ষতিকর দিক তুলে ধরে বেশ কিছু ব্যানার ছিল। রাজু বাবুরা মানুষজনকে বিস্তারিতভাবে জানালেন, কেন প্লাস্টিক বোতল ত্যাগ করা উচিৎ। এমনকি অনেককে দেখা গেল উৎসাহিত ওই জলযানে চড়তে। মূলত প্লাস্টিকের বোতল সাজিয়ে, ভালো করে বেঁধে, তার ওপর চট দিয়ে ঘিরে ঘর করা হয়েছে। লম্বায় প্রায় ১৪ ফুট আর চওড়া প্রায় ৪ ফুট। এবং জলযানটির ভিতরে আছে সোলার লাইট, রয়েছে রান্নার সমস্থ উপকরণ। আর রয়েছে কলসি তে জল। নেই কোনও প্লাস্টিকের জলের বোতল। এবং এই জলযানের সঙ্গে আছে বোতল দিয়ে তৈরি আরও একটি ভাসমান স্থান, যাকে “টয়লেট” বলে চিহ্নিত করলেন এই দলের সদস্যরা। যেহেতু এই জলযানে
করেই ৮ দিন নদী পথে ঘুরবে এই জলযানের সদস্যরা এবং এই জলযানেই দিন-রাত কাটাবে, তাঁদের তাই সব ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বলে জানালেন রাজু সরদার।
কিন্তু এই জলযান কতটা নিরপদ? সেই বিষয় প্রশ্ন করা হলে, দলের প্রধান রাজু বললেন, “সম্পূর্ণ নিরাপদ কারণ আমাদের প্রত্যেকের গায়ে লাইফ জ্যাকেট থাকে, যখন আমরা এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাই।” তিনি দেখালেন প্লাস্টিকের বোতল পরপর সাজিয়ে দড়ি দিয়ে বেঁধে একটি চেন তৈরি করা হয়েছে, যেটা গায়ে বেঁধে জলে পড়ে গেলে মাথা সম্পূর্ণভাবে ভেসে থাকবে যে কোনও পরিস্থিতিতে, এমনটাই দাবি রাজু সর্দারের। এমনকী তার প্রমাণ দিতে তিনি ওই “লাইফ জ্যাকেট” পড়ে নদীতে লাফ দিলেন এবং দেখালেন কীভাবে নিরাপদে ভেসে থাকা যায়।
প্লাস্টিকের বোতলে জল খাওয়া যে বিপজ্জনক, সেটা নিয়েই কেন তাঁরা উদ্যোগী হলেন? উত্তরটা দিলেন রাজুবাবু নিজেই। তিনি জানান, তাঁর খুব নিকট আত্মীয়কে তিনি পেটের ক্যানসারে অকালে মৃত্যুবরণ করতে দেখেছেন এবং এই মৃত্যুই তাঁকে নাড়িয়ে দেয়। পরে তিনি যখন জানলেন চিকিৎসকদের থেকে জানতে পারেন যে প্লাস্টিকের বোতলে জল খাওয়ার জন্য এমন হয়ে থাকতে পারে, তখনই পণ করেন যে আর কাউকে যেন এমন অকালে চলে যেতে না হয়। তাই কালিনগর কলেজের অস্থায়ী কর্মী রাজুবাবু তিনি যাদের টিউশান পড়াতেন,তাঁদেরকে নিয়ে তৈরি করে ফেললেন এই জলযান। এটি তৈরির খরচও রাজু বহন করেছেন বেশিরভাগটা, আর বাকি ছাত্ররা পুজোর
হাতখরচ বাঁচিয়ে এই জলযান তৈরিতে খরচ করেছে। সবমিলিয়ে খরচ হয়েছে, ১৯ হাজার। তাঁদের একমাত্র লক্ষ্য, মানুষ সচেতন হোক এই প্লাস্টিকের বোতলে জল খাওয়ার বিপদ থেকে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.