বিশ্বদীপ দে: পিঠ পুড়ছে ফিরে শো। এই প্রচলিত বাক্যটিকে সামান্য বদলে করে দেওয়াই যায় ‘পৃথিবী পুড়ছে ফিরে শো’। চোখের সামনে সাধের এই নীল গ্রহ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। অথচ সেই গ্রহের শ্রেষ্ঠ প্রাণী মানুষ যেন কী এক অসচেতনতার গহ্বরে বসে তা অবলীলায় প্রত্যক্ষ করে চলেছে। কিন্তু সবটাই অন্ধকার নয়। পানিহাটির পরিবেশ চেতনা মঞ্চের কর্মকাণ্ড দেখলে আশা জাগে- ‘আলো ক্রমে আসিতেছে’। এই পরিবেশপ্রেমী সংগঠন চেষ্টা করছে তাদের মতো করে পরিবেশ সংকটের (Climate crisis) মোকাবিলা করার। যা আগামিদিনে হয়তো আরও বহু মানুষকে পথ দেখাবে। সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক অনির্বাণ মজুমদার সংবাদ প্রতিদিন ডিজিটালকে বললেন, ”এটা সেই অর্থে কোনও সমাজসেবা বলে আমরা দেখছিই না। এ আমাদের বাঁচার লড়াই। আমাদের সকলের অস্তিত্বের সংগ্রাম।”
গত বছর স্থাপিত হয়েছিল পরিবেশ চেতনা মঞ্চ। ‘পত্রক’ নামের এক সংগঠন যে সংগঠনের আহ্বায়ক। তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে ‘গাছের ছায়া’, ‘দাও ফিরে সে অরণ্য’, ‘ছায়াদলে’র মতো ১৪টি সংগঠন একত্রিত হয়ে তৈরি করেছে সংগঠনটি। আর তার পর থেকেই একের পর এক কর্মসূচির মধ্যে দিয়ে এগিয়ে চলা। যা ইতিমধ্যেই সাড়া ফেলেছে। পানিহাটি শহর থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে বিস্তৃত হচ্ছে পরিবেশ চেতনা মঞ্চের ছায়া।
পরিবেশ সংক্রান্ত তিনটি বিষয় সবচেয়ে বেশি ভাবাচ্ছে। এপ্রসঙ্গে বলতে গিয়ে অনির্বাণ জানাচ্ছেন, ”কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণাপত্র থেকে জানা যাচ্ছে, পশ্চিমবঙ্গ দেশের মধ্যে অতিমাত্রায় তাপপ্রবাহ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হতে চলেছে। এবার পানিহাটিতে গরমকালে তাপমাত্রা ৪৩ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড ছাড়িয়েছে। জলাভূমি কমে কংক্রিটের শহর বেড়ে চলেছে। হয়ে উঠছে আর্বান হিট আইল্যান্ড। আবার, বৃষ্টির জল কংক্রিটে পড়ে ড্রেন দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। তা মাটির নিচে যাচ্ছে না। ফলে ভূগর্ভস্থ জলের (Ground water) স্তর ক্রমেই নেমে যাচ্ছে। এতে জলে আর্সেনিক মেশার আশঙ্কা বাড়ছে। অর্থাৎ একদিকে তাপমাত্রার লাফিয়ে বাড়া, অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ জলের এই সংকট। পাশাপাশি অপরিকল্পিত ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট জনজীবন আরও দুর্বিসহ করে তুলেছে।”
মূলত এই তিন সংকটের মোকাবিলা করতেই পরিবেশ চেতনা মঞ্চের কর্মকাণ্ড। যার অন্যতম বৃষ্টির জলকে (Rain Water) মাটির নিচে পাঠানো। কৃষ্ণনগরে এই ধরনের প্রচেষ্টা হয়েছে আগেই। তা দেখেই এখানেও একই ভাবে শুরু হয়েছে একই প্রক্রিয়া। মধ্যমগ্রাম গার্লস হাই স্কুলের বিরাট ছাদকে ব্যবহার করা হচ্ছে আন্ডারগ্রাউন্ড রেন ওয়াটার রিচার্জের কাজে। প্রতিবারের বৃষ্টিতে ঝামা ও বালির স্তরের মধ্যে দিয়ে পরিশ্রুত হয়ে ১৫ হাজার লিটার জল চলে যাচ্ছে মাটির তলায়। পরবর্তী লক্ষ্য দেশবন্ধু গার্লস স্কুলের ছাদ ও স্কুলের সামনের কংক্রিটের লনকে ব্যবহার করা। এবং ধীরে ধীরে অন্যত্রও এই পরিকল্পনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেই সঙ্গে নতুন আবাসন-নির্মাতাদের এই উদ্যোগে শামিল করা এবং এই বিষয়ে সংশ্লিষ্ট আইন লাগু করার উদ্যোগ। দীর্ঘ পরিকল্পনা রয়েছে পরিবেশ চেতনা মঞ্চের।
