বিশ্বদীপ দে: সে এক আশ্চর্য সময়। পুরনো পৃথিবীটা গুঁড়িয়ে গিয়ে গড়ে উঠছে একটা নতুন পৃথিবী। আইনস্টাইন নামের এক যুগন্ধরের হাত ধরে সেই ছায়া পড়েছে পদার্থবিদ্যার জগতেও। সেখানকার পুরনো ইমারত ভাঙাগড়ার খেলায় ‘কোয়ান্টাম থিওরি’ কথাটা অহরহ শোনা যাচ্ছে বিজ্ঞানী মহলে। কিন্তু সেই বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব তখনও কেমন ছেঁড়া ছেঁড়া। যেন একটা ‘জিগসো পাজল’কে মেলানোর কাজ চলছে। কিন্তু সম্পূর্ণ মেলানো যাচ্ছে না। তাবড় সব গবেষক চেষ্টা করলেও কাজের কাজ কিছু হয়ে উঠছে না। ঠিক সেই সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক বঙ্গসন্তান আবির্ভূত হলেন যেন ‘শূন্য’ থেকে। তৃতীয় বিশ্বের এক পরাধীন দেশের সেই যুবক চমকে দিলেন বিশ্বকে। সত্যেন্দ্রনাথ বসু নামটা একটা সাদা বিদ্যুৎরেখার মতো ঝলসে উঠল বিজ্ঞান গবেষণার আকাশে। সেই বিদ্যুতের সাদা দাগ আজও একই রকম স্পষ্ট। এবছর সেই ঘটনার শতবার্ষিকী। ‘মাত্র’ একশো বছর আগের ঘটনা। বাঙালি অবশ্য ভুলতে মারাত্মক পারঙ্গম। তাই এহেন এক বৈপ্লবিক ঘটনা চুপিসারেই পা দিচ্ছে শতবর্ষে।
এই লেখার সামান্য পরিসরে আমরা ছুঁয়ে দেখব সত্যেন বোস নাম্নী এক মানুষকে। যাঁর কথা শুনতে বসলে মনে হতে পারে বুঝি কোনও প্রতিভাবান লেখকের কল্পনায় নির্মিত এক ‘লার্জার দ্যান লাইফ’ চরিত্র। ১৮৯৪ সালে কলকাতায় জন্ম তাঁর। অল্প বয়স থেকেই গণিতে তাঁর অসামান্য প্রতিভা ধরা পড়ে গিয়েছিল শিক্ষকদের চোখে। হিন্দু স্কুলে টেস্ট পরীক্ষায় কিশোর সত্যেনকে একশোয় একশো দশ দিয়ে বসলেন উপেন্দ্রনাথ বক্সী! কী ব্যাপার? প্রধান শিক্ষক জানতে চাইলে তিনি জানান, সমস্ত অঙ্কই করে দিয়েছে কিশোরটি। কেবল তাই নয়, জ্যামিতির একস্ট্রাগুলোও প্রতিটিরই সমাধান করেছে দু-তিন ভাবে! তাঁর মত ছিল, এমন এক ছাত্রকে একশো দশ না দিলে ‘জাস্টিস’ হত না! কেবল অঙ্ক নয় অবশ্য। সাহিত্য, ইতিহাস সবেতেই সমান দক্ষ ছিলেন সত্যেন্দ্রনাথ। চোখের সমস্যা ছিল। কিন্তু সেই প্রতিকূলতাকে অনায়াসে উড়িয়ে দিয়ে স্নাতকোত্তর পাশ করলেন। বিএসসি ও এমএসসি, সবেতেই বলা বাহুল্য ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট।
আর এই পরীক্ষাগুলোতে তাঁর পরেই যাঁর নাম ছিল তিনি মেঘনাদ সাহা। ভাবা যায়! আর এক কিংবদন্তি বিজ্ঞানী। তিনিই তরুণ সত্যেনের অভিন্নহৃদয় বন্ধু। প্রেসিডেন্সিতে তাঁরা ছাড়াও ছিলেন একগুচ্ছ অসামান্য প্রতিভাবান পড়ুয়া। যাই হোক, এমএসসি পড়তে পড়তে বিয়েও সেরে ফেললেন সত্যেন্দ্রনাথ। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিদ্যায় রিডার পদে চাকরি হল তাঁর। কে জানত ছাত্র পড়াতে পড়াতেই কী কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবেন তিনি! তবে সেকথায় আসার আগে বলা যাক বোস-সাহার এক অসামান্য কীর্তির কথা। তাঁরা দুজনে মিলে জার্মান থেকে ইংরাজিতে অনুবাদ করলেন অ্য়ালবার্ট আইনস্টাইনের স্পেশাল ও জেনারেল রিলেটিভিটির মূল গবেষণাপত্রগুলি। বিশ্বে তাঁরাই প্রথম এই কাজ করলেন। আর সেজন্য রীতিমতো জার্মান ভাষা শিখেও নিয়েছিলেন দ্রুত! আসলে বিশ্বের তৎকালীন গুরুত্বপূর্ণ পেপারগুলি সবই জার্মান ভাষায় লেখা। তাই বাধ্যতই ভাষাটি শিখে নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন দুই বন্ধু।
