দীপালি সেন: আকাশে পাক খাচ্ছে নানা রঙের ঘুড়ি। থেকে থেকে ভেসে আসছে ‘ভোঁকাট্টা’র উল্লাস। দক্ষিণ কলকাতার একটি আবাসনের ছাদে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন বছর পঞ্চাশের এক প্রৌঢ়। হয়তো ফিরে গিয়েছিলেন নিজের ছোটবেলায়। আচমকা ছন্দপতন। আকাশ থেকে কালো রঙের কী যেন একটা পাক খেতে খেতে পড়ছে। প্রখর সূর্যালোক, চোখ ধাঁধিয়ে যায়। বস্তুটি কী, তা ঠাহর হচ্ছিল না। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই ধপাস করে সেটি এসে পড়ল তাঁরই ছাদে। তাকিয়ে দেখলেন, একটি চিল (Kite)। তার ডানা রক্ত ভেজা, ক্ষতবিক্ষত, যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে। হলটা কী? আশপাশ দেখে বুঝলেন, ভিলেন শখের ঘুড়ির ধারালো মাঞ্জা। তাতেই আহত হয়ে ওড়ার ক্ষমতা হারিয়ে সটান আছড়ে পড়েছে ছাদে। সঙ্গে সঙ্গে বন্যপ্রাণ উদ্ধারকেন্দ্রের হেল্পলাইনে ফোন করেন প্রৌঢ়।
এই ঘটনা বিচ্ছিন্ন নয়। রোজই ঘটে। শুধু দক্ষিণ কলকাতাতেও নয়। আকছারই কলকাতা-সহ সারা রাজ্যজুড়েই মনুষ্য-সৃষ্ট মাঞ্জা-ফাঁদে পড়ে আহত হয় চিল কিংবা অন্য পাখি। তবে স্বস্তির বিষয়, আহত হলেও অধিকাংশ চিল সুস্থ হয়ে যায়। মারা যায় গুটিকয়। মানুষের হাতেই আহত পাখিগুলি মানুষের শুশ্রূষাতেই সুস্থ হয়ে ওঠে। আর যাদের দৌলতে ফের আকাশে ডানা মেলতে পারে চিলগুলি, তাঁরা রয়েছেন সল্টলেকের (Salt Lake) ‘ডাক্তারখানা’য়। বন্যপ্রাণ আইনে সংরক্ষিত চিল আহত হওয়ার খবর শুনলেই দৌড়ে যায় বনকর্মীদের একটি দল। উদ্ধার করে নিয়ে আসেন সল্টলেকের ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ অ্যান্ড ট্রানজিট সেন্টারে। শুরু হয় চিকিৎসা ও যত্নে সুস্থ করে তোলার পালা।
সল্টলেকের এই বন্যপ্রাণ উদ্ধারকেন্দ্রে যে কোনও সময় ৭০ থেকে ৮০টি চিলের চিকিৎসা চলে। কখনও কখনও সংখ্যাটা ১০০-ও ছাড়িয়ে যায়। সল্টলেকের ওয়াইল্ড লাইফ রেসকিউ অ্যান্ড ট্রানজিট সেন্টারের রেঞ্জ অফিসার মনোজকুমার যশ জানিয়েছেন, প্রতিদিনই গড়ে ৫টা করে আহত চিল উদ্ধার করা হচ্ছে। কখনও কখনও এরও বেশি উদ্ধার হচ্ছে। কলকাতার মধ্যে সবথেকে বেশি আহত চিল মেলে দক্ষিণ কলকাতা থেকেই। দমদম, দক্ষিণেশ্বরেও পাওয়া যায় খোঁজ। এছাড়া, গোটা কলকাতা (Kolkata) থেকেই কমবেশি আহত চিল উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকেন্দ্রের আধিকারিকদের দাবি, অধিকাংশ চিলই আহত হয় মাঞ্জাসুতোয়। পাশাপাশি, গাছে বা বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে সেখান থেকে পড়ে গিয়ে, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে বা উঁচুতে ওড়ার সময় কোনও কিছুতে ধাক্কা খেয়েও আহত হয় চিল। সুস্থ করতে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন-সহ বিভিন্ন ওষুধ ও পথ্য দেওয়া হয়। শিকারি পাখিগুলির মেনুতে থাকে মুরগির মাংস ও জল। মনোজবাবু বলেন, “একটি চিলকে ন্যূনতম ১০০ গ্রাম মাংস দেওয়া হয়। প্রয়োজনবোধে তার বেশিও মাংস বরাদ্দ করা হয়। সারাদিনে ভাগে ভাগে দু’তিন বার খাবার দেওয়া হয়।”
চিলগুলির সুস্থ হয়ে উঠতে কতটা সময় লাগে, তা অনেকটাই তাদের আঘাতের পরিমাণের উপর নির্ভরশীল। তবে, সবথেকে কম আহত চিলেরও সুস্থ হয়ে মুক্ত আকাশে উড়ে যেতে ন্যূনতম এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে। কারও কারও ক্ষেত্রে দুই থেকে তিনমাস পর্যন্ত ঠিকানা হয় সল্টলেকের এই অভয়াশ্রম। তবে বেশিদিন রাখা হয় না সুস্থ হয়ে ওঠা চিলগুলিকে। ওড়ার অভ্যাস বিগড়ে যেতে পারে তাই। এপ্রিলেই সুস্থ হওয়া প্রায় ৩০টি চিলকে ঝাড়গ্রামের (Jhargram) আকাশে উড়িয়ে দিয়ে আসা হয়েছে।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.