এরই পাশাপাশি তাপমাত্রাকে বাগে আনতেও বৃক্ষরোপণ ও তার পরিচর্যার উদ্যোগ নিচ্ছে সংগঠনটি। লক্ষ্য প্রতিটি ওয়ার্ডে ন্যূনতম দুশোটি গাছ লাগানো এবং একই সঙ্গে পানিহাটি শহরে অন্তত ৫টি গ্রিন জোন তৈরি করা। এরই পাশাপাশি সবুজায়নের লাগাতার প্রচারে জনমনকে বৃক্ষরোপণে উৎসাহিত করা। এদিকে ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট তথা বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়েও নানা পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছে। সিঙ্গল ইউজ প্লাস্টিক ব্যাগের ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট নির্দেশিকা জারি করা এবং সেই মর্মে ব্যাপক প্রচারের আয়োজন করা যার মধ্যে একটি। যথোপযুক্ত ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম লাগু করার লক্ষ্যে এভাবেই পদক্ষেপ করতে চাইছে পরিবেশ চেতনা মঞ্চ।
এই ধরনের পরিকল্পনার পাশাপাশি আন্তঃস্কুল গ্রিন কুইজের আয়োজন থেকে শুরু করে জনসচেতনতা বাড়াতে স্কুলে জলবায়ু সংকট বিষয়ক তথ্যচিত্র প্রদর্শন করা- অনির্বাণদের ভাবনাচিন্তায় রয়েছে নানা বিষয়। যার কিছু রূপায়িত। কিছু আগামিদিনেই করা হবে। সব মিলিয়ে সামগ্রিক ভাবে পরিবেশকে সুস্থ করে তোলার জন্য একটা ব্যাপক পরিকল্পনার মধ্যে দিয়ে যাওয়াই মূল লক্ষ্য এই সংগঠনের। ছোট ছোট পরিবর্তনও যে পরিবেশকে কীভাবে বাঁচাতে পারে সেপ্রসঙ্গে অনির্বাণ মনে করালেন, পরিবেশ চেতনা মঞ্চ আয়োজিত অরণ্য সপ্তাহে যোগ দিয়ে কল্যাণী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিজন সরকার কী বলেছিলেন। মাধ্য়মিত পরীক্ষায় ‘যে কোনও পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর লেখো’ থেকে ‘যে কোনও’ শব্দটি বাদ দিলেও একই অর্থ থাকে। যেহেতু মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীর সংখ্যা ৮ থেকে ৯ লক্ষ, তাই স্রেফ এই দুটি শব্দকে বাদ দিলে বেঁচে যায় সাড়ে তিন হাজার পাতা! এভাবেই ব্যবহারিক জীবনে একটু পরিবর্তনই আনতে পারে বড় বদল।
সম্প্রতি মঞ্চের সঙ্গে কথা হয়েছে পানিহাটি পুরসভার চেয়ারম্যানেরও। অনির্বাণের কথায়, ”ওঁরা আমাদের কথা মন দিয়ে শুনেছেন। বিশেষ করে ভূগর্ভস্থ জলের স্তর ২.৫ মিটার নেমে যাওয়ার বিষয়টি। এখন দেখার প্রশাসন আমাদের দিকে কতটা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়।” তবে এই লড়াইয়ে স্রেফ সংগঠন কিংবা প্রশাসন নয়, সাধারণ মানুষকেও চাইছে পরিবেশ চেতনা মঞ্চ। তাই সংগঠনগুলির পাশাপাশি কেউ ব্যক্তিগত ভাবে যুক্ত হতে চাইলেও তাঁকে স্বাগত জানাচ্ছেন সংগঠনের সভাপতি দুলাল চক্রবর্তী।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.