১৯২৪ সালে ফিরি। যেখান থেকে এই লেখা শুরু হয়েছিল। ছাত্রদের পদার্থবিদ্যা পড়ানোর সময় ম্যাক্স প্লাংকের ‘ল অফ ব্ল্যাক বডি রেডিয়েশন’-এ এসে পড়ুয়াদের প্রশ্নের সামনে পড়তে হচ্ছিল। আসলে এই সূত্রটি অনেকেরই পছন্দ ছিল না। এতে সংশোধনের জায়গা রয়েছে বলেই মনে করা হচ্ছিল। সত্যেন্দ্রনাথও ছিলেন সেই দলেই। তিনি কণার গণনা পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তুললেন। আর তুলেই ক্ষান্ত হলেন না। নিজস্ব তত্ত্ব অনুসারে গবেষণাও শুরু করে দিলেন। লিখে ফেললেন এক পেপার। যার শিরোনাম ‘প্লাংক’স ল অ্যান্ড লাইট কোয়ান্টাম হাইপোথিসিস’। আর সেটি পাঠিয়ে দিলেন ব্রিটিশ জার্নাল ফিলজফিক্যাল ম্যাগাজিনে। কিন্তু সেটি মনোনীত হল না। অন্য অনেকে হলে হয়তো হতোদ্যম হয়ে ক্ষান্ত দিতেন বিষয়টিতে।
কিন্তু সত্যেন বোস (Satyendra Nath Bose) সরাসরি সেটা পাঠিয়ে দিলেন খোদ আইনস্টাইনকে। মনে রাখতে হবে, ততদিনে আইনস্টাইন নোবেল পুরস্কার পেয়ে গিয়েছেন। তাঁকে নিয়ে বলা যায় তোলপাড় চলছে। এমন মানুষকে বঙ্গের ‘অখ্যাত’ এক যুবক নিজের গবেষণাপত্রটি পাঠাতে কোনও দ্বিধা করেননি। আইনস্টাইন (ALbert Einstein) চমকে ওঠেন সেটি পড়ে। নিজেই লেখাটি জার্মান ভাষায় অনুবাদ করেন। এবং সেটি প্রকাশের উদ্যোগও নেন। অচিরেই ‘ৎজাইৎটশ্রিফট ফুর ফিজিক’ নামের এক জার্মান জার্নালে তা প্রকাশিত হয়েছিল। বাকিটা এক স্বর্ণাভ ইতিহাস। সেই লেখার পরবর্তী ধাপ হিসেবে আরও পেপার লিখতে লাগলেন আইনস্টাইন। জন্ম হল বোস-আইনস্টাইন সংখ্যাতত্ত্বের। পরবর্তী সময়ে যার প্রয়োগ থেকে সন্ধান মেলে বোসন (Boson) কণার। এর সুবাদে ইউরোপে যান সত্যেন্দ্রনাথ। দুবছরের জন্য আইনস্টাইনের সঙ্গে এক্স রে ও ক্রিস্টালোগ্রাফি নিয়ে গবেষণাও করেন। গোটা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে তাঁর নাম।
এবছর শতবর্ষ পেরল সত্যেন্দ্রনাথের লেখা সেই পেপারের। কিন্তু এই দেশ তথা বাংলাতে কি কোনও হেলদোল দেখা যাচ্ছে? বিজ্ঞানের জটিল তত্ত্ব সকলের বোধগম্য হবে না। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর কীর্তির ঔজ্জ্বল্যকে অনুভব করতে গেলে বিজ্ঞানের বিস্তৃত জ্ঞান না থাকলেও চলে। কেবল তাঁর জীবনীর দিকে তাকালেই বিস্ময় ঘিরে ধরে। বিজ্ঞানে এমন ডুবে থাকা মানুষটি আদপে ছিলেন নির্লিপ্ত। লন্ডনের রয়েল সোসাইটির ফেলো হয়েছেন। ভূষিত হয়েছে পদ্মবিভূষণ ও দেশিকোত্তমে। ভারত সরকার জাতীয় অধ্যাপক হিসেবে মনোনীত করেছিল তাঁকে। কিন্তু এই বিপুল খ্যাতি ও সম্মানের সমান্তরালে সারা জীবন তিনি ছিলেন এক অসাধারণ চিন্তাবিদ। কবিতার ছন্দ নিয়ে বলে যেতে পারতেন অনর্গল। আর হাতে একবার এসরাজ উঠে এলে? তন্ময় হয়ে ভেসে বেড়াতেন সুরের জগতে। সংখ্যা, ছন্দ ও সুরের মূর্চ্ছনায় ব্রহ্মাণ্ডের অনন্ত স্রোতে অন্তর্লীন হয়ে যেতেন। তাঁর নোবেল না পাওয়া নিয়ে অনুরাগীরা ক্ষুব্ধ। কিন্তু তিনি থেকে গিয়েছেন এসবের থেকে অনেক দূরে। এই নির্লিপ্তি, এই সাধনাই তাঁকে চিরকালীন করে রেখেছে। বাঙালি তাঁকে মনে রাখল কি না তা নিয়ে কোনও দিনই ভাবিত ছিলেন না সত্যেন্দ্রনাথ। তবু এই বিস্মৃতির দায় বোধহয় এড়াতে পারি না আমরা।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.