ধ্রুবজ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়, বেঙ্গালুরু: কী হচ্ছে চাঁদের পিঠে? আদৌ কি সফল অবতরণ করতে পেরেছে বিক্রম? নাকি আছড়ে পড়েছে চন্দ্রপৃষ্ঠে? বোঝা যাচ্ছে না স্পষ্ট। কারণ, যোগাযোগই ছিন্ন হয়ে গিয়েছে বিক্রমের সঙ্গে। মিলছে না কোনও সংকেত। তাই চন্দ্রযান ২ এই অভিযান আদৌ সফল না ব্যর্থ তার কোনই উত্তর নেই। সারাদিন ছিল উদ্বেগ আর উত্তেজনার মিশেল। কাউন্টডাউন শুরু হয়েছিল রাত ১.১০ থেকেই। হিসেব মতো তখন ৭ তারিখ হয়ে গিয়েছে। অধীর অপেক্ষায় শুধু বেঙ্গালুরুতে ইসরোর সদর দপ্তর নয়, রাত জাগছিল সারা দেশ। নজর রেখেছিল নাসা-সহ বিশ্বের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ মহাকাশ গবেষণা সংস্থাগুলিও। অবতরণের ১৫ মিনিট আগে গতি কমানোর প্রক্রিয়া ঠিক সময়ে ঠিকভাবেই শুরু হয়েছিল। গতিও কমছিল হিসেব মতোই। তবে চন্দ্রপৃষ্ঠ থেকে যখন ২.১ কিলোমিটার উপরে চন্দ্রযান ২ সেই সময়েই ছিন্ন হয় যোগ। ততক্ষণ পর্যন্ত অবশ্য সবকিছু চলছিল ঠিক মতো এমনই জানালেন ইসরো প্রধান কে শিবন।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি রাত ৯টা নাগাদই বেঙ্গালুরু পৌঁছে যান। সওয়া একটা নাগাদ এসে পৌঁছন ইসরোর সদর দপ্তরে। ইসরোর কয়েক হাজার কর্মীর সঙ্গে অডিটোরিয়ামে বসে তিনিও নজর রাখছিলেন চন্দ্রযানের গতিবিধির দিকে। তখনও পর্যন্ত বিক্রম চলছিল ঠিক পথেই। বারেবারে হাততালির শব্দে মুখর হচ্ছিল কন্ট্রোল রুম, অডিটোরিয়াম। উত্তেজনায় শামিল হচ্ছিলেন সেখানে হাজির বিশ্বের নানা প্রান্তের সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধি, অতিথি, খুদে পড়ুয়ারা। সকলেরই চোখ পর্দায়। কতটা সবকিছু বোঝা যাচ্ছে তারথেকেও বেশি ছিল উত্তেজনা। প্রতিটা সেকেন্ড কাটছিল এক এক ঘণ্টার মতো। কতক্ষণে বিক্রমের অবতরণের খবর আসবে, ছিল তারই অপেক্ষা। কিন্তু ভারতীয় সময় ১টা ৫২ মিনিট ৫৪ সেকেন্ড বেজে যাওয়ার পরেও যখন কোনও সংকেত এসে পৌঁছল না সকলের মুখেই ঘনাল ছায়া। মোদি কিংবা সিভান, সমস্ত কর্মী কিংবা অতিথি, সাংবাদিক কিংবা পড়ুয়া-সকলেই প্রবল উদ্বেগে। এইভাবেই কয়েক মিনিট কেটে যাওয়ার পর সিভান উঠে গেলেন মোদির কাছে। তারপর তাঁর বিবৃতিতে জানিয়ে দিলেন সেই তথ্য যে আপাতত কোনও সিগন্যালই আসছে বিক্রম থেকে। অর্থাৎ অবতরণ সফল হয়েছে নাকি বিফল তার কোনওটাই বলা সম্ভব হচ্ছে না। সিভানের গলায় তখন সফল না হওয়ার বেদনা। গলা কিছুটা ভারি। তবে একইসঙ্গে উপস্থিত কিছুজন আশাপ্রকাশ করলেন সিগন্যাল মিললে সুখবর আসতেও পারে।
এর কিছুক্ষণ পরেই মোদি বক্তব্য রাখলেন। কন্ট্রোল রুমে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘‘গোটা দেশ আপনাদের জন্য গর্বিত। জীবনে নানা ওঠাপড়া থাকে। ভেঙে পড়ার কিছু হয়নি। যতটুকু প্রাপ্তি হয়েছে সেটাও খুব কম কিছু নয়। আমি আপনাদের সকলকে অভিনন্দন জানাচ্ছি। আপনারা দেশের জন্য অনেক বড় কাজ করেছেন। বিজ্ঞানের জন্য, সভ্যতার জন্য অনেক দিয়েছেন। আশা করা যাক ভাল কোনও খবরই আসবে। আমি সবসময়ই আপনাদের সঙ্গে আছি। আরও সাহসের সঙ্গে এগিয়ে চলুন।’’ পরে টুইটারেও তিনি লেখেন, ‘‘আমাদের বিজ্ঞানীদের জন্য ভারত গর্বিত। তাঁরা তাঁদের সেরাটা দিয়েছেন, এবং সবসময় ভারতকে গর্বিত করেছেন। এটা এমন একটা সময় যখন সাহস রাখতে হয়। এবং আমরা সেই সাহস রাখব। আমরা আশা ছাড়ছি না। এবং মহাকাশ সংক্রান্ত আরও অনেক প্রকল্পের কাজ চলতে থাকবে।’’
India is proud of our scientists! They’ve given their best and have always made India proud. These are moments to be courageous, and courageous we will be!
— Narendra Modi (@narendramodi) September 6, 2019
Chairman @isro gave updates on Chandrayaan-2. We remain hopeful and will continue working hard on our space programme.
সকাল থেকেই প্রবল উত্তেজিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। প্রবল উৎসাহে পরপর পাঁচটি টুইট করেন তিনি। বেঙ্গালুরুতে জনা ষাটেক শিশুর সঙ্গে বসে যে আনন্দ তিনি উপভোগ করবেন তা প্রথমেই জানিয়ে দেন। বলেন, “ভারতের মহাকাশ গবেষণায় সাফল্যের এক ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকবে ভেবে আমি খুব উত্তেজিত। চন্দ্রযান ভারতীয় প্রতিভার সেরা নিদর্শন। আমার সঙ্গে বিভিন্ন রাজ্য এমনকী, ভুটানের বহু যুবক-যুবতীও হাজির হচ্ছে। ১৩০ কোটি ভারতবাসী এই মুহূর্তের সাক্ষী থাকার জন্য অপেক্ষা করে আছে। এর সাফল্য ভারতের মহাকাশ গবেষণার শক্তি প্রমাণ করবে।” কিন্তু বিক্রমের সঙ্গে যোগাযোগ ছিন্ন হওয়ার পর সদর দপ্তর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার আগে সেখানে হাজির পড়ুয়াদের সঙ্গে যখন তিনি কথা বলছিলেন, সেই উৎসাহে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা বিষণ্ণতার ছায়া লেগে ছিল। বিক্রম থেকে সিগন্যাল আসার পর এই কথোপকথন হলে দুই তরফেই উচ্ছ্বাস যে প্রবল হত, তাতে সন্দেহ নেই।
২২ জুলাই দুপুরে অন্ধ্রপ্রদেশের শ্রীহরিকোটা সতীশ ধাওয়ান স্পেস সেন্টার থেকে চন্দ্রযানকে নিয়ে উড়ান শুরু করে বাহুবলী জিওসিঙ্ক্রোনাস রকেট। ২৩ দিন পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করে ১৪ আগস্ট ভোর রাতে চন্দ্রযান লাফ দেয় চাঁদের দিকে। ২৫ দিন চাঁদকে পাক খেয়ে অবশেষে অবতরণ। আর সেই চূড়ান্ত ক্ষণটি আদৌ এসেছে কি না, তা অজানা সকলের জন্য। চাঁদের রূপের চেয়ে কেন তার কলঙ্ককে সবাই এত ভয় পায়। এদিনই সকালে ইসরোর প্রাক্তন এক বিজ্ঞানী আবারও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, “রুক্ষভূমির এই মাটিতে বায়ুমণ্ডল নেই। সেটা থাকলে বরং একটা প্যারাশুটে করে নেমে পড়া যেত। নেই বলেই বারবার সফট ল্যান্ডিং বা পাখির পালকের মতো অবতরণে জোর দেওয়া হচ্ছিল।” সেই বাতাসের অভাবটাই এখন যেন আরও বেশি অনুভূত হচ্ছে।
দক্ষিণ মেরুর যে প্রান্তে ল্যান্ডারের নামার জন্য বাছা হয়, সেখানে বড় বড় দুটি গহ্বর। ম্যানজিনাস আর সিমপেলিয়াস। তার মাঝে একটি সমতল ভূমি। এর ধারেকাছে নামতে গিয়েই মুখ থুবড়ে পড়েছিল ইজরায়েলি উপগ্রহ। সেই চিন্তাও ছিল। তবে এখনই আশা ছাড়তে রাজি নয় ভারতের মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্র ইসরো। কী কারণে সংযোগ ছিন্ন হয়েছে, খতিয়ে দেখা হবে তা-ও। আর যদি সংযোগ স্থাপন করা যায়, তাহলে চাঁদের পিঠ থেকে যে তথ্য পাওয়া যাবে, মোট ১৩ রকমের পরীক্ষা করা হবে এই গবেষণা পর্বে। আর একটি গবেষণা করবে নাসার পাঠানো একমাত্র যন্ত্র। চাঁদ ও পৃথিবীর সঠিক দূরত্ব নির্ণয় করবে সেটি। এছাড়া চাঁদের খনিজ, জল, তার কম্পন, বায়ুমণ্ডল, বেতার তরঙ্গের মতো একাধিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে গবেষণা চালানো হবে।
প্রসঙ্গত, এই অভিযানের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন একাধিক বাঙালি বিজ্ঞানী। তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন হুগলির চন্দ্রকান্ত কুমার। চরম উৎকণ্ঠার মুহূর্তে অবশ্য তিনি মুখ খোলেননি। শুধু বুঝিয়ে দিয়েছেন কী প্রবল স্নায়ুচাপের মধ্যে রয়েছেন তিনি। তাঁর বানানো অ্যান্টেনার মাধ্যমেই যে সবটা নিয়ন্ত্রণে ছিল। যদিও রাত তিনটের সময় এই কপি যখন পাঠাচ্ছি, তখনও কোনও সিগন্যাল এসে পৌঁছায়নি গুড়াপের সেই বিজ্ঞানীর অ্যান্টেনায়।
খবরের টাটকা আপডেট পেতে ডাউনলোড করুন সংবাদ প্রতিদিন অ্যাপ
Copyright © 2024 Pratidin Prakashani Pvt. Ltd. All rights reserved.