‘দৃষ্টিপাত’-এ যাযাবর লিখেছিলেন, ‘আধুনিক বিজ্ঞান মানুষকে দিয়েছে বেগ, কেড়ে নিয়েছে আবেগ’। সভ্যতা যদি যন্ত্র হয়, বিজ্ঞান তবে যন্ত্রী। বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সমান্তরালেই সূচিত হচ্ছে ধ্বংসের ঘূর্ণি। ‘অতিযান্ত্রিকতা’ মানুষের বোধের ভূমিটি কেড়ে নিচ্ছে কি না, সেই প্রশ্ন ওঠা এই একুশ শতকে অনিবার্য। এ-বিষয়ে সচেতনতা জারির চেষ্টা চলেছে বিভিন্ন সময়ে, নানা কথার মোড়কে। কিন্তু ‘সভ্য’ মানুষ তাতে কান দেয়নি। তাই কল্যাণকর বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারের পাশাপাশি তৈরি হয়েছে মারণাস্ত্রও– রাসায়নিক বিষক্রিয়ায় দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে এই বিশ্ব। বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে তৈরি হয়েছে প্রভূত সংশয়– আদৌ এর পরিণতি শুভ হবে তো? যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।
মেশিন যখন মানুষের মতোই বুদ্ধিমত্তা দেখায়, সেটিই তখন ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ হিসাবে বিবেচিত হয়। কিন্তু এর ফলে মানব সভ্যতা যে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে না, তা নিয়ে কোনও বিজ্ঞানীই সুনিশ্চিত আশ্বাস দিতে পারছেন না। তেমনই, আর-এক বৈপ্লবিক আবিষ্কার কেড়ে নিতে পারে রাতের ঘুম।
ব্রিটেনের কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা ঘোষণা করেছেন, ইঁদুরের স্টেম সেল থেকে তাঁরা বিশ্বের প্রথম ‘কৃত্রিম ভ্রূণ’ (‘সিনথেটিক এমব্রায়ো’) তৈরি করতে সফল হয়েছেন। এতে মস্তিষ্ক, স্পন্দনক্ষম হৃদ্যন্ত্র-ব্যতীত শরীরের অন্য অঙ্গ তৈরির উপাদান বিদ্যমান। শরীরের আদি কোষ ‘স্টেম সেল’। সাধারণত, জন্মের পর একটি কোষ থেকেই বাকি কোষ তৈরি হয়। অর্থাৎ, শুক্রাণু ও ডিম্বাণু ব্যবহার না করেই স্টেম সেল দিয়ে কৃত্রিম ভ্রূণের মডেল তৈরি হল। এমন দাবি অবশ্য আগেও করেছিলেন ইজরায়েলের ‘উইজমান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স’-এর বিজ্ঞানীরা। তবে গবেষণাপত্র প্রকাশ করলেও পরবর্তীকালে তা নিয়ে তাঁরা উচ্চবাচ্য করেননি। দ্বিতীয়ত, ভ্রূণ তৈরি হওয়া মানেই প্রাণীর জন্ম নিশ্চিত নয়। এর জন্য রয়েছে দীর্ঘ ও জটিল পথ। আর ইঁদুরের স্টেম সেলের মাধ্যমে কৃত্রিম ভ্রূণ তৈরির চেয়ে মানুষের কৃত্রিম ভ্রূণ তৈরি অনেক কঠিন। তবু এটাও নিশ্চিত যে, মানুষের ক্ষেত্রে তা বাস্তবায়িত হলে বহু নিঃসন্তান দম্পতির সন্তানলাভ সম্ভবপর হবে। আমেরিকার ফিলাডেলফিয়ায় এর আগে বিজ্ঞানীরা ‘কৃত্রিম গর্ভ’ তৈরি করেছিলেন। প্রি-ম্যাচিওর শিশুদের মৃতু্যহার কমানোর উপায় হিসাবে যদিও তা এখনও অপরীক্ষিত। দ্বিতীয়ত, বাবা-মায়ের কঠিন জিনগত অসুখ বা মারণ রোগের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করার সম্ভাবনা থাকবে।
কিন্তু সবচেয়ে বড় যে আশঙ্কা, তা হল ‘ডিজাইনার বেবি’ উৎপাদনের। যাদের ক্ষমতা আছে, তারা অর্থব্যয় করে ‘সর্বগুণযুক্ত, নীরোগ, শক্তিশালী’ সন্তানের বাবা-মা হবে। সেই সমস্ত সন্তানই কি ভবিষ্যৎ বিশ্বে চালকের আসনে বসবে? তাদের কাছে ক্রমাগত পর্যুদস্ত হতে থাকবে স্বাভাবিক প্রজননে জন্ম নেওয়া শিশু এবং পরবর্তী কালের নাগরিক? ‘একমাত্রিক’ সভ্যতায় সমস্ত ‘বৈচিত্র’ লোপ পাবে? সভ্যতার এই সংকটই কি আমাদের একমাত্র ভবিতব্য?
